নেপাল: নিসর্গ সীমাহীন

কাজী সানজীদ

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:১৮ এএম | আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৩৬ এএম

নেপাল।

নেপাল।

পৃথিবীতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বেশ কয়েকটি দেশ আছে। তবে এর মধ্যে একটি দেশ আছে যেটির সঙ্গে অন্য কোনো দেশের তুলনা চলে না। দেশটির নাম নেপাল, এই উপমহাদেশের উত্তর দিকে একটি ক্ষুদ্র অংশ জুড়ে অবস্থান। পুরো দেশটিই হৃদয়হরা নৈসর্গিক শোভামণ্ডিত। এমন আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই! আমার সৌভাগ্য হয়েছে আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক রূপ মাধুর্যের দেশ মালয়েশিয়া, কেনিয়া ও ক্যামেরুন ভ্রমণ করার। কিন্তু সব দেশেই কোনো না কোনো উপাদানের ঘাটতি আছে। নেপালে শুধু নিঃসীম সাগর ব্যতীত আর সব কিছু প্রাচুর্যের মাত্রায় বিদ্যমান। না দেখলে এ মনভোলানো রূপ ভাষায় বোঝানো অসম্ভব। তথাপি চেষ্টা থাকবে যতটুকু সম্ভব বর্ণনা করার। 

কোভিডের কারণে দুবছর কোথাও যাওয়া হয়নি। তাই এ মৌসুমে নেপাল ভ্রমণের জন্য মুখিয়ে ছিলাম। প্রাক-কোভিড পরিস্থিতি সম্ভবত পৃথিবীর কোথাও এখন বিদ্যমান নেই। ভ্রমণের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যেমন বিমান ভাড়া বেড়ে গেছে, জিনিসপত্রের মূল্য বেড়েছে, বিভিন্ন চেকপয়েন্টে কড়াকড়ি বেড়েছে, বিশেষ করে কোভিড ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট সঙ্গে রাখা এবং আরও অনেক কিছু। নেপালেও তার ছোঁয়া লেগেছে। পর্যটকদের এখনো আগের মতো ব্যাপক সংখ্যায় আসা শুরু হয়নি; অথচ দেশটি পর্যটন-নির্ভর। সে কারণে দেশটির বর্তমান আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু তাই বলে মানুষের মুখের হাসি শুকিয়ে যায়নি। কষ্টে থাকলেও বোঝা যায় না। তবে হোটেল-রেস্তোরাঁয় কিছুটা বোঝা যায়। যেমন অনেক হোটেলেই বয়দের সংখ্যা কম। ব্যবসা না থাকার কারণে চলে যাওয়া কর্মচারী রিপ্লেস করা হয়নি। অভ্যন্তরীণ রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখা হয়েছে। অবশ্য সব ক্ষেত্রে নয়। কিন্তু দ্রব্যমূল্যে ব্যাপক তারতম্য চোখে পড়ল না। থাকা-খাওয়া আগের মতোই সাশ্রয়ী। 

দেশি-সারস। ছবি: কাজী সানজিদ

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের আমরা তিনজন সিনিয়র সদস্য বিশদ পরিকল্পনা করে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে এক সপ্তাহ নেপাল ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেই। সদস্যরা হচ্ছেন- ড. নিয়াজ, জালাল আহমেদ ও আমি। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৭ নভেম্বর ঢাকা থেকে বাংলাদেশ বিমানে করে দুপুর নাগাদ কাঠমান্ডু ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে যাই। ফ্লাইটটি সোয়া ঘণ্টার। ঢাকা থেকে উড্ডয়নের আধা ঘণ্টা পরেই ডানদিকের জানালা দিয়ে হিমালয় পর্বতমালা দৃশ্যমান হতে থাকে। মখমলের মতো সাদা মেঘের ওপাশেই আরও শ্বেতশুভ্র হিমালয় রেঞ্জ পরিষ্কার দেখা যায়। মনে হয় জগতের সব শান্তি ও তৃপ্তি ওই বরফ টুপিওয়ালা বিশাল শিলাপুঞ্জে লুকিয়ে আছে। এ মনোহরি সৌন্দর্যের সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এ স্বর্গীয় দৃশ্যাবলি স্বচক্ষে দেখার জন্য নেপালে ভিড় জমান। 

বাংলাদেশে নেপালি দূতাবাস থেকে ভিসা নিয়ে যাওয়া যায়, আবার ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও অন অ্যারাইভাল ভিসার ব্যবস্থাও আছে। সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য বছরের প্রথম ভ্রমণটি ভিসা-ফি মুক্ত। বিমানবন্দরের প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সেরে বের হতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন নেই। বাইরে অপেক্ষমাণ ট্যাক্সি বা ভ্যানে করে সরাসরি হোটেলে চলে যেতে পারবেন। আগে থেকে হোটেল রুম রিজার্ভ করা থাকলে সুবিধা। কাঠমান্ডুর থামেল এলাকাতেই বেশিরভাগ হোটেল অবস্থিত। সেখানে প্রতি রাতে ১৫ ডলার থেকে ৩০০ ডলার পর্যন্ত হোটেল আছে। ১৫ বা ২০ ডলারের হোটেল মোটেই ফেলনা নয়। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রুম, সঙ্গে ওয়াশরুম আবার এসিও পাওয়া যেতে পারে। প্রতি হোটেলের ভেতরেই রেস্তোরাঁ আছে যাতে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পাওয়া যায়। এক হাজার নেপালি রুপিতে তিন বেলার খাবার ভালোভাবেই হয়ে যায়। হোটেলের নিজস্ব রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকলে কাছাকাছি অনেক ভোজনালয় আছে যেগুলোতে স্বচ্ছন্দে খাবার খাওয়া যায়। বাংলাদেশের ১০০ টাকা নেপালি ১২৩ রুপির সমান হয়।

 লালঘাড় কাস্তেচরা। ছবি: কাজী সানজিদ

থামেলে আমরা থেকেছি টিবেট গেস্ট হাউস নামের একটি মধ্যম মানের হোটেলে। ৭ নভেম্বর বাকি দিনটি থামেল এলাকাতেই কাটিয়ে দেই। পরিকল্পনা হয় পরদিন ভোর বেলা আমরা গাইড শংকর তিওয়ারির সঙ্গে ফুলচৌকি পাহাড়ে পাখি দেখতে যাব। সে অনুযায়ী খুব ভোরে শংকর একটি গাড়ি নিয়ে হোটেলে চলে আসেন এবং আমরা দেরি না করে তার সঙ্গে বেরিয়ে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছে যাই। দিনটি ছিল কিছুটা মেঘলা, তারপরও বেশ কিছু পাহাড়ি পাখির দেখা মিলল। তাদের মধ্যে ছিল- নীল-শিশ্দামা, বড়-বসন্ত, কালা-মথুরা এবং কিছু পাহাড়ি ছাতারে। আমরা ধীরে ধীরে পাহাড়টির চূড়ায় উঠে যাই। সেটির উচ্চতা প্রায় ২৮০০ মিটার। সেখানে দাঁড়িয়ে মিলল এক অপরূপ নিসর্গের দেখা। হিমালয়ের তিনটি সুউচ্চ শৃঙ্গ গণেশ হিমাল, ল্যাংট্যাং হিমাল এবং অন্নপূর্ণা। সবগুলো শৃঙ্গই ৭ হাজার মিটারের উপর। সাধারণত শীতকালে আকাশ পরিষ্কার থাকায় শৃঙ্গগুলো দেখা যায়। অন্য ঋতুতে মেঘের উপস্থিতির কারণে এই মনভোলানো প্রকৃতি উপভোগ করা যায় না। ফুলচৌকির চূড়ায় আমরা সঙ্গে নিয়ে আসা নাশতা সেরে নেই। এরপর শুরু হয় চূড়া থেকে অবতরণ, এবারও বেশ কিছু স্থানীয় পাখির দেখা মিলল। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, এই আরোহণ ও অবতরণের জন্য ফোর হুইল ড্রাইভ জিপ হচ্ছে একমাত্র বাহন, সেডান নিয়ে এই ভ্রমণ সম্ভব নয়। আমাদের সঙ্গে ছিল একটি মাহিন্দ্র স্করপিয়ন। দুপুর ১২টার দিকে ফুলচৌকির পাদদেশে নেমে চা পান করে আমরা চিতওয়ানের উদ্দেশে রওনা দেই।

আইবিসবিল। ছবি: কাজী সানজিদ

চিতওয়ান ন্যাশনাল পার্ক নেপালের অন্যতম সেরা ও বিখ্যাত সংরক্ষিত বনাঞ্চল। আমরা সেই বনে সাফারির উদ্দেশে চিতওয়ান যাই। দুপুরে রওনা দিয়ে সন্ধ্যার একটু পরে গিয়ে পৌঁছাই এবং আগে থেকে ঠিক করে রাখা হোটেলে উঠি। একটু পরেই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন প্রধান গাইড রমেশ চৌধুরী এবং তিনি আমার পূর্বপরিচিত একজন অভিজ্ঞ গাইড। 

ফুলচৗকি চূড়া থেকে দেখা গণেশ হিমাল। ছবি: কাজী সানজিদ

সবুজ-শান্তিময় একটি স্থান চিতওয়ান। রাপ্তি নদীর পূর্ব পাড়ে ছোট শহর সাওরাহা এবং পর্যটকরা সেখানেই কোনো হোটেলে থাকেন। নদীটির উত্তর-পশ্চিম দিকে চিতওয়ান ন্যাশনাল পার্ক, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। ৯৫৩ বর্গকিলোমিটার জুড়ে এই সংরক্ষিত বনভূমি নিসর্গ পর্যবেক্ষকদের কাছে একটি অত্যন্ত প্রিয় জায়গা। চিরসবুজ এই বনটির শুধু গাছপালাগুলোই মন ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বনের ভিতর একেবেঁকে কাঁচা রাস্তা চলে গেছে। এ পথ ধরেই জিপে অথবা পায়ে হেঁটে সাফারির ব্যবস্থা আছে। তবে সঙ্গে অবশ্যই স্থানীয় গাইড থাকতে হবে। বনে আছে বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, এশীয় এক শিংওয়ালা গন্ডার, এশীয় হাতি, বন্য শুয়োর, বানর ও অনেক প্রজাতির পাখি। ৯ তারিখ সারাদিন আমরা জিপ সাফারির প্ল্যান করি। সে অনুযায়ী রমেশ লাঞ্চ প্যাকসহ সকাল বেলা উপস্থিত হয়ে যান। নদীর অপর পাড়ে গিয়ে একটি জিপ সারাদিনের জন্য রিজার্ভ করে আমরা রওনা দেই। প্রথম দিকে কুয়াশা থাকাতে তেমন কিছু দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না। তবে একটু পরেই দেখা দিল চিত্রা হরিণের একটি পাল। তাদের মধ্যে ছিল বেশ কয়েকটি পূর্ণ শিংওয়ালা পুরুষ ও অসংখ্য হরিণী। এরপর এলো পথ আলো করে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ময়ূর। এ ধরনের একটি পাখিকে সারাদিন দেখলেও তেষ্টা মেটে না। কিছুক্ষণ আমাদের ছবি তোলার সুযোগ দিয়ে সে উড়ে গেল। এরপর দেখা পেলাম- ফুলমাথা-টিয়া, গয়ার, লালঘাড়-কাস্তেচরা এবং রোদ পোহাতে থাকা একটি কুমির। পশুদের মধ্যে বেশ কাছ থেকে দেখলাম বুনো শুয়োর ও গন্ডার। তাদেরকে আক্রমণাত্মক মনে হয়নি। আমাদের গাড়ির বেশ কাছে একটি বাঘ অবস্থান করলেও ঘন বনের আড়ালে ছিল, তাই আমরা দেখতে পাইনি। সবশেষে আমাদের মন জুড়িয়ে দিল একটি অনিন্দ্যসুন্দর ছোট পাখি ঝুঁটিয়াল-চটক (Crested Bunting)। 

লাল বনমুরগি। ছবি: কাজী সানজিদ.

পরদিন ১০ নভেম্বর আমরা গেলাম চিতওয়ান শহরতলিতে। জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হওয়াতে ঘনবসতি চোখে পড়ল না। ফলে বেশ কিছু বিরল সৌন্দর্যের পাখি কাছ থেকে দেখা গেল। তাদের মধ্যে ছিল ময়ূরের ঝাঁক, 

লাল-বনমুরগির দল, ছোট-মদনটাক এবং কিছু ছোট পাখি। বেলা ১১টার দিকে খবর এলো, আমাদের একটি আরাধ্য প্রজাতি তার নির্দিষ্ট স্পটে উপস্থিত হয়েছে। ব্যস, আমরা সকালের ভ্রমণ গুটিয়ে নিয়ে শহরে চলে এলাম। সেখানে গাড়ি পরিবর্তন করে রওনা দিলাম হেটাউডার উদ্দেশে। চিতওয়ান থেকে সেখানে পৌঁছতে ঠিক এক ঘণ্টা লাগল। গাড়ি থেকে নেমে হাইকিং বুট পায়ে ছোট একটি মনোরম পাথুরে স্ট্রিম পার হলাম। স্বচ্ছ পানির সেই প্রবাহটি এসেছে দুপাহাড়ের মাঝ দিয়ে। দৃশ্যটি অভূতপূর্ব আখ্যা দিলেও অপ্রতুল বর্ণনা হয়ে যায়। গাইড রমেশ তার সহকারীকে সকালেই এখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সেই পাখিটি এসেছে কিনা কনফার্ম করার জন্য। তার কাছ থেকে খবর পেয়ে রমেশের সঙ্গে আমরা হেটাউডা গিয়েছিলাম। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এই পাখি সেখানে হাজির হয়। পাখিটির নাম আইবিসবিল। আমাদের দেশে দেখা যায় না। তাই বাংলা নাম নেই। অনিন্দ্যসুন্দর এই পাখিটি আকৃতিতে আমাদের দেশে শীতকালে দেখা সবুজপা’র মতো। তবে গায়ের রঙ ভিন্ন এবং ঠোঁটটি কাস্তেচরার মতো নিচের দিকে বাঁকানো। সে কারণেই এই নামকরণ। এই দুর্লভ পাখিটি দেখার পর সেখানে একটি মনোরম রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর চিতওয়ান ফিরে হোটেলে জিনিসপত্র রেখে আমি রমেশের সঙ্গে বের হয়ে যাই রাপ্তি নদীতে সূর্যাস্ত দেখতে। সেখানে গিয়ে দূর থেকে খেয়াল করলাম, একটি বন্য গন্ডার নদী পার হয়ে শহরের দিকে যাচ্ছে। ভাবলাম ও হয়তো কিছুদূর গিয়ে জঙ্গলে ফিরে আসবে। 

ঝুঁটিয়াল চটক। ছবি: কাজী সানজিদ

তখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। হেঁটে হোটেলে ফিরে আসার পথে খেয়াল করলাম একটি বাড়িতে কিছু মানুষের সমাগম ও উত্তেজনা। রমেশ জানালেন, বুনো গন্ডারটি শহরে ঢুকেছে। ব্যস, সেখানেই চুম্বকের মতো আটকে গেলাম, পশুটিকেও দেখলাম। কয়েক মিনিট পরেই সে বের হয়ে রাতের আলোয় প্রধান সড়ক ধরে রাজকীয় ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করল। আশাপাশের যানবাহনের দিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, মানুষ তাকে দেখছে ঠিকই কিন্তু বিরক্ত করছে না। এ বিরল ও অভাবনীয় দৃশ্য বেশ কিছু সময় ধরে দেখলাম এবং ফোনে ছবি ও ভিডিও ধারণ করলাম। ভাগ্যকে গভীর কৃতজ্ঞতা জানালাম। কারণ এ ধরনের সৌভাগ্য খুব কম মানুষেরই হয়ে থাকে। রাতে সিদ্ধান্ত হলো, পরদিন ১১ নভেম্বর আমরা লুম্বিনি যাব। সে অনুযায়ী সকাল সকাল নাশতা সেরে, হোটেলের বিল মিটিয়ে রমেশের নিয়ে আসা চকচকে নতুন আরেকটি মাহিন্দ্র জিপে লুম্বিনি রওনা দিলাম।

সাওরাহা শহরে বন্য গন্ডার। ছবি: কাজী সানজিদ

লুম্বিনি পৌঁছতে আমাদের সাড়ে তিন ঘণ্টা লাগে। শহরটিতে পৌঁছে আমরা পাখি দেখার কাজে লেগে গেলাম। স্থানটি মনভোলানো বড় পাখি দেশি-সারসের (Saros Crane) জন্য প্রসিদ্ধ। চার বছর আগে এখানেই আমি এই পাখিটি দেখেছিলাম। রাজকীয় তার রূপ ও ভাবভঙ্গি। এদিকে দিনটি শুক্রবার হওয়ায় আরও কিছু ছোট পাখি দেখার পর রমেশ আমাদের স্থানীয় একটি মসজিদে নিয়ে গেল। সেখানে জুমার নামাজ সেরে আমরা নেপালের বিখ্যাত পাখিবিদ ড. হেমসাগর বড়ালের রিসোর্টে গিয়ে উঠলাম। লুম্বিনিতে কেউ বেড়াতে গেলে থাকার জন্য আমি এই রিসোর্টটিই সাজেস্ট করব। রেট সাধারণের চেয়ে একটু বেশি হলেও এমন 

হেটাউডা নিসর্গ। ছবি: কাজী সানজিদ

প্রাকৃতিক পরিবেশঘেরা থাকার জায়গা বিরল। হোটেলে মালপত্র রেখে আমরা দ্রুত লাঞ্চ সেরে রওনা দিলাম গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান মায়াদেবী মন্দির দেখতে। শুধু এই মন্দিরটি দেখতে প্রতিবছর কয়েক হাজার পর্যটক এখানে আসেন। এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। মূল মন্দিরটির ভেতর বুদ্ধদেবের জন্ম নেওয়ার জায়গাটি চিহ্নিত করা আছে। সারি বেঁধে ভেতরে ঢোকা যায়, আমরাও গিয়েছিলাম। বেশ বড় এলাকা জুড়ে এর কম্পাউন্ড যার ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন দেশের তৈরি করে দেওয়া বেশ কয়েকটি বৌদ্ধমঠ। ২০২১ সালে কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশ দূতাবাস লুম্বিনি ডেভেলপমেন্ট ট্রাস্টের সঙ্গে সেখানে একটি মঠ তৈরি করে দিতে চুক্তিবদ্ধ হয়, যাতে করে এদেশের তীর্থযাত্রী বৌদ্ধরা সেখানে গিয়ে থাকতে পারেন। 

ময়ূর। ছবি: কাজী সানজিদ

পরদিন ১২ নভেম্বর ভোরে আমরা যাই জগদিশপুর তাল দেখতে। জলজ উদ্ভিদপূর্ণ এটি একটি বিশাল দীঘি। সেখানে শীতকালীন পরিযায়ী হাঁসের আগমন ঘটে। আমরা সেখানে টিকি-হাঁস ও পিয়াং-হাঁস দেখেছি। তখন পাখিরা সবেমাত্র আসা শুরু করেছে। তাই সংখ্যায় কম ছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা প্রধান সড়ক ধরে শহরের বিভিন্ন আবাদি জমি ও ক্ষেতখামারের পাশ দিয়ে ঘুরতে থাকি। তখন ক্ষেতগুলোতে বেশ কয়েকটি ছোট-মদনটাক ও দেশি-সারস জুটি দেখতে পাই ও মন ভরে ছবি তুলি। আমাদের চোখের সামনে একটি মদনটাক বড়সড় একটি সাপ গিলে খেল। বিকেলের মধ্যে পাখি দেখা শেষ করে আমরা লুম্বিনি বিমানবন্দর চলে যাই। সড়কপথের সময় ও ধকল এড়ানোর উদ্দেশ্যে আমরা ওই দিন সন্ধ্যায় বিমানে কাঠমান্ডু ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।

মদনটাক সাপ গিলে খাচ্ছে। ছবি: কাজী সানজিদ

সফরসঙ্গী ড. নিয়াজের কাজ থাকাতে তিনি পরদিন ১৩ নভেম্বর দেশে ফিরে যান। আমি আর জালাল আহমেদ নাশতা সেরে কাঠমান্ডুর দরবার স্কয়ারের হ্যান্ডিক্রাফটস মার্কেটে যাই টুকিটাকি কেনাকাটার জন্য। হোটেলে ফিরে লাঞ্চ করে আমরা চলে যাই সয়াম্ভুনাথ মন্দির, যেটি মাংকি টেম্পল নামেও পরিচিত। সেখান থেকে পুরো কাঠমান্ডু নগরী দেখা যায়। সেখানে উপস্থিত অসংখ্য বানরের জন্য এটিকে অনেকে মাংকি টেম্পল ডাকে। ভূমি থেকে ১৪০০ মিটার উঁচুতে এর অবস্থান। স্থানীয়রাসহ সেখানে প্রচুর ট্যুরিস্ট দেখলাম। বানরদের সঙ্গে মজা করা এবং তাদের বিভিন্ন দুষ্টুমি দেখতে বেশ লাগে। 

মায়াদেবী মন্দির। ছবি: কাজী সানজিদ

মাংকি টেম্পল দেখার মধ্য দিয়েই শেষ হয় আমাদের এবারের উপভোগ্য নেপাল ভ্রমণ। পরদিন ১৪ নভেম্বর বিমানের ফ্লাইটে ঢাকা ফিরে আসি। আজীবন মনে গেঁথে থাকবে এই ভ্রমণের স্মৃতি। বারবার ভ্রমণের স্পৃহাও এ অভিজ্ঞতা থেকেই আসবে বলে মনে হয়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh