স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ পিএম | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০২:৩৮ পিএম
বছরজুড়ে চলা সহিংসতায় এখনো উত্তপ্ত মণিপুর। ছবি: পিটিআই
প্রতিটা বছর কাটে কিছু ভালো, কিছু মন্দের মিশেলে। ২০২৩ সালও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে ভারতের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল বছরটি। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন, মণিপুরে জাতিগত সংঘাত, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কুস্তিগিরদের প্রতিবাদের ঘটনা ছিল বিদায়ী বছরে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
মণিপুরে জাতিগত সংঘাত
মেইতি সম্প্রদায়ভুক্ত মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার গত কয়েক বছরে আদিবাসী অধ্যুষিত পাহাড়ে পপিক্ষেতের বিশাল অংশ ধ্বংস করেছে এবং মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে সংরক্ষিত বন থেকে কথিত অবৈধ অভিবাসীদের উচ্ছেদ করেছে। এটি আদিবাসীদের মধ্যে গভীর অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে কুকিদের অভিযোগ, তাদের কয়েকটি গির্জা ও অনেক বাড়ি নিয়ম মেনে তৈরি হওয়া সত্ত্বেও ওই অভিযানে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
মেইতি সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের দাবি তফসিলি আদিবাসী জাতিভুক্ত (এসটি) হওয়া। মণিপুর হাইকোর্ট মেইতি সম্প্রদায়কে তফসিলি জাতিভুক্তদের তালিকায় আনা যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখতে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেন। এরপরই নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে উত্তর-পূর্বের এই রাজ্য। এটি আদিবাসীদের আতঙ্কিত করেছে, কারণ ‘সাধারণ’ থেকে এসটি হয়ে উঠলে মেইতিরা চাকরি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে এসটিদের জন্য সংরক্ষিত সরকারি সুবিধায় ভাগ বসাবেন। আদালতের নির্দেশের প্রতিবাদে ৩ মে চূড়াচাঁদপুর জেলার তোরবাঙে ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন মণিপুর’ (এটিএসইউএম) আদিবাসী সংহতি পদযাত্রার ডাক দেয়। সেখান থেকে সহিংসতার সূত্রপাত। বছরজুড়ে সংঘর্ষে অন্তত ১৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে, বাস্তুচ্যুত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। সংঘর্ষ চলাকালে নারীদের সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে হত্যার ঘটনাও হয়েছে।
মণিপুরে বিজেপির প্রথম মেয়াদ শুরু হয় ২০১৭ সালে। তখন থেকে মণিপুর সরকার পাহাড়ে হাজার হাজার একর পপি বাগান ধ্বংস করে চলছে। জমি ও জীবিকা নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেই ইম্ফল উপত্যকায় কয়েকটি গির্জা ভেঙে ফেলা হয়। এতে বিষয়টি সাম্প্রদায়িক রং পায়। তাই অনেকের পক্ষে চলমান সহিংসতাকে হিন্দু মেইতি বনাম খ্রিষ্টান আদিবাসী সংঘাতরূপে বর্ণনা করা সহজ হয়। কুকি, নাগাসহ বিভিন্ন আদিবাসী যারা অতীতে একে অন্যের বিরুদ্ধে বহু রক্তক্ষয়ী লড়াই করেছেন, তারা একই ধর্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হন এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে একটি ‘ঐক্যবদ্ধ আদিবাসী প্রতিবাদ’ গড়ে তোলেন। বিজেপি সরকার এ সাম্প্রদায়িকতা গড়ে উঠতে দিয়ে কার্যত নিজেদের কাজটাই করেছে।
বিজেপির কুস্তি কাণ্ড
বছরের শুরু, মাঝামাঝি আর একেবারে শেষে- তিন বার আলোচনায় উঠে এসেছে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে ভারতের কুস্তিগিরদের প্রতিবাদের ঘটনা। বিজেপি নেতা ও ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে নারী কুস্তিগিরদের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তোলা হয় জানুয়ারি মাসে। দিল্লির রাস্তায় ধর্নায় বসেন ভারতের অলিম্পিক পদকজয়ী কুস্তিগির বজরং পুনিয়া, কমনওয়েলথ গেমসে তিনবারের স্বর্ণপদক জয়ী ভিনেশ ফোগত, রিও অলিম্পিকসে ব্রোঞ্জ পাওয়া সাক্ষী মালিকের মতো তারকা কুস্তিগির। ব্রিজভূষণ অবশ্য তখন সব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন।
দ্বিতীয়বার একই ইস্যুতে মে মাসে ধর্নায় বসেছিলেন কুস্তিগিররা। যেদিন ভারতের নতুন পার্লামেন্ট ভবন উদ্বোধন হয়, সেদিনই ধর্নায় বসা কুস্তিগিরদের ব্যাপক বলপ্রয়োগ করে তুলে দেয় পুলিশ। কুস্তিগিরদের যেভাবে মারধর করে তুলে দিয়েছিল পুলিশ, সেই ঘটনার নিন্দা জানায় আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এমনকি বিশ্ব কুস্তির নিয়ামক সংগঠন ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড রেসলিং। অন্যদিকে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে প্রায় দেড় হাজার পাতার চার্জশিট আদালতে পেশ করেছে পুলিশ।
বছরের শেষ দিকে আবারও ওই কুস্তিগিরদের কথা উঠে আসে আলোচনায়। ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের নির্বাচনে সভাপতি পদে বিজয়ী সঞ্জয় সিং আগের সভাপতিরই ঘনিষ্ঠ সহযোগী। নতুন সভাপতির আমলেও কুস্তিগিরদের যৌন নিপীড়ন থামবে না- এই আশঙ্কা জানিয়ে সাক্ষী মালিক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তিনি আর কুস্তিই লড়বেন না।
রাম নবমীকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িকতা
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ভগবান রামচন্দ্রের জন্মদিবস পালন বা রাম নবমী উপলক্ষে ভারতের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনা চোখে পড়ে। দেশটির কেন্দ্র ও বেশিরভাগ রাজ্যে ক্ষমতাসীন উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের ছত্রছায়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের একাংশের মধ্যে রাম নবমী জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। রাজ্যের হিন্দিভাষী এলাকাগুলোতে রাম নবমী বহু বছর ধরেই পালিত হয়; কিন্তু বছর দশেক ধরে তা অন্যান্য অঞ্চলেও শুরু হয়েছে। আর এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই ছোট-বড় সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে।
২০১৮ সালে রাম নবমীকে কেন্দ্র করে আসানসোল রানীগঞ্জ এলাকায় বড় দাঙ্গা বেধেছিল। ২০২৩ সালের ৩০ মার্চ ওই উৎসব পালনের দিন সংঘর্ষ বাঁধে কলকাতা সংলগ্ন শহর হাওড়া ও পার্শ্ববর্তী জেলা হুগলীর রিষড়ায়। হাওড়ায় সংঘর্ষ চলে দুদিন, কিন্তু রিষড়ায় এক সপ্তাহ ধরে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে। কারও মৃত্যু না হলেও প্রচুর গাড়ি, দোকান ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়, আবাসিক ভবনে পাথর ছোড়া হয়। বিজেপি সরাসরি এ বছরের রাম নবমীর মিছিল আয়োজন না করলেও হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সংগঠন এই আয়োজন করে। আবার এ বছর ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসও পাল্টা রাম নবমীর মিছিল করেছে।
পঞ্চায়েত ভোটে সহিংসতা
পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক নাম ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। ২০২৩ সালের ভোট গ্রহণকে কেন্দ্র করে জুন-জুলাই মাসে অন্তত ২২ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ভোটগ্রহণের দিন ৮ জুলাই মারা যায় ১১ জন। সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা সামনে আসে কোচবিহার, মুর্শিদাবাদ, মালদা, পূর্ব বর্ধমান থেকে। রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস অভিযোগ করে, নিহতদের বেশিরভাগই তাদের দলের কর্মী। প্রধান বিরোধী দল বিজেপি, কংগ্রেস আর সিপিআইএম কর্মী-সমর্থকদের নামও সহিংসতায় নিহতের তালিকায় উঠে এসেছে। রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যা, বোমাবাজি, বুথ দখল হয়ে যাওয়া বা জাল ভোট দেওয়ার খবরের মধ্যেই এবারের ভোটে একেবারেই নতুন ঘটনা দেখা গেছে নানা জায়গায়, যেখানে ব্যালট বাক্স উঠিয়ে নিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া বা পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলেন, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমেই যেহেতু গ্রামোন্নয়নের সিংহভাগ অর্থ খরচ হয়, তাই দুর্নীতির ব্যাপক সুযোগ থাকে এখানে। সেই লোভেই সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে পঞ্চায়েত ভোটে জিততে চান প্রার্থীরা।
কানাডায় শিখ নেতা হত্যা
২০২৩ সালের ১৮ জুন কানাডার শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কানাডার হাউস অব কমন্সের সভায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অভিযোগ করেন, খুনের ঘটনায় ‘ভারতীয় গোয়েন্দারা জড়িত’। এর বিপরীতে ভারত পাল্টা অভিযোগ করে, কানাডা সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে নিষিদ্ধ খালিস্তানি সংঠনের সদস্যদের নাগরিকত্ব দেওয়ার মাধ্যমে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত-কানাডার সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে এবং কূটনৈতিক দ্বন্দ্বও তৈরি হয়।
নিজ্জারের হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত খালিস্তানপন্থি এক শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নু কানাডার বসবাসকারী হিন্দুদের হুঁশিয়ারি ও ভারতে নাশকতার হুমকি দেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল দপ্তর সে দেশের নাগরিক ও শিখ নেতা গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুকে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে। ওই ষড়যন্ত্রে নিখিল গুপ্তা নামে এক ভারতীয়কে গ্রেপ্তারও করা হয়। দায়ের করা অভিযোগপত্রে একই সঙ্গে বিস্তারিতভাবে জানানো হয়, কীভাবে ভারতের এক সরকারি কর্মকর্তা ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিলেন।
বিধানসভা নির্বাচন
২০২২ সালে হিমাচল প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের পর এ বছর ত্রিপুরা, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, কর্ণাটক, মিজোরাম, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও তেলেঙ্গানায় ভোট হয়। ত্রিপুরায় জেতে বিজেপি, মেঘালয়ে সরকার গঠন করে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির নেতৃত্বাধীন মেঘালয়া ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স, নাগাল্যান্ডে বিজেপির সঙ্গে জোটে জেতে ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টি। অন্যদিকে মে মাসে কর্ণাটকে অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস জয়ী হয়। নভেম্বরে তেলেঙ্গানাতেও একই ছবি দেখা যায়। তবে ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে জয়ী হয় বিজেপি। তিনটি হিন্দিভাষী রাজ্যেই বিজেপির জয়ের কৃতিত্বও তাদের নেতা নরেন্দ্র মোদিকেই দিয়েছে তার দল।
ভারতে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আর কয়েক মাস বাকি থাকতে ‘সেমিফাইনালে’ এই জয় গেরুয়া শিবিরের আত্মবিশাস দৃঢ় করেছে। অন্যদিকে এই তিন রাজ্যে ভরাডুবির পর কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে সরব হয়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিক দলগুলো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, রাজ্যে বিধানসভা ভোটের ফলাফল এবং ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আসন্ন লোকসভা ভোটে মোদি সরকারের জয়ের ইঙ্গিত বহন করছে।