তৌসিফ আহমেদ
প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০১ পিএম | আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:৪৫ এএম
প্রতীকী ছবি।
‘ঐ দূর পাহাড়ের ধারে দিগন্তেরই কাছে/নিঃসঙ্গ বসে একটি মেয়ে/গাইছে আপন সুরে’- অনেকগুলো গানের একটি তালিকা থেকে এ গানটি বেছে নেয় মুক্তি (ছদ্মনাম)। একই তালিকা আকাশকে দেখানো হলে সে বেছে নেয় ‘কেন এই নিঃসঙ্গতা/কেন এই মৌনতা/আমাকে ঘিরে।’ যাদের কথা লিখলাম তারা দুজনই পার করছে বয়ঃসন্ধিকালের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই দুই কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেউ তাদেরকে কেন যেন আর বুঝতে চেষ্টা করে না, অথচ কিছুদিন আগেও এমনটি ছিল না। কেন এমনটি হচ্ছে- এটা বুঝতে না পেরে নিজেদেরকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিয়েছে তারা। অথচ এমন এই সময়টাতেই তাদের উচ্ছল মনটা পাখির মতো ডানা মেলতে চায়।
এ কথা সত্য যে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা অনেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ‘ছুটি’ গল্পে উল্লেখিত সমাজের মানুষের মতো ভাবি, ‘১৩-১৪ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।’ কিন্তু এমন ধারণা মোটেও ঠিক নয় এবং তাদের বয়ঃসন্ধিকালের শরীর ও মনের নানা পরিবর্তনকে উপেক্ষা করা যাবে না। ইউনিসেফের তথ্যমতে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশই কিশোর-কিশোরী। অথচ তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার দিকটি এখনো এদেশে উপেক্ষিতই বলা চলে।
শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন
মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল ছেলেদের চেয়ে কিছুটা আগে শুরু হয়। মূলত ১০ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে যে কোনো সময় তা হতে পারে। অন্যদিকে ছেলেদের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধিকাল আসে ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সের মধ্যে। এ বয়সে মেয়েদের উচ্চতা বাড়ে। শরীরের বিভিন্ন অংশ স্ফীত হয়। বাহুমূল ও যৌনাঙ্গে লোম গজায়। মাসিক শুরু হয়। তেমনি এ সময় ছেলেদের দেহের উচ্চতা দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে, গলার স্বর ভারী হয়ে আসে, কাঁধ চওড়া হয়, পেশি সুগঠিত হয়। মুখে দাড়ি-গোঁফ ওঠে, সেই সঙ্গে শরীরের নানা জায়গায় বিশেষ করে, বুকে, বাহুমূলে ও যৌনাঙ্গে লোম গজায়। বয়ঃসন্ধির এই সময়টা ছেলে মেয়ে উভয়ের প্রজনন ক্ষমতা বিকাশ হতে থাকে বলে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে তারা।
মানসিক পরিবর্তনের মধ্যে দেখা যায়, এই সময় থেকে ছেলে-মেয়েদের আত্মপরিচয় গড়ে উঠতে শুরু করে। তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গা তৈরি হয়। নিজের জীবন, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম সম্পর্কে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।
পরিবার ও সমাজের ভূমিকা
বয়ঃসন্ধিকালে অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের নিয়ে অযথা বিড়ম্বনা না বাড়িয়ে বন্ধু হয়ে সন্তানদের পাশে দাঁড়ানো। কেননা এই সময়টাই আসলে অঙ্কুরিত হওয়ার সময়। তারা যাতে অঙ্কুরেই ঝরে না যায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কিশোর-কিশোরীরা স্বভাবতই ভীষণ কৌতূহলপ্রবণ হয়ে থাকে। এই কৌতূহলপ্রবণতার কারণে অনেক সময় তাদের বিপথগামী হওয়া, অযাচিত ঝুঁকি নেওয়া, মাদকের নেশা বা অপসংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তাই বয়ঃসন্ধিতে থাকা কিশোর-কিশোরীদের ভালো-মন্দ দুটি দিকের ব্যাপারেই সচেতন করে তুলতে পরিবার থেকেই নৈতিক শিক্ষা দেওয়া জরুরি।
এই বয়সে ছেলে-মেয়েদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতিও শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে মা-বাবাকে। না হলে এ বয়সী ছেলে-মেয়েরা মা-বাবার প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার জায়গাটা হারিয়ে ফেলতে পারে।
একটা সুস্থ সমাজ গঠনে বয়ঃসন্ধিকাল এবং এ বয়সজনিত সমস্যা নিরসনে যৌনশিক্ষাকে মানুষের চরিত্র এবং আচরণ গঠনের ক্ষেত্রে অন্যান্য শিক্ষার মতোই প্রাধান্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আজ যারা কিশোর-কিশোরী তারাই একদিন এ দেশ ও সমাজের হাল ধরবে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কৌশলী ও সঠিক ভূমিকা পালন করা জরুরি।