গাজী তানজিয়া
প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:২২ এএম
প্রতীকী ছবি।
কোনো আড্ডায় বা ঘরোয়া আসরে যখন কেউ বলে ওঠেন যে তিনি হাত দেখে ভাগ্য বলতে পারেন, তখন তার দিকে কৌতূহলে হাত মেলে ধরেন না, এমন মানুষ খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের এই স্বর্ণযুগে বাস করে এ কি নিছক মানুষের কৌতূহল, নাকি অগাধ বিশ্বাস! এ নিয়ে তর্কের অবশ্য শেষ নেই। ভেবেছিলাম ভারতের চন্দ্র জয়ের পর জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহের কিছুটা ভাটা পড়বে। কিন্তু বছর শেষে ইউটিউবে শত শত জ্যোতিষীর ভাগ্য গণনা ও তার মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ এই ধারণায় একেবারেই জল ঢেলে দিয়েছে। এই বেশ কয়েক বছর আগেও যখন সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকাগুলোর রমরমা অবস্থা ছিল, তখন বর্ষশেষে বা বছরের শুরুতে বের হতো সাল গণনা বা রাশিফল। একটা গোটা ইস্যুই থাকত রাশিফল। এবং এই পত্রিকাগুলো নিয়মিত গ্রাহক ছাড়াও অনিয়মিত গ্রাহকেরাও সংগ্রহ করতেন বিপুল উৎসাহে। মানুষ মুখে যা-ই বলুক না কেন, অতিপ্রাকৃত, অলৌকিক অথবা আপাতদৃষ্টিতে অবাস্তব বিষয়ের প্রতি তার আগ্রহ অপরিসীম। বিশেষত জীবন যুদ্ধে হোঁচট খাওয়া বা হতাশ মানুষ যখন তার সামনে সবকিছু ধোঁয়াশাচ্ছন্ন দেখে তখনই সে তার এক হাত সামনেও কী আছে তা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। অনিশ্চয়তা, হতাশা, বিষণ্ণতা থেকে খানিকটা উপশম পেতে মানুষ যেমন তার ভবিষ্যৎ জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠে, তেমনি কিছু মানুষ বিশ্বাস থেকেও এর শরণাপন্ন হন। কেউবা নিছক শখের বশে জ্যোতিষশাস্ত্রের বইয়ের পাতা ওল্টান। কিরো অমনিবাস বা শ্রী-ভৃগুর জ্যোতিষ শাস্ত্রের বই এক সময়ে মানুষের ঘরে ঘরে দেখা যেত। এখন আছে গুগলে, ইউটিউবে।
জ্যোতিষশাস্ত্র আসলে কী? জ্যোতিষশাস্ত্র হলো এমন একটি শাস্ত্র, যা নভোমণ্ডলে বিভিন্ন জ্যোতিষ্ক অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদির অবস্থান বিবেচনা করে মানুষের ভাগ্যগণনা তথা ভাগ্য নিরূপণ করে। জ্যোতিষ একটি সংস্কৃত শব্দ। এই শব্দের একটি অর্থ হলো ‘জ্যোতির্বিষয়ক’ এবং অস্ত্যর্থে এই শব্দের একটি অর্থ হলো জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ; অন্য অর্থ ‘জ্যোতির্বিদ’। জ্যোতিষ ৬টি বেদাঙ্গের অন্যতম। বেদাঙ্গ জ্যোতিষের উপলব্ধ শ্লোকগুলোতে মূলত সূর্য-চন্দ্রের আবর্তন এবং ঋতুপরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয় আলোচিত হয়েছে। বেদ লিপিবদ্ধকরণের সময় যজ্ঞানুষ্ঠানের দিন, মুহূর্তাদি ও ক্ষণ নির্ণয়েও জ্যোতিষের বহুল ব্যবহার ছিল। উল্লেখ্য যে, সে সময় জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষবিদ্যা অভিন্ন ছিল।
ব্যক্তির জন্মসময়, তারিখ ও জন্মস্থানের ভিত্তিতে, জন্মক্ষণে মহাকাশে গ্রহের অবস্থান নিরূপণ করে অথবা প্রশ্নের সময় গ্রহদের অবস্থান নির্ণয় করে অথবা হস্তরেখাবিচার, শরীরের চিহ্নবিচারসহ বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহারের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ গণনা করা হয়। এক সময়ে জ্যোতিষশাস্ত্রের মাধ্যমে একটি বিভাগ দেশ, রাজ্য, শহর, গ্রাম ইত্যাদির এবং প্রাকৃতিক ঘটনাবলির যেমন বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভূমিকম্প, ঝড়, ঝঞ্ঝা, মহামারি বা প্লাবনের ভবিষ্যদ্বাণী করতেও ব্যবহৃত হতো। আধুনিককালের জ্যোতিষীগণ প্রতীকের মাধ্যমে জ্যোতিষশাস্ত্র চর্চা করে থাকেন। এ ছাড়াও এটি এক ধরনের কলাশাস্ত্র যা ভবিষ্যৎকথন হিসেবে পরিচিত। উল্লেখ্য, জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রয়োগসূত্রগুলো কেবল সম্ভাবনা নির্দেশ করে, কিন্তু কোনো নিশ্চিত ঘটনার কথা বলে না। তার কারণ এই যে জ্যোতিষীরা মনে করেন মানুষ সচেতন কর্মের সাহায্যে অথবা ঈশ্বরের আশীর্বাদে অথবা এই দুইয়ের মিশ্রিত ফলে ভাগ্য অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবর্তন করতে পারে। এই নিশ্চয়তার তারতম্যের কারণে অনেক বিজ্ঞানী জ্যোতিষশাস্ত্রকে মান্যতা দেন না। একদিকে যেমন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ইয়োহানেস কেপলার একই সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং জ্যোতিষী ছিলেন, আবার অন্যদিকে বিজ্ঞানীদের অনেকে জ্যোতিষশাস্ত্রকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। যেমন - ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে দ্য হিউম্যানিস্ট পত্রিকায় অনেক বিজ্ঞানী আনুষ্ঠানিকভাবে জ্যোতিষশাস্ত্রের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এ ছাড়া বিখ্যাত বিজ্ঞান কাহিনি লেখক কার্ল সেগান তার একটি প্রামাণ্য চিত্রে এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তা সত্ত্বেও জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রতি বহু মানুষের বিশ্বাস এখনো অটুট আছে। মধ্যযুগীয় ইউরোপে জ্যোতিষশাস্ত্র বহুল চর্চিত হয়েছিল। এই সময় হেলেনীয় ও আরব জ্যোতিষীদের রচনা লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। পরবর্তী মধ্যযুগে এই বিদ্যার অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান নির্ভর করত ইউরোপের রাজ-দরবারগুলোতে এর অভ্যর্থনার ওপর। ফ্র্যান্সিস বেকনের সময়কালেই প্রথম গবেষণামূলক অধিবিদ্যা হিসেবে জ্যোতিষশাস্ত্র প্রত্যাখ্যাত হয় এবং তা শুধু প্রায়োগিক পর্যবেক্ষণ হিসেবেই গৃহীত হয়। এর পর সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্যে জ্যোতিষবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের মধ্যে বিভাজন ধীরে ধীরে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সময় সেখানকার অভিজাত বুদ্ধিজীবী শ্রেণি জ্যোতিষশাস্ত্রকে অতিপ্রাকৃত বিজ্ঞান বা কুসংস্কার হিসেবে দেখতে শুরু করেন। দুই বিদ্যার সুদীর্ঘ একক ইতিহাসের নিরিখে আজও কখনো কখনো দুটির পার্থক্য সম্পর্কে ভ্রম সৃষ্টি হয়ে থাকে। অনেক সমসাময়িক জ্যোতিষী অবশ্য জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান বলে দাবি করেন না। বরং এটিকে তারা আই-চিং শিল্পের মতো ভবিষ্যৎ কথনের একটি রূপ অথবা একটি আধ্যাত্মিক বিশ্বাস মনে করেন। এই ধারণাটি প্রভাবিত হয়েছে নব্য-প্লেটোনবাদ, নব্য-প্যাগানবাদ, থিওসফি ও হিন্দুধর্মের মতো মতবাদগুলোর দ্বারা। তাই তো এক ধরনের বিশ্বাস বা কৌতূহল থেকে দেশে দেশে ফেংসুই, রেইকি, বাস্তুশাস্ত্র, ট্যারট কার্ডের মতো বিষয়গুলো এখনো সমান জনপ্রিয়। যা বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ ব্যবহার করে দিনে দিনে বিস্তৃতি লাভ করছে। দেখলাম বর্তমান নির্বাচনের বছরে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে, কারা হতে চলেছেন হবু শাসক এ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে ফেলছেন ইউটিউবের জ্যোতিষীগণ। আমাদের নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নিয়ে যদিও ভবিষ্যদ্বাণীর প্রয়োজন ছিল না, তবে নির্বাচন-পরবর্তী দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কী দাঁড়ায় সে নিয়ে একটু শঙ্কা তো থাকেই। সেই দিক বিচারে জন্ম রাশি অনুযায়ী ধনু রাশির জাতিকা বাংলাদেশের বৃহস্পতি নাকি পঞ্চমে আর শনি তৃতীয়ে অবস্থান করছে!
লেখক: কথাসাহিত্যিক