জীবনানন্দের ‘দেশ’

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৩২ এএম | আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:২৩ পিএম

ধানসিড়ি নদী; জীবনানন্দের কবিতায় অনেকবার এসেছে এর নাম। অবস্থান ঝালকাঠি শহরের পশ্চিম প্রান্তে। ইনসেটে জীবনানন্দ দাশ।

ধানসিড়ি নদী; জীবনানন্দের কবিতায় অনেকবার এসেছে এর নাম। অবস্থান ঝালকাঠি শহরের পশ্চিম প্রান্তে। ইনসেটে জীবনানন্দ দাশ।

রাষ্ট্র, দেশ ও দ্যাশের মধ্যে কিছু ফারাক আছে। জীবনানন্দ দাশের ব্যক্তিজীবন আমাদের সামনে সেই ফারাক উন্মোচন করে। রাষ্ট্র মানে একটি আইনগত ভূখণ্ড, যার একটি ভৌগোলিক সীমারেখা আছে, একটি মানচিত্র আছে, যেখানে একটি সরকার আছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র হচ্ছে একটি ভূখণ্ডের রাজনৈতিক পরিচয়। কিন্তু দেশের ব্যাপ্তি আরও বড়। দেশ হচ্ছে একটি অনুভূতির নাম। যেটি সাধারণ মানুষের অনুভূতিতে একটা সময়ে গিয়ে দ্যাশে পরিণত হয়।

উনিশশ সাতচল্লিশে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার আগে তৎকালীন পূর্ববাংলার শহর বরিশালে জীবনানন্দের জন্ম। কিন্তু তার বয়স যখন ৪৮, সেই বছর ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয় তার ‘দেশ’। জন্ম হয় দুটি রাষ্ট্রের।

১৯৪৬ থেকে মৃত্যুবধি অর্থাৎ ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এই আট বছর জীবনানন্দ একটানা কলকাতায় ছিলেন, যেটি তখন তার ‘দেশ’ নয়। তার কাছে দেশ মানে ছিল পূর্ববাংলা, আরও পরিষ্কার করে বললে বরিশাল। বরিশাল তখন পূর্ব পাকিস্তানের একটি শহর। আর জীবনানন্দের সাকিন তখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু তার বুকের ভেতরে সব সময়ই খেলা করেছে তার দেশ, তার বরিশাল।

মানুষের কাছে ‘দেশ’ আসলে তার জন্মস্থান। সেটি হয়তো কোনো একটি গ্রাম অথবা শহর। হতে পারে বড় শহরও। যে কারণে কোনো অল্প শিক্ষিত সাধারণ মানুষ যখন কারও সঙ্গে পরিচিত হয়, তখন তাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনের দ্যাশ কই?’ বলে না যে আপনার বাড়ি কই? উৎসবের সময়ে সে জিজ্ঞেস করে, ‘ঈদে কি দ্যাশে যাইবেন?’ ফলে যখন সে জিজ্ঞেস করে আপনার দ্যাশ কই কিংবা ঈদে দ্যাশে যাইবেন কি না, তখন অন্যজন জবাব দেয় দ্যাশ তো বরিশাল, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা। কেউ বলে না আমার দেশের নাম বাংলাদেশ। কারণ উত্তরদাতাও জানেন যে, প্রশ্নকর্তা তাকে দেশ বলতে তার বাড়ি কোথায় সেটি জানতে চেয়েছেন। এখানে দেশ মানে বাড়ি, জন্মস্থান- যেখানে তার নাড়িপোঁতা। যে নাড়ির টানে সে উৎসব-পার্বণে ছুটি পেলেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন ও লঞ্চের ছাদে, এমনকি পণ্যবাহী ট্রাকে চড়েও জন্মস্থানের দিকে ছুটে যায়। এই ছুটে যাওয়ার যে অনুভূতি, যে টান, যে উন্মাদনা- সেটিই দেশপ্রেম।

বলা হয়, কাউকে তার জীবনযাপনের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার শর্তে যদি বলা হয় এবার আপনি আপনার পছন্দসই কোথাও চলে যান, তাহলে তিনি ব্যাগ-ব্যাগেজসহ যেদিকে রওনা হবেন, সেটিই তার দেশ। কারণ নিশ্চিতভাবেই তিনি জন্মস্থানের দিকে যাবেন (খুব ব্যতিক্রম বাদে)। অর্থাৎ দিন শেষে মানুষ আসলে তার দেশ বা দ্যাশে ফিরতে চায়। যেখানে মায়ের টান। যেখানে শৈশবে কাদায় মাখামাখি আর ধান-নদী-খালের মায়াভরা স্মৃতি। যেখানে বন্ধু-পরিজন। যেখানে নামলেই লোকেরা কাছে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে, ‘কবে আইছো?’ অর্থাৎ মানুষ যেখানে যায়, যেখানে ফেরে, সেটিই তার দেশ, সেটিই তার দ্যাশ।

বরিশালের জলপথে প্যাডেল স্টিমার; এই স্টিমার ছিল জীবনানন্দের বরিশাল—কলকাতা যাত্রার প্রধান বাহন

রাজধানী বা অন্য কোনো ঝা চকচকে বড় শহর তার দ্যাশ নয়। বরং এইসব শহরে তাকে আসতে হয় পেটের তাগিদে। কাজের খোঁজে। পেট তাকে দ্যাশছাড়া করে। সেই পেটের তাগিদেই জন্মস্থান বরিশাল ছেড়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। বরিশাল শহরে ব্রজমোহন কলেজের চাকরিটা তার মন্দ ছিল না। কিন্তু দেশভাগের উন্মাদনায় পূর্ববাংলার অমুসলিমদের মধ্যে জীবন-জীবিকা নিয়ে যে অনিশ্চয়তাবোধ তৈরি হয়, জীবনানন্দও সেই আতঙ্ক বা অনিশ্চয়তা থেকে মুক্ত ছিলেন না।

শুধুই জীবিকার অনিশ্চয়তা নয়
জীবনানন্দ যে শুধুই দেশভাগজনিত উত্তেজনায় জীবিকার আসন্ন সংকট নিয়ে উদ্বেগের কারণেই বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় থিতু হতে চেয়েছিলেন, তা নয়। বরং ‘আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে।’

চাকরিহীনতার কালে, এমনকি ১৯৩৫ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ইংরেজি বিভাগে যোগদানের পরও নানা কারণে, বিশেষ করে শিল্প-সাহিত্য ইস্যুতে বরিশালের প্রতি মাঝেমধ্যে তার বিরক্তি বা অভিমান ফুটে উঠেছে। ১৯৩৭ সালের ২ জুলাই প্রমথ চৌধুরীকে লেখা চিঠিতে বলছেন, ‘কলকাতায় থাকলে পাঁচ মিনিটে যে জিনিস পাওয়া যেত এখানে (বরিশাল) তা পেতে এক সপ্তাহেরও বেশি লেগে গেল। মফস্বলের এই শহরগুলো এখনো নানা দিক দিয়ে (বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পশ্চাৎপদ) হয়ে আছে। এখানে (সংস্কৃতি) জিনিসটা একরকম নেই বললেই হয়। সাহিত্যসৃষ্টি তো দূরের কথা, সাহিত্যচর্চাও খুব কম লোকই করে। সেই জন্যেই কলকাতায় কোনো কাজ নিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে, এই আবহাওয়ার ভিতর মন আর টিকে থাকতেই চায় না।’

বরিশাল ছাড়ার ব্যাকুলতা টের পাওয়া যায় প্রমথ চৌধুরীকে লেখা এই চিঠিতেই, ‘কোনো রকমে কলকাতায় কোনো কলেজে চাকরি নিয়ে বসতে পারলে সুবিধে হতো। রিপন কলেজে ইংরেজির স্টাফ-এ আপনি যদি আমার জন্য একটা জায়গা করে দেন তা হলে আমার বড় উপকার হয়। মি. জে চৌধুরী ও মি. ভবশঙ্কর ব্যানার্জিকে আপনি যদি একটু বিশেষভাবে বলেন, তা হলেই হয়ে যায়। এখনই নতুন সেশন আরম্ভ হবে; আজকালই নতুন লোক নিযুক্ত করার সময়।’

বরিশালে ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষকতা করে দিনকাল ভালোই কেটে যাচ্ছিল বটে। কিন্তু লেখালেখির চর্চা ও প্রকাশের যে পরিম-ল তিনি চেয়েছিলেন তা অনুপস্থিত ছিল পূর্ববাংলার এই শহরে। তাছাড়া ওই সময়ে কলকাতাকেন্দ্রিক কবি-সাহিত্যিকদের যে বলয় গড়ে উঠেছিল, তার থেকে হয়তো নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা সমীচীন বোধ করেননি। কেননা শুধু চাকরি করে টাকা কামানোই যে জীবনের ধ্যানজ্ঞান নয়, তা বলছেন ‘জলপাইহাটি’ উপন্যাসের নায়ক সুতীর্থ, ‘নিরেট পৃথিবীতে টাকা রোজগার করতে গিয়ে মূর্খ ও বেকুবদের সঙ্গে দিনরাত গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে মনের শান্তি ও সমতা নষ্ট হয়ে যায়।’ এখানে সুতীর্থ যে জীবনানন্দ নিজেই- তাতে সন্দেহ নেই।

জীবনানন্দের শহর বরিশালের রাস্তায় তার কবিতা লেখা রিকশা

এরকম বাস্তবতায় বরিশালে থাকাকালে ১৯৪৩ সালের ৪ জুলাই ছোট ভাইয়ের স্ত্রী নলিনী চক্রবর্তীকে এক চিঠিতে লিখছেন, ‘এবার সুদীর্ঘ গ্রীষ্মের ছুটি কলকাতায় তোমাদের সঙ্গে কাটিয়ে খুবই আনন্দ লাভ করেছি। কলকাতায় গিয়ে এবারও নানারকম অভিজ্ঞতা লাভ হলো। সাহিত্যিক, ব্যবসায়িক ইত্যাদি নানারূপ নতুন সম্ভাবনার ইশারা পাওয়া গেল।... বরাবরই আমার আত্মবৃত্তি ও জীবিকা নিয়ে কলকাতায় থাকবার ইচ্ছা। এবার সে ইচ্ছা আরও জোর পেয়েছে।’ (প্রভাতকুমার দাস সম্পাদিত পত্রালাপ জীবনানন্দ দাশ, পৃষ্ঠা ১২৩)।

জীবনানন্দ বিশ্বাস করতেন, কলকাতার অলিগলি মানুষের শ্বাসরোধ করে বটে, কিন্তু কলকাতার ব্যবহারিক জীবনে একটা প্রান্তরের মতো মুক্তি পাওয়া যায়; এখন যখন জীবনে কর্মবহুলতার ঢের প্রয়োজন, কলকাতার এই স্বচ্ছন্দ পটভূমির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা চলে না আর।

তবে এও ঠিক যে, জীবিকার প্রয়োজনে কলকাতায় গিয়েও নিশ্চিত ছিলেন না জীবনানন্দ। ‘বাসমতীর উপাখ্যান’-এ বলছেন, ‘বাসমতীতে কলেজের কাজে থাকলে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার খানিকটা সম্ভাবনা আছে বটে, কিন্তু কলকাতায় গেলে সপরিবারে শেষে মারা যাব কিংবা টিবিতে না খেতে পেয়ে; স্বাধীনতার কোনো সেবকও আমাদের দিকে ফিরে তাকাতে যাবে না।’

ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল; জীবনানন্দ এখান থেকে আইএ পাস করেন এবং প্রায় এক যুগ এখানে শিক্ষকতা করেন

শেষদিকে কলকাতা যেন তার কাছে অসহ্য হয়ে উঠছিল। বিশেষ করে হাওড়া গার্লস কলেজে যোগদানের পর তিনি যে নির্ভার আনন্দ আর তৃপ্তি অনুভব করছিলেন, সেই সুবাদে বরং কলকাতা শহরের অদূরে এই মফস্বল এলাকায় একটা বাসা নিয়ে পরিবারসমেত থাকার চিন্তা শুরু করেছিলেন। সহকর্মী অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, হাওড়ায় বাড়ি পেলে তিনি বসবাস করবেন। কলকাতা তার পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠছে।

এই অসহ্য হয়ে ওঠার পেছনে অবশ্য মূল কারণ ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের বাসায় উপভাড়াটিয়া নারীর অত্যাচার- যে সমস্যা সমাধানে তিনি আইনজীবীরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তাছাড়া হাওড়া কলেজ থেকে ল্যান্সডাউন রোডের বাসার দূরত্বও ছিল অনেক। প্রতিদিন বাসে করে এত পথ পাড়ি দেওয়া শরীর সায় দিচ্ছিল না। উপরন্তু এই কলেজের পরিবেশে সহজেই নিজেকে মানিয়ে নেন এবং যেন প্রাণ ফিরে পান। ফলে ভাবছিলেন, এখানে থাকবেন- যেখানে তার স্বপ্নের বাসমতী বা বরিশাল শহরের মতো প্রাকৃতিক পরিবেশ রয়েছে।

জীবনানন্দের কাছে শুধু জীবিকাই যে প্রধান শর্ত ছিল তা নয়। বরং বাংলা তথা ‘দেশ’ ছাড়তে হবে বলে তিনি একাধিক চাকরির সুযোগও হাতছাড়া করেছেন। কাকা অতুলানন্দ দাশ সপরিবারে শিলং-গৌহাটিতে থাকতেন তিরিশের দশকের প্রথম দিকে এবং পরে। সেই সময় তিন বছরের বেকার জীবনানন্দের জন্য শিলং-এ তিনি একটি চাকরির ব্যবস্থা করেছিলেন, এবং জীবনানন্দ যাতে শিলং-এর সেই চাকরিটা নেন, কলকাতার অধ্যাপনার চাকরির জন্য বৃথা ঘোরাঘুরি না করেন, তার জন্য অন্যান্য মান্যজনের মাধ্যমে এবং নিজেও অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু শিলং যেহেতু বাংলাদেশে পড়ে না, ফলে জীবনানন্দ সেই চাকরিতে যাননি। (বিভাব, জীবনানন্দ স্মরণ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৪২৬)

কোনো শর্তেই বাংলা ছাড়তে চাইতেন না
প্রথম যৌবনে ৬-৭ মাসের জন্য (১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ/এপ্রিল ১৯৩০) বাংলা থেকে দূরে দিল্লির রামযশ কলেজে শিক্ষকতা করলেও পরে আর কোনোদিনই কাজ নিয়ে বাংলার বাইরে যেতে চাননি। এমনকি যখন অর্থ সংকটে ছিলেন, তখনো না। ১৯৪৬ সালে তিনি বরিশাল থেকে কলকাতায় গিয়ে যখন দীর্ঘদিন ধরে কোনো স্থায়ী কাজ পাচ্ছিলেন না, তখন আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির প্রধান অধ্যাপক জীবনানন্দের পরিচিত বন্ধু অমলেন্দু বসু উত্তরপ্রদেশের কোনো এক কলেজে জীবনানন্দের জন্য একটা চাকরি ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জীবনানন্দ বাংলা ছেড়ে কোথাও যেতে চাইলেন না। এই অনুভূতি থেকেই হয়তো বেকারত্বের কালে লিখেছেন, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’ শুধু তাই নয়, মৃত্যুর পরও তিনি ফিরে আসতে চেয়েছেন এই বাংলায়। মানুষ না হলেও অন্তত শঙ্খচিল শালিকের বেশে।

‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে।
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে।’

জীবনানন্দ যে বাংলা ছেড়ে কোথাও যেতে চাইতেন না, তার প্রমাণ মেলে ছোট বোন সুচরিতা দাশের লেখায়ও। সুচরিতা লিখছেন, ‘ল্যান্সডাউনের বাড়ির বারান্দায় দাদা ইজি চেয়ার নিয়ে বসতেন লিখতে। সামনেই ছিল একটা পত্রবহুল নিম গাছ। তার পাতার ঝালরের ফাঁক দিয়ে আলোর জলে মুছে নেওয়া ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন নীল আকাশ চোখে পড়ত। মুগ্ধ বিস্ময়ে কিছু না লিখে চুপচাপ বসে থেকে, হয়তো মনে মনে অনেক চিন্তায় নির্মম হয়ে থাকতে দেখেছি তাকে। যে কথাটা মোটেই বলার মতো কিছু নয়, সে কথাটাই যে কতবার কত নতুন পরিবেশে তিনি বলেছেন আমাকে।...বলতেন কী সুন্দর এই গাছ আর আকাশ। জানিস, এই বাংলা ছেড়ে কোথাও যাব না, কোথাও যেতে পারব না। এমন আকাশ আর গাছপালা আর কোথায় আছে বল।’

ব্রজমোহন স্কুল, বরিশাল; জীবনানন্দ এখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন

কলকাতার সুবিধাসহ বরিশাল

বাস্তবিক নানা কারণে তিনি কলকাতায় থাকলেও তার বুকের ভেতরে সব সময়ই বরিশাল ছিল। বিশেষ করে মৃত্যুর আগের বছরগুলোয় বরিশালের প্রতি তার টান তীব্র হতে থাকে। মৃত্যুর আগের বছর ১৯৫৩ সালের ২৩ এপ্রিল কায়সুল হককে লেখা এক চিঠিতে বলেন, ‘আমি বড্ড অলস, শরীরও অসুস্থ, মনও নানা কারণে ভেঙে পড়ছে। পূর্ব পাকিস্তান নিজের জন্মস্থান; সেখানে যেতে আমি অনেক দিন থেকেই ব্যাকুল; কিন্তু পাসপোর্ট ইত্যাদি কবে যোগাড় করে উঠতে পারব বলতে পারছি না।’ ক্লিন্টন বি সিলির ভাষায়, তিনি জানতেন নিজ দেশে থাকার তৃপ্তিটা কী। কারণ তিনি তার দেশকে ভালোবাসতেন তীব্র অনুরাগে।

মূলত ‘দেশ’ বলতে তিনি বরিশালকেই বুঝতেন। ১৯২৮ সালের ৬ এপ্রিল কলকাতার প্রেসিডেন্সি বোর্র্ডিংয়ে বসে মুরলিধর বসুকে লেখা চিঠিতে বলছেন, ‘দুয়েক দিনের মধ্যেই আমি দেশে যাব। চলে যাবার আগে আপনাদের সঙ্গে একবার দেখা করে যাওয়ার ইচ্ছা আছে।’ অর্থাৎ কলকাতায় থাকাকালীনও তার বুকের ভেতরে ‘দেশ’ মানে ছিল বরিশালই।

ছোট বোন সুচরিতা মাঝেমধ্যেই তাকে বলতেন, ‘কলকাতায় চলে আয় তুই, এখানে একটা চাকরি-বাকরি নে। বরিশালের আবহাওয়াটা ফিরে আসুক।’ সুচরিতা তখন কলকাতা থেকে বেশ দূরে তমলুকে রাজকুমারী সান্ত¡নাময়ী গার্লস স্কুলের শিক্ষক। ১৯৫৪ সালের ২ জুলাই তাকে লেখা চিঠিতে জীবনানন্দ লিখছেন, ‘তুমি কয়েক দিন এখানে ছিলে, বেশ বাড়ির  (আবহ) বোধ করছিলাম- বিশেষত সেই অনেক আগের বরিশালের মতন। তুমি কোনো একটি কাজ নিয়ে কলকাতায় চলে এলে নানাদিক দিয়ে খুব ভলো হতো।’

জীবনানন্দের জীবনে বরিশালের প্রভাব তার কবিতা, গল্প, উপন্যাসে মূর্ত। এমনকি ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ও আলাপচারিতায়ও, বিশেষ করে জীবনের শেষদিকে বরিশাল প্রসঙ্গ ছিল অবধারিত। বোন সুচরিতা দাশের ভাষায়, ‘মহানগরীর একটা দুর্বার আকর্ষণ ছিল সত্যি, আগেও তিনি কয়েকবার কলকাতায় চলে আসবার জন্য ঔৎসুক্য প্রকাশ করেছিলেন, তবু মনে মনে তখন এই কথাটি জানা ছিল যে, বরিশালের মাটিতে মমতাময় নিভৃত পরম আশ্রয় নীড় রয়ে গেছে। শ্রান্ত হলেই সেই নীড়ে ফিরে যাওয়া যায়। কিন্তু বাঙলা ভাগ হয়ে যাওয়ায় ছাড়তে হলো সেই শ্রান্ত নিভৃত নীড় চিরকালের জন্য।’ (সুচরিতা দাশ, কাছের জীবনানন্দ, ময়ূখ জীবনানন্দ সংখ্যা, পৌষ-জ্যৈষ্ঠ ১৩৬১-৬২)

তার মানে জীবনানন্দ বরিশালে থাকতে যেমন কলকাতায় যাওয়ার জন্য উসখুস করতেন, তেমনি কলকাতায় বসে বরিশালের জন্য হাঁসফাঁস করতেন। বাণী রায় এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘জীবনানন্দের নির্জনতাপ্রিয়তার মধ্যে লক্ষণীয় ছিল এই যে, শহরের প্রাণকেন্দ্রে তিনি থাকতে ভালোবাসতেন। তার গ্রামীণ কবিতা সত্ত্বেও এই দিক থেকে মানসিক প্রবণতা নাগরিক ছিল। অনেক লোকের মধ্যে নিঃসঙ্গতা তার ধর্ম ছিল।’ (বাণী রায়, নিঃসঙ্গ বিহঙ্গ, বিভাব, পৃষ্ঠা ৫৩)

উৎপল কুমার বসু একটি সাক্ষাৎকারে (এক ব্যাগ শিল্প/২০১৫, পৃষ্ঠা ৭) বলেছেন, ‘জীবনানন্দের স্বভাব ছিল লোককে দেখলেই এই একটা কিছু চাওয়া, বলতেন, আমাকে একটা কাজ জোগাড় করে দিন...আমার আর শহরে থাকতে ভালো লাগে না, আমাকে একটা গ্রামের কলেজে কাজ দিন... এই সব বলতেন আর কি...হুমায়ুন কবির তাকে ওই রকম একটা চাকরি দিয়েওছিলেন শুনেছি, কিন্তু উনি কলকাতা ছেড়ে যাননি...উনি চান এগুলো, এবং এগুলো সব কল্পনার জগতে আর কি...আমি গ্রামে গিয়ে পড়াব ইত্যাদি ইত্যাদি... আসলে উনি আরেকটা বরিশাল চাইতেন আর কি...।’ তার মানে জীবনানন্দ আসলে থাকতে চাইতেন কলকাতায়, কিন্তু সেখানে যেন বরিশালের সুবিধা থাকে। অর্থাৎ তিনি চাইতেন কলকাতার সুবিধাসহ বরিশাল।

জীবনের ঐশী সার্থকতা যে বাসমতী বা বরিশাল শহরেই ছিল, সেটিও বাসমতী উপন্যাসের সংলাপে পরিষ্কার, ‘কলকাতা গেলে রমা শিরোপা পেতে পারে অনায়াসেই মহারানী হিসেবে, কিন্তু বাসমতীতে থাকাই তার ভালো। নগর তাকে নষ্ট করে ফেলবে, বিকাশের বিশুদ্ধিক্রমেই আরও বিশুদ্ধি, শেষ পর্যন্ত ঐশী সার্থকতা, বাসমতীতেই সম্ভব হবে।’ অন্যত্র বলছেন, ‘কলকাতা বালীগঞ্জ ভবানীপুরে না মরে বাসমতীতে যে মরা, তাতেই লাভ, হ্যাঁ লাভ খুব।’

কিন্তু জীবনানন্দকে সেই কলকাতা শহরেই মরতে হয়েছে। কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি নয়; অতি ধীর এক ট্রামের ধাক্কায় পাঁজরের হাড়গোড় ভেঙেচুরে, শেষদিকে তীব্র নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে, কলকাতার এলগিন রোডে শম্ভুনাথ প-িত হাসপাতালে ৮ দিন ধুঁকে, ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি যে শুক্রবার জন্মেছিলেন, ৫৫ বছর পরে ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর, সেই শুক্রবার রাতেই চিরদিনের মতো চোখ বন্ধ করলেন। অরবিন্দ গুহের ভাষায়, ‘যে শহরে উনি বহুকাল ছিলেন, যে শহরকে উনি খুব ভালোবাসতেন- সেই বরিশালে থাকলে, আর যা-ই হোক ট্রাম ওঁকে স্পর্শ করতে পারত না।’

কবিতায় বরিশাল নেই
যে বরিশাল শহরে জীবনানন্দের জন্ম ও বেড়ে ওঠা; পড়েছেন এবং টানা ১১ বছর শিক্ষকতা করেছেন যে শহরে অবস্থিত ব্রজমোহন কলেজে, তার কোনো কবিতায় সেই শহরের নাম নেই। কিন্তু যে শহরে শিক্ষা, পেশা ও লেখকজীবনের একটা বড় সময় কেটেছে এবং যেখানে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেই কলকাতা শহরের উল্লেখ আছে অসংখ্য কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে।

জীবনানন্দের কবিতায় কলকাতার অলিগলি আর স্ট্রিটগুলো যেভাবে মহিমান্বিত হয়েছে, বরিশালের বেলায় তা একেবারেই অনুপস্থিত। বরিশালের যে বগুড়া রোডে (বর্তমান নাম জীবনানন্দ দাশ সড়ক) তার সাকিন, যেখানে ব্রজমোহন স্কুল বা কলেজ, যে আলেকান্দার পথ কিংবা বান্দ রোড অথবা লাকুটিয়ার পথ ধরে হাঁটতেন- সেসব সড়কের কথা কবিতায় ওই অর্থে নেই। যা আছে তা প্রতীকী। কেবল ‘ঝামা সুরকির লাল রাস্তা’র উল্লেখ আছে দুয়েক জায়গায়। কিন্তু কলকাতার প্রসঙ্গে আমরা দেখি হ্যারিসন রোড, ফিয়ার লেন, টেরিটি বাজার, নিমতলা, ক্লাইভ স্ট্রিট, চেৎলার হাট, বেলগাছিয়া, যাদবপুর, বটতলা, পাথুরিয়াঘাটা, রাজাবাজারসহ নানা সড়ক ও এলাকার নাম উল্লেখ রয়েছে তার সৃষ্টিকর্মে।

তার দীর্ঘতম উপন্যাস ‘বাসমতীর উপাখ্যান’। সাতচল্লিশে দেশভাগ পূর্ববর্তী পূর্ববাংলার হিন্দুদের যে মানসিক টানাপড়েন এবং জীবন-জীবিকা নিয়ে যে সংশয় ও উদ্বেগ, জীবনানন্দও যে তা থেকে মুক্ত ছিলেন না, সেটি বোঝা যায় তার এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসে (তার প্রায় সব উপন্যাসই আত্মজীবনীমূলক)।

এই গল্পের পটভূমি বরিশাল শহর। মূলত বরিশালকেই তিনি ‘বাসমতী’ লিখেছেন- যার প্রমাণ এই উপন্যাসের শুরুতে তিনি লিখেছেন, শহরটি পূর্ববাংলায়। দ্বিতীয়ত এই উপন্যাসে চরিত্রদের যে সংলাপের ভাষা তাও বরিশালের। আর এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সিদ্ধার্থ একজন কলেজ শিক্ষক। জীবনানন্দ নিজেও কলেজের শিক্ষক ছিলেন। যে কলেজের বিবরণ তিনি দিয়েছেন, তা আসলে ব্রজমোহন কলেজ। যে বাড়ির বর্ণনা দিয়েছেন, সেটিও সর্বানন্দ ভবন, যার বর্ণনা জীবনানন্দের আত্মীয়-পরিজন ও গবেষকরা পরবর্তীকালে দিয়েছেন। সব মিলিয়ে এই উপসংহারে আসাই সঙ্গত যে, ‘বাসমতী’ মূলত বরিশালেরই উপাখ্যান এবং সেটি দেশভাগ পূর্ববর্তী ব্যক্তি জীবনানন্দের জীবন-জীবিকার টানাপড়েনের ইতিহাস।

তবে শুধু ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ই নয়, এর বাইরে আরও অনেক উপন্যাস, গল্প ও কবিতায় জীবনানন্দের মানসিক টানাপড়েন স্পষ্ট। বিশেষ করে জীবিকার তাগিদে কলকাতা-বরিশাল এবং অবশেষে দেশভাগের কিছু আগে শেষবারের মতো কলকাতায় গিয়ে থিতু হওয়া; এ নিয়ে তার গ্লানিরও অন্ত ছিল না।

উপন্যাস ‘নিরুপম যাত্রা’র (ঐতিহ্য প্রকাশিত রচনাবলিতে গল্প হিসেবে গ্রন্থভুক্ত) নায়ক প্রভাত একজন বেকার যুবক। জীবিকার তাগিদে কলকাতায় এসেছেন। কিন্তু হৃদয় পড়ে আছে ফেলে আসা গ্রামের শ্যামলতলায়। কলকাতার পাকচক্রে বাঁধা পড়ে আছেন। কিন্তু কলকাতা তার ভালো লাগে না। রাস্তায় ট্রামে বাসে অফিসমুখী কেরানিদের জীবনের ঊর্ধ্বশ্বাসকে তার অবাঞ্ছিত বিকৃত অনিয়ম বলে মনে হয়। কিন্তু শেকড়ে ফিরে যাওয়ার তীব্র ব্যাকুলতা, মনোবাঞ্ছা তার পূরণ হয় না। কলকাতা শহরেই তার মৃত্যু হয়। উপন্যাসের নায়ক এই প্রভাতের জীবন তো স্বয়ং জীবনানন্দেরই। জীবনানন্দ নিজে যেমন একটি টিনের স্যুটকেস নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন, এই গল্পের নায়কও তাই।

জীবনানন্দের বরিশাল থেকে কলকাতায় চলে যাওয়ার পেছনে যে দেশভাগের উত্তেজনা এবং পূর্ববাংলার হিন্দুদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তাই প্রধানত দায়ী ছিল, সে বিষয়ে দ্বিমত পোষণের সুযোগ কম। ১৯৪৬-৪৭-এর ১৪-১৫ আগস্টের কাছাকাছি সময়ে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের কিছু হিন্দু শিক্ষক দেশত্যাগ করেন। যাদের মধ্যে ছিলেন হেরম্ব চক্রবর্তী, নরেন্দ্রলাল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। জীবনানন্দ সরাসরি বা তত্ত্বগতভাবে হিন্দু না হলেও (তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম, যারা হিন্দুধর্মের সব রীতি-নীতি মানতেন না, বিশেষ করে মূর্তিপূজা করতেন না। তারা ছিলেন একেশ্বরবাদী) স্বাধীনতা-পরবর্তী বরিশালের পরিস্থিতি সম্পর্কে অনিশ্চিত বোধ করছিলেন।

ক্লিন্টন বি সিলিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য দাশ বলেন, ‘স্থানীয় বাঙালি মুসলমানরা তাদের সাবধান করে দেন যে, মধ্যদেশীয় (মূলত ভারতের বিহার) মুসলমানরা পাকিস্তানে চলে আসবে, এবং হিন্দুরা নিরাপদ থাকবে না। এই অনিশ্চয়তার সঙ্গে শিক্ষকতা পেশার প্রতি অনীহা যুক্ত হয়ে আর ব্যাখ্যাতীত থাকে না, কেন কলকাতায় একটা চাকরির সুযোগ এলে জীবনানন্দ শিক্ষকতা এবং চিরদিনের জন্য বরিশাল ছেড়ে যাওয়া বেছে নিয়েছিলেন।’ ক্লিন্টন মনে করেন, বাংলার রাজধানী ও সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় নগরী কলকাতা যেসব কারণে উন্মত্ত জনতাকে প্রলুব্ধ করত, তার মধ্যে একটা বড় শহরের কর্মসংস্থানের সুযোগও আছে। (অনন্য জীবনানন্দ, ফারুক মঈনউদ্দীন অনূদিত, পৃষ্ঠা ২৩০)

চিন্তা ও দর্শনে দেশ
জীবনানন্দ নিজে সক্রিয়ভাবে রাজনীতি বা দেশের মুক্তি আন্দোলনে যোগদান না করলেও, মহাত্মা গান্ধী এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন। ফলে এ থেকে বোঝা যায়, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি তার আগ্রহ ও সমর্থন ছিল। সকল দেশপ্রেমিকের মতোই নিজের দেশ বা ভারতের জন্য জীবনানন্দেরও একটা গর্ব ছিল।

ভারতে ব্রিটিশ শোষণ ও অত্যাচারের এবং সরকার সৃষ্ট বাংলায় ১৩৫০-এর মন্বন্তরের অনেক চিত্র পাই আমরা তার ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থে। শুধু তাই নয়, ভারতের দুই প্রধান সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমান যখনই নিজেদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লিপ্ত হয়েছে, তখনই তিনি ব্যথিত বোধ করেছেন। দেশের মানুষের জন্য তার প্রাণ কেঁদেছে। হিন্দু-মুসলমান ছাপিয়ে দিন শেষে প্রত্যেকে যে মানুষ, সেই বার্তা তিনি সুস্পষ্টভাবে দিয়েছেন।

জীবনানন্দের জীবদ্দশায় দুটি বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। একটি ১৯২৬ সালে, এরপর ১৯৪৬ সালে। এ দুবারই কবি হিসেবে তিনি তার অভিমত ও বক্তব্য কবিতায় উচ্চারণ করেন। বঙ্গবাণী পত্রিকার যে সংখ্যায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩) কাজী নজরুলের ‘কা-ারী হুঁশিয়ার’ ছাপা হয়েছিল, সেই সংখ্যাতেই জীবনানন্দের ‘হিন্দু-মুসলমান’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়- ‘মহামৈত্রীর বরদ তীর্থে পুণ্য ভারতপুরে, পুজার ঘণ্টা মিশিছে হরষে নামাজের সুরে সুরে।’ এর দুই দশক পরে ১৯৪৬ সালে ফের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়। তখন জীবনানন্দ বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে শিক্ষকতা করেন। জীবন-জীবিকা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত অধ্যাপক কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে চলে যান কলকাতায়। এই সময়ে লিখলেন,
‘মানুষ মেরেছি আমি- তার রক্তে আমার শরীর
বলে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার
ভাই আমি।’

এই দাঙ্গায় যারা নিহত হলেন, রক্তাক্ত হলেন, তাদের ধর্ম পরিচয় কী, সেটি জীবনানন্দের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি জানেন, যারা মরেছে তারা সবাই মানুষ। তারা সবাই তার বন্ধু-পরিজন।
‘বলে যাবে কাছে এসে, ইয়াসিন আমি
হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ
আর তুমি? আমার বুকের পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে,
চোখ তুলে শুধাবে সে রক্তনদী উদ্বেলিত হয়ে
বলে যাবে, গগন, বিপিন, শশী পাথুরেঘাটার।’

দেশকে ভালো না বাসলে দেশের মানুষের প্রতি এই মমত্ববোধ তৈরি হয় না। আর জীবনানন্দের কাছে দেশ মানে বাংলা।

মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা
প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক, লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক ড. আনিসুজ্জামান তার একটি লেখায় (জীবনানন্দ দাশ : একটি ব্যক্তিগত পর্যালোচনা) বলেছেন, ‘আমার এক ভারতীয় বন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে একবার জানতে চেয়েছিলেন, পরেরবার যখন আসবেন, তখন কী নিয়ে আসবেন তাদের জন্য? তারা বহু দ্বিধার পরে উত্তর দিয়েছিল। জামাকাপড় নয়, খাদ্যদ্রব্য নয়, ‘রূপসী বাংলা’র একটি কপি। হয়তো এ বিচার নন্দনতাত্ত্বিক নয়, তবে একজন কবির পক্ষে এর চেয়ে বড় পাওয়া কী হতে পারে, আমার তা জানা নেই।’ (জীবনানন্দ দাশ জন্মশতবার্ষিক স্মারকগ্রন্থ, আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আবুল হাসনাত সম্পাদিত, পৃষ্ঠা ২৭)

ধুতি পাঞ্জাবি গামছা
মানুষ তার পোশাকেও দেশকে ধারণ করে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। বিদেশি সাহিত্য পড়ে কৈশোরেই আলোড়িত। অনুপ্রাণিত। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবনচর্চায় বিদেশি সংস্কৃতি কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। বলা ভালো তিনি ছাপ ফেলতে দেননি। পোশাকের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি। ধুতি, পাঞ্জাবি, পাম্প সু- এই তার পোশাক। 

একজন ইংরেজির শিক্ষক ও কবি খালি গায়ে ধুতি পরে কিংবা গায়ে একটা গামছা চাপিয়ে বাড়ির দরজা খুলে দিচ্ছেন এবং অতিথিদের দেখে তার কোনো কুণ্ঠা নেই। এটা বোধ হয় জীবনানন্দেই সম্ভব। ‘সকল লোকের মাঝে বসে নিজের মুদ্রাদোষে একা।’ 

অলোক সরকার লিখেছেন, জীবনানন্দর বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে একদিন সাহস করে এগিয়ে যাওয়া গেল। সরু গলি দিয়ে ঢুকে দরজায় কড়া নাড়তে বেরিয়ে এলেন উঁচু করে কাপড়-পরা, কাপড়ের খুঁট গায়ে জড়ানো এক স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি। এই জীবনানন্দ দাশ, রাসবিহারী এভিনিউ-এর পথে অসংখ্যবার দেখেছি, কাপড়ের কোঁচা শক্ত হাতে ধরে আড়চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে পথ চলেছেন। (স্মৃতিতে জীবনানন্দ/২০১৮ পষ্ঠা ২২৭)

জীবনানন্দের প্রথম জীবনীকার গোপালচন্দ্র রায়ও মনে করেন, জীবনানন্দের স্বদেশিকতার পরিচয় মেলে তার পোশাক-পরিচ্ছদে। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হয়েও সাহেবী পোশাক অর্থাৎ কোট, প্যান্ট ও নেকটাই কখনো পরেননি। তিনি বরাবরই ধুতি, পাঞ্জাবি ও চাদর ব্যবহার করতেন। 

সর্বানন্দ ভবন; বরিশাল শহরে জীবনানন্দের পৈতৃক বাড়ি। আদি বাড়ির এখন কোনো অস্তিত্ব নেই 

একবার একটি কলেজের চাকরিতে সাহেবী পোশাক পরতে হবে বলে সে চাকরিটা নিলেন না। অথচ তখন তার যে কোনো একটা চাকরির খুব প্রয়োজন ছিল। এই চাকরি না নেওয়ার কাহিনিটা বলছেন জীবনানন্দের ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশ, ‘১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে আমার চাকরির সূত্রে আমি কলকাতা থেকে দিল্লিতে বদলি হয়ে যাই। দিল্লি যাওয়ার আগে দাদা ও আমি একত্রেই ল্যান্সডাউন রোডের বাড়িতে ছিলাম। দাদার তখন কোনো চাকরি ছিল না বলে, সেখানে একটা মিলিটারি ট্রেনিং কলেজে দাদার জন্যে একটা কাজ ঠিক করেছিলাম। কাজটা ছিল মিলিটারি ট্রেনিং শিক্ষানবিশদের ইংরেজি শিক্ষা দেওয়া। কিন্তু দাদা তখন অভাব সত্ত্বেও সে কাজটা কিছুতেই নিলেন না। তার কারণ সেই কলেজের শিক্ষকদের কোট, প্যান্ট, নেকটাই পরতে হয়। শুনেই দাদা বললেন, ও সাহেবী পোশাক পরা আমার দ্বারা হবে না। আমি বলেছিলাম- দিন কতক পরলেই অভ্যাস হয়ে যাবে। তবুও দাদা বললেন, আমি কিছুতেই ও পোশাক পরব না। আমার চাকরির দরকার থাকলেও নেব না। তবে দাদার ওই চাকরি না নেওয়ার আরও হয়তো একটা কারণ ছিল যে, তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে আর কোথাও কাজ নিয়ে যেতে চাইতেন না।’ সে কারণেই হয়তো লিখেছিলেন...

‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও
আমি এই বাংলার পারে র’য়ে যাব
দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে
দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে।’

লেখক: সাংবাদিক ও জীবনানন্দ গবেষক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh