বোস কেবিন, ইতিহাসের স্মৃতিকথা

এহসান হায়দার

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৩, ১২:৫২ পিএম

বোস কেবিন। ছবি: সংগৃহীত

বোস কেবিন। ছবি: সংগৃহীত

নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত বোস কেবিনের নাম সকলের মুখে মুখে বহুদিন ধরে ঘুরে আসছে। একজন থেকে আরেকজন, এভাবে বহুজনের গল্পে-কথায় বোস কেবিনের নামের সঙ্গে পরিচিত হয়। এ তো গেল দূরের মানুষদের গল্প। খোদ  নারায়ণগঞ্জের মানুষেরা কী বলেন বোস কেবিন সম্পর্কে, সে গল্পও বেশ জমাট।

চাষাঢ়া অঞ্চলের বাসিন্দা হরিমোহন গাঙ্গুলী, বয়স ৭৩ বছর। সুধীজন পাঠাগার থেকে খবরের কাগজ পড়ে বের হচ্ছিলেন। বোস কেবিনের কথা পাড়তেই, একগাল হেসে বলেন-বোস কেবিনে একবার যে আসে, প্রেমে পড়ে যায় এ কেবিনের। আজ থেকে ৩০ বছর আগে প্রথম ঢুকেছিলাম এখানে। তারপর থেকে নিয়মিত আমি এই কেবিনের বাসিন্দা। সকাল-বিকাল একবার যেতেই হয়। না গেলে মনে হয় কী যেন নাই। 

নারায়ণগঞ্জের শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস ও রাজনৈতিক ঘটনাবলির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত বোস কেবিন। প্রায় একশ বছর আগে নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশনের অদূরে প্রতিষ্ঠিত এই বোস কেবিনের শুরুতে নাম ছিল ‘ব্যানার্জি কেবিন’। কিন্তু পরে এর নাম বদলে হয়ে যায় বোস কেবিন। কারও কারও মতে, আজকের বোস কেবিন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, বাঙালির প্রাণের মানুষ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নাম থেকে নেওয়া। তবে এ মত কতটা সঠিক, সে বিষয়ে যথেষ্ট যুক্তি নেই। উনিশ শতকের চল্লিশের দশক, ব্রিটিশরাজ তখন ভারতীয় উপমহাদেশ চষে বেড়াচ্ছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই প্রায় তাদের দখলে; আর দম লাগানো জীবন তখন বাঙালির। কোথাও নেই ঠাঁই, কাজ-কর্মে নেই স্বস্তি, শ্রমিকদের উপর অত্যাচার আর নিপীড়ন বেড়েই চলেছে। কিছু হলেই ব্রিটিশ পুলিশ পাকড়াও করে, নির্যাতন চালায়। 

বোস কেবিনের গল্প
৭ নভেম্বর, ১৯৩১ সাল। কলকাতা থেকে জাহাজে চেপে নারায়ণগঞ্জে এলেন অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রবাদপ্রতিম রাজনীতিবিদ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। জাহাজ থেকে নামতেই তাকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ, নারায়ণগঞ্জ থানায় নিয়ে বন্দি করে রাখে আট ঘণ্টা। নেতাজির ছিল চা পানের নেশা। যাকে বলে চায়ের ওস্তাদ, চা না হলে নেতাজি অস্থির হয়ে পড়েন। এই সময় বোস কেবিনের প্রতিষ্ঠাতা নৃপেন্দ্র চন্দ বোস, সকলের কাছে যিনি ভুলু বোস নামে পরিচিত, থানায় গিয়ে নেতাজিকে চা খাইয়ে তৃপ্ত করেছিলেন। চায়ের জন্য নেতাজি সেদিন তাকে প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন-লিকারটা না-কি বেশ ভালো, কড়া আর সুঘ্রাণে ভরা। 

এত ভালো লিকার কোথা থেকে আসে, কে জানে? তবে আজকের এই সময়ে এসে বোস কেবিন নিজেই একটা গল্প হয়ে গেছে। বোস কেবিনের ছোট্ট পেটে জমে রয়েছে জমাট গল্পের নগর, খরস্রোতা শীতলক্ষ্যা, মেঘনা থেকে ভেসে আসা গল্পও। কেননা গল্পরা কথা বলে। আর গঞ্জের গল্পের তো হাত-পা সবই থাকে। একদিন সেসকল গল্প হয়ে যায় ইতিহাস এবং নামজাদা। 

যেভাবে শুরু হয়েছিল 
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯২১ সাল। বিক্রমপুরে কুড়ি বছরের যুবক, নৃপেন বোস ডাক নাম ভুলু। এন্ট্রান্স পাস করে একদমই চাকরির চেষ্টা করলেন না তিনি। সেকালে এন্ট্রান্স পাস মানে একেবারে পোয়াবারো। গাঁয়ে রীতিমতো ঢেড়ি পড়ে যায়, বাড়ির ছেলে কিংবা পাড়ার ছেলে পাস করলে। কারণটা তো একটিই-পড়ালেখার যে প্রকৃত তাৎপর্য তা এখনকার দিনের থেকে একেবারেই ভিন্নতর ছিল। এন্ট্রান্স পাস ছেলে তখন সোনার টুকরোই বলা চলে, কারণ তখন পাস করা ছেলে-মেয়ে পাওয়া বড্ড মুশকিল ছিল। ফলে অনায়াসে চাকরি পাওয়ার সুযোগও কম ছিল না; কিন্তু ভুলু তা করেননি। নিজের মতো করে দাঁড়াতে চাইলেন। কেননা ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহটা তারও। বাড়ি ছেড়ে ঢাকা এলেন ভুলু। নারায়ণগঞ্জ তখন ঢাকা জেলারই অংশ এবং এ অঞ্চলের ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র। ভুলুর কাকা ছিলেন এখানকার জেলার। নারায়ণগঞ্জের আজকের বন্দর উপজেলা তখন খুব জমজমাট। কলকাতার সঙ্গে ছিল সরাসরি যোগাযোগ। শীতলক্ষ্যার তীরে গড়ে ওঠা ছোট্ট ব্যবসাকেন্দ্র ভালো লেগে গেল নৃপেন চন্দ্র বোস ওরফে ভুলু বাবুর। কাছের রেলস্টেশনের পাশেই ছিল ব্যানার্জি কেবিন। ছোট্ট টং ঘরের মতো দেখতে। ব্যবসায় লাভের মুখ দেখতে না পারায় সেটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। কেবিনটির দায়িত্ব নেন নৃপেন চন্দ্র বোস ভুলু। ছোট দোকানে তখন শুধু ২ ধরনের চা ও লাঠি বিস্কুট মিলত। দার্জিলিং ও আসামের চায়ের মিশ্রণে কড়া লিকারের চা তৈরি করতেন তিনি। অল্প দিনের মধ্যে ভুলুর চায়ের লিকারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। সেই সঙ্গে জমতে থাকল ভিড়ও। 

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও বোস কেবিন
সময় ছিল তখন ব্রিটিশরাজের। কোথায় কী হচ্ছে সারাক্ষণ তদারকি চলত। সে বড় উত্তাল সময়। সারা বাংলায় তরুণেরা দলে দলে সমর্থক হয়ে উঠছে গোপন দলের। দেশপ্রেমের আবেগের কারও কমতি নেই সেকালে। যুবকের দল এমনই-সুযোগ পেলে যেন ছোবল দেবে বেনিয়া শত্রু-তস্করদের। নৃপেন বোসও ছিলেন এই সময়ের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। তিনিও এই স্বাধীনতাকামী সমর্থকদের একজন। তিনি তো চাকরির চেষ্টাই করেননি কেবল ব্রিটিশদের ঘেন্না করেন বলে। ফলে এ অঞ্চলের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া তরুণদের সম্মেলনের স্থানে পরিণত হয় তার বোস কেবিন। চা ব্যবসার পাশাপাশি বিপ্লবীদের চিঠি চালাচালির কাজেও সহায়তা করতে থাকেন নৃপেন বোস। 

ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য
নিতান্ত সহজ সাধারণ এই বোস কেবিন অসংখ্য ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শত বছর ধরে। মালিক বদলে এখন বোস কেবিন নৃপেন বাবুর তৃতীয় প্রজন্ম পরিচালনা করছেন। সময়ের সঙ্গে বোস কেবিনের খাবার তালিকায় যুক্ত হয় কিছু নতুন খাবার। ১৯৮৮ সালে ফুলপট্টি থেকে বোস কেবিন নারায়ণগঞ্জের ১ ও ২ নম্বর রেলগেটের সনাতন পাল লেনে স্থানান্তর হয়, নামও খানিকটা বদলে যায়-দ্য বোস কেবিন হয়ে যায় ‘নিউ বোস কেবিন’। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনসহ এদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় বোস কেবিন হয়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের প্রধান ক্ষেত্র। তখনকার দিনে নেতাকর্মীরা এখানে এসে চা খেত যেমন, ঠিক তেমনি তাদের আন্দোলনকে বেগবান করতে গোপন মিটিংটা এখানেই সেরে নিত। 

আমাদের যে সকল নেতা আজ জাতির গর্ব এবং অহংকার তাদেরও অধিকাংশ নেতার পদধূলিতে পূর্ণ হয়ে আছে বোস কেবিন। একদা বোস কেবিনের চায়ের স্বাদ নিয়েছেন বাংলার বাঘা বাঘা নেতা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো দেশপ্রিয়রা রয়েছেন এ তালিকার শীর্ষে। হাল আমলের নেতা-কর্মী এবং চিত্রকর, কবি, ঔপন্যাসিক, শিল্পী, অভিনেতা, অভিনেত্রীরাও কেউ যেন বাদ যাননি। আশির দশকে ছোটকাগজ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা ‘অনিন্দ্য’ সম্পাদক হাবিব ওয়াহিদ শিবলীর সঙ্গে আড্ডায় উঠে আসে তার পুরনো দিনের স্মৃতিভারাতুর স্বজনেরা। তিনি বলেন, “ঢাকা থেকে বন্ধুরা মিলে ছুটির দিনে যেতাম বোস কেবিনে। একটা কাটলেট হয় ওখানে, একেবারে সেই রকম স্বাদ। আর চায়ের লিকার হলো ১ নম্বর। তখন ছোটকাগজ করতাম। কে যেত না বোস কেবিনে? শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, সৈয়দ শামসুল হক, হেলাল হাফিজ, হুমায়ুন ফরীদি, নির্মলেন্দু গুণ, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, আফসার আহমদসহ অসংখ্য তরুণ কবি-লেখক আর আর্টিস্ট হাজির হতো সেখানে।” সেই ছোট্ট বোস কেবিন যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেকালে এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, তার ছিটেফোঁটাও হয়তো ভাবেননি নৃপেন বাবু শুরুতে। তিনি কেবল তার কাজটিই করে গেছেন, এতকাল পর আজ একটি ইতিহাস হয়ে গেছে বোস কেবিন, যার রয়েছে নিজেরই গল্প।

বোস কেবিনে যত্ন-আত্তি
বোস কেবিনের খাবার কথাটি অনেকেই লিখবেন লেখক-সাংবাদিক দল, আমি লিখছি বোস কেবিনে যত্ন-আত্তি। কারণ বোস কেবিন এখন শত বছরের স্মৃতি স্মারক হয়ে উঠেছে। সেজন্য এটি আর এখন কেবল চা-জল খাবারের দোকান নয়, সংস্কৃতি নির্মাণের একটি আঁতুড়ঘর। নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের শিল্প-সংস্কৃতি আর শত বছরের ছায়া-মায়া জড়ানো হাজারো গল্প এর সঙ্গে মিশে রয়েছে, যা প্রতিদিনের চায়ের কাপে কাপে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বাংলাদেশে। ফলে এখানকার খাবারের মেন্যু না বলে-বলি বোস কেবিনের যত্ন-আত্তি। ভোরে এলে এখানে পেটে জামিন দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ সময় পাওয়া যায় গরম গরম পরোটা, সঙ্গে ডাল আর হালুয়া। ডিমের ৬ রকমের পদ ছাড়াও খাসি ও মুরগির মাংস। দুপুর ১২টা থেকে আবার পাওয়া যায় আলুর চপ, মোরগ পোলাও, কারি, মাটন কাটলেট এবং চিকেন ফ্রাই। তবে এখানে দুপুরে ভাত পাওয়া যাবে না। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে বোস কেবিন। শুরু থেকেই এই নিয়মে চলছে, কী উৎসব-কী ছুটি। আর একটা কথা, যে কারণে এত বিখ্যাত এই বোস কেবিন-তা হলো চা। যে চা পান করে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু প্রশংসা করেছিলেন, কড়া লিকারের সেই চা বড় কাপে পান করতে পারবেন অনায়াসে। সবসময় এখানে চা পাওয়া যায়। অনেকে আবার এখানে আসেন কেবল কাটলেটের স্বাদ নিতে। বোস কেবিনের কাটলেট এক কথায় অসাধারণ। 

নৃপেন বাবুর জীবদ্দশায় তার মেজো পুত্র রবীন্দ্র চন্দ্র বোস আর এখন নাতি তারক বোস এর হাল ধরেছেন। বোস কেবিন নিয়ে আলোচনায় কেবিনের ব্যবস্থাপক বলেন-এত দিনের পুরনো প্রতিষ্ঠান কখনো মানের ক্ষেত্রে আপস করেনি, সামনেও করবে না। একটা সময় আশি-নব্বইয়ের দশকে দিনে ২০-২৫ কেজি চা পাতা লাগত। এখনো এর পরিমাণ ৭-৮ কেজি। আগের চেয়ে চা কম খায় লোকজন। আমরা চেষ্টা করব নিজেদের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখতে।

পরিশেষে এমনি করে একটি যুগ চলে যায়, চলে যায় বসন্ত বিকেল, তারপর আসে ফের আরেকটি রাত...

বিষণ্ণ অন্ধকার এবং ইতিহাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের লড়াই আবারও। হয়তো বোস কেবিনও সেই ইতিহাসের ক্যানভাসে রয়ে যাবে এমনি করে চায়ের আড্ডায়, গল্পে গল্পে। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh