আজাদ খান ভাসানী
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:২০ এএম | আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০২:১২ পিএম
আজাদ খান ভাসানী
গত ২২ জানুয়ারি ছিল মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৫১তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭২ সালের এই দিনে তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন শেষে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
এ প্রসঙ্গে অনেকেই আমার কাছ থেকে ‘একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ভারতে অবস্থানরত মওলানা ভাসানী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে আসামে বসবাস করার জন্য জমি চেয়েছিলেন’ বলে যে প্রচারণা রয়েছে, সে সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন।
উপরন্তু সৈয়দ ইরফানুল বারী সম্পাদিত ‘ভাসানী সমীপে’ বইয়ে এ সম্পর্কিত একটি চিঠি প্রকাশিত হওয়ায় প্রশ্নটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এর একটি ভালো দিকও রয়েছে বটে। আলোচনা সমালোচনায় সত্য শুধু উন্মোচিতই হয় না, ইতিহাসও সমৃদ্ধ হয়।
মওলানা ভাসানী সম্পর্কে যারা কিঞ্চিৎ ধারণা রাখেন, নিশ্চয়ই তারা তার সাদামাটা অনাড়ম্বর জীবনযাপন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছেন। তাই ব্যক্তিজীবনে তিনি আরাম-আয়েশ বা ভোগ-বিলাসের জন্য আসামে জমি ক্রয় করতে চাইবেন কিংবা ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বসবাস করার জন্য জমি চাইবেন, একথা বিবেকবোধ সম্পন্ন কোনো কট্টর ভাসানী সমালোচককেও বিশ্বাস করানো যাবে বলে আমার মনে হয় না।
কেবল রাজনৈতিক কিংবা মতভিন্নতার কারণে ব্যক্তি আক্রমণ কিংবা চরিত্র হননের জন্য হলে ভিন্ন কথা! কারণ তাকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনা যা-ই থাকুক না কেন তার ছিয়ানব্বই বছরের জীবনকালে নিরলস ত্যাগ, সংগ্রাম আর মজলুম মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা সর্বজন বিদিত। সারা জীবন যিনি নিজের বাড়িঘর নিয়ে চরম ঔদাসীন্য দেখিয়েছেন, শেষ বয়সে তিনি আরাম-আয়েশে কাটানোর জন্য আসামে জমি চাইবেন বিষয়টি এত সাদামাটাভাবে বিশ্বাস করাতে চাইলে বিশ্বাসের কার্যকারণ নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে।
চাইলে তিনি তো স্বাধীন বাংলাদেশে তার প্রিয় শিষ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে তা চাইতে পারতেন। শেখ মুজিবও তার গুরু মওলানা ভাসানীকে তা দিতে পারলে ধন্য হতেন। এছাড়া তার ভক্ত অনুসারীদের মাঝে ভূস্বামী, অর্থ-বিত্তবানের অভাব ছিল না। জমি-জমা ভোগ-বিলাসিতা এই মহান নেতার লক্ষ্য ছিল না, এ কথা কার না জানা।
তাহলে আসামে মওলানা ভাসানীর জমি ক্রয় বা বসত করতে চাওয়ার পেছনে দুটি কারণ থাকতে পারে বলে আমার মনে হয়। প্রথমত রাজনৈতিক, দ্বিতীয়ত আসামের বাঙালি অভিবাসীদের প্রতি তার অপার ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা।
প্রথমত, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিলের মাঝামাঝি মওলানা ভাসানী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এখানে তিনি ভারতীয় বাহিনীর কাছে অন্তরীণ হয়ে পড়েন। এরপর কলকাতা, দিল্লি, দেরাদুনে ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তাকে যেন আসামে থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়।
কিন্তু ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার নিশ্চয়ই ১৯৪৭ সালের কথা মনে রেখে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরে আসেনি। তখনো কংগ্রেসের বিরোধিতার কারণেই মওলানা ভাসানীর চাওয়া সত্ত্বেও আসামের কিয়দংশ বাংলার অংশ হতে পারেনি। আসামে তার দুর্গ থাকা নিয়ে নিঃসন্দেহে ভারত সরকার এ ব্যাপারে কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি।
সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে তিনি তার শিষ্য মানিকউদ্দিন সরকারকে আসামে বসবাস করার জন্য জমি ক্রয় করার কথা জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন (ভাসানী সমীপে, পৃষ্ঠা-১০১)। এরপর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে পরপর দুটি চিঠি লিখেছিলেন।
এ সময় দিল্লিতে অবস্থানরত মওলানা ভাসানী আঁচ করেছিলেন কি ভারত সরকার নানা অজুহাতে তাকে তার নিজ দেশে ফেরাটা বিলম্বিত অথবা অনিশ্চিত করতে পারে? তিনি তখন তার ক্রয় করতে চাওয়া জমিকে সামনে এনে আসামে থেকে যেতে চেয়েছিলেন কি?
প্রসঙ্গত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে লন্ডন-দিল্লি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারলেও মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরতে মওলানা ভাসানীকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ভারত সরকারের কাছে বঙ্গবন্ধুর পাঠানো টেলিগ্রামে সবুজ সংকেত পেয়ে তিনি দিল্লি থেকে সেনা প্রহরায় তার প্রিয় আসাম হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন।
দ্বিতীয়ত মওলানা ভাসানীকে বুঝতে হলে তার আসাম অধ্যায় বোঝাটা জরুরি। আসামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তার হাজারো উপাখ্যান। এই আসামের ধুবরী জেলার আদাবাড়িতে রয়েছে তার ওয়াকফ্কৃত ‘হামিদাবাদ ওয়াকফ্ স্টেট’। যার সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৯৩২ বিঘা। সেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি তার বসতভিটাও রয়েছে।
আর এসব দেখভালের জন্য একজন করে মোতোওয়াল্লি ও প্রেসিডেন্ট রয়েছে। চাইলে নিঃসন্দেহে তার চেয়ে ভালো মোতোওয়াল্লি/প্রেসিডেন্ট কেউ হতে পারতেন না। অথচ ভাসানীকে যারা রাজনৈতিক বা আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে ভয় পায়, সত্য মিথ্যা না জেনে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তিনি আসামে জমি-বাড়ি চেয়েছিলেন বলে ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চায়।
মওলানা ভাসানী প্রায়ই বলতেন, আসাম আমাকে টানে। আসামকে তিনি তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করতেন। তাই একাত্তরের শেষ দিকে বাংলাদেশ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, সেই সময় তিনি তার প্রিয় আসামের ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষের কথা নতুন করে ভেবেছিলেন কি?
তিনি কি নতুন ইতিহাসের ডাকে সাড়া দিয়ে আসামের মজলুম মানুষের পাশে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে বসবাসের স্বীকৃতি স্বরূপ ভারত সরকারের কাছে জমি-বাড়ি চেয়েছিলেন? এই মানুষগুলোই যে একদা তাকে আবদুল হামিদ খান থেকে ‘মওলানা ভাসানী’ বানিয়েছিলেন।
সেই দায়বদ্ধতা আজীবন তাকে দংশন করেছে। তাই তো শেষ বিদায়কালে তিনি তাদের বলেছিলেন, ‘মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থেকো।’ এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে আর কটা আছে, বলতে পারেন?
লেখক- প্রকল্প সমন্বয়ক, ভাসানী গবেষণা প্রকল্প