টেকনোলজিস্ট সংকটে হাসপাতালগুলো
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:২৪ এএম
ছবি: সংগৃহীত
করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বগতি- এমন পরিস্থিতিতে আবারও দেখা দিয়েছে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের তীব্র সংকট। জনবলের অভাবে নমুনা পরীক্ষা ও রিপোর্ট দিতে দেরি হচ্ছে। সূত্র মতে, প্রয়োজনের মাত্র দেড় শতাংশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দিয়ে কাজ চলছে। অথচ বেকার বসে আছেন ২৫ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। জনবল নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হলেও, দুর্নীতির কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। এ দিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
দেশে করোনার নমুনা পরীক্ষা হওয়া একাধিক হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের মতে, মেডিকেল টেকনোলজিস্টের অভাবে ঠিকমতো নমুনা পরীক্ষা এবং সময় মতো পরীক্ষার রিপোর্ট দিতে পারছেন না। যা কি-না এই ঊর্ধ্বগতির সময়ে অত্যন্ত প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেডিকেল টেকনোলজিস্টের সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। গত দুই বছরের মহামারিতে প্রথম যখন সংক্রমণের ঢেউ আসে, তখন সেটা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। এমনিতেই সংকট রয়েছে, সেইসঙ্গে প্রতিটি ল্যাবে একাধিক টেকনোলজিস্ট করোনাতে আক্রান্ত হয়ে যখন আইসোলেশনে যায়, তখন সেই সংকটের তীব্রতা হয় ভয়ঙ্কর।
বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা বলছে, একজন চিকিৎসকের বিপরীতে পাঁচ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকতে হবে। সে হিসাবে দেশে এখন প্রয়োজন ১ লাখের বেশি টেকনোলজিস্ট; কিন্তু বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে টেকনোলজিস্টের পদ রয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৯২০টি, কর্মরত আছেন ৫ হাজার ১৬৫ জন।
দীর্ঘ ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত থাকায় মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ঘাটতি আছে। করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের বিষয়টি আবার সামনে আসে। করোনার নমুনা সংগ্রহ ও ল্যাবরেটরি বাড়ানোর ফলে সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের দাবি উঠে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩ হাজার টেকনোলজিস্ট নিয়োগের নির্দেশ দেন। সে মোতাবেক ২০২০ সালের ২৯ জুন মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ৮৮৯টি, মেডিকেল টেকনিশিয়ানদের ১ হাজার ৬৫০টি, কার্ডিওগ্রাফার পদে ১৫০ জনসহ মোট ২ হাজার ৬৮৯টি পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
পরে লিখিত পরীক্ষায় ২৩ হাজার ৫২২ জন অংশ নিয়ে উত্তীর্ণের মধ্যে থেকে মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় পরের বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি; কিন্তু সেই নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম ও ঘুষের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২০ সেপ্টম্বর ২ হাজার ৮০০ পদের সেই নিয়োগ বাতিল করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরপর গত ২৮ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নতুন এক অফিস নির্দেশনায় জানায়, ২০ সেপ্টেম্বরের নির্দেশনার আলোকে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান ও কার্ডিওগ্রাফার পদে চলমান জনবল নিয়োগের কার্যক্রম বাতিল করা হলো। পুনরায় নতুন নিয়োগে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। ইতিপূর্বে যারা আবেদন করেছেন, তাদের নতুনভাবে আবেদনের প্রয়োজন নেই; তারা নতুন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। পরে সে নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল চেয়ে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বলেন, জনবল কম হওয়ার কারণে তাদের একেকজনকে দ্বিগুণ, কখনো তারও বেশি কাজ করতে হচ্ছে; কিন্তু তাতেও দিনের কাজ দিনে শেষ করা যাচ্ছে না। নমুনা সংগ্রহের জন্য অনেক বাসাতেই তারা নির্ধারিত দিনে যেতে পারছেন না। অথচ দেশে এখন প্রায় ২৫ হাজারের মতো মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বেকার বসে আছেন। তাদের কাজে লাগাতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা বলেন, যখন নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কম থাকে, তখন অসুবিধা হয় না; কিন্তু যখন এরকম ঊর্ধ্বগতি হয়, তখন খুব সমস্যা হয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের স্যাম্পল প্রসিডিউর অন্যান্য জায়গার তুলনায় ভিন্নরকম জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এখানে অনেক স্পট রয়েছে স্যাম্পল কালেকশনের জন্য। যেমন চিকিৎসকদের জন্য, নার্সসহ টেকনোলজিস্টদের জন্য, বহির্বিভাগ, বার্ন ইউনিট, কোভিড এবং নন- কোভিড ইউনিটের মতো পৃথক জায়গায় স্যাম্পল কালেকশনের জন্য টেকনিশিয়ানরা গিয়ে থাকেন। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রে একটি জায়গাতেই ৪০ থেকে ৫০টি নমুনা নিতে হয়; কিন্তু একজনের পক্ষে সীমিত সময়ের মধ্যে এত নমুনা নেওয়া আসলেই খুব কঠিন।
আবার ল্যাবের ভেতরেও চিকিৎসকরা সাংঘাতিক সংকটময় সময় পার করছে মন্তব্য করে ডা. নুসরাত সুলতানা বলেন, স্যাম্পল আনার পর থেকে পুরো প্রক্রিয়ায় চিকিৎসকদের সাহায্য করার মতো টেকনোলজিস্টের খুবই অভাব। তারা নমুনা নেবে না-কি ভেতরে কাজ করবেন? এই মুহূর্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের ল্যাবে ডেপুটেশন, দিনভিত্তিক চুক্তিসহ বিভিন্নভাবে নিয়োগ করা ১৩ জনের মতো কাজ করছেন, যেখানে এখন দরকার নিদেনপক্ষে ২০ জন। তারাও রোস্টারভিত্তিক কাজ করেন। আর যখন কেউ করোনায় আক্রান্ত হন, তিনি আইসোলেশনে চলে যান; তখন পরিস্থিতি আরও সংকটপূর্ণ হয়ে উঠে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, করোনাকালে ফ্রন্টলাইনারদের মধ্যে ফ্রন্টলাইনার হচ্ছেন নার্স আর মেডিকেল টেকনোলজিস্ট। কারণ তারাই রোগীর সংস্পর্শে বেশি যান। তাই তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে।
তার নিজের ল্যাবে করা ব্যক্তিগত এক গবেষণার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের মধ্যেই আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। অনেকেই একবার থেকে একাধিকবার, এমনকি তৃতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছেন। গত এক সপ্তাহেই আমার ল্যাবে তিন জন টেকনিশিয়ান পজিটিভ হয়েছেন, তাদের কাজগুলো কীভাবে হবে, কে করবে? স্বাভাবিক সময়ে কোনো রকমে কাজ চালিয়ে নেওয়া গেলেও সংক্রমণের যখন ঊর্ধ্বগতি হয়, তখন পরিস্থিতি খুবই সংকটময় আর কঠিন হয়ে পড়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একদিকে কাজের চাপ বাড়ে, আরেকদিকে লোক কমে যায়।
গত একযুগেরও বেশি সময় ধরে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না জানিয়ে ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, করোনার কারণে সে প্রক্রিয়া শুরু হলেও দুর্নীতির কারণে সেটা বাতিল হয়ে গেল। তবে একটা দ্রুততম সময়ের মধ্যে পরীক্ষানিয়ে নিয়োগ ক্রিয়া সম্পন্ন করা দরকার। আগে থেকেই সংকট; তার ওপর হাজার হাজার টেকনোলজিস্ট পাস করে বসে আছেন, অথচ এই কঠিন সময়ে তাদেরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
বেকার অ্যান্ড প্রাইভেট সার্ভিসেস মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, দেশে যেভাবে টেস্ট দরকার এই করোনার সময়ে, সেভাবে কখনোই টেস্ট হয়নি। আর এর একমাত্র কারণ হচ্ছে পর্যাপ্ত মেডিকেল টেকনোলজিস্টের অভাব। সংকট আগে থেকে থাকলেও করোনা আসার পর তার প্রয়োজনীয়তা চোখের সামনে আসে। এরপর আমাদের আন্দোলনের কারণে এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ১ হাজার ২০০ পদ তৈরি করা হয়; কিন্তু পরীক্ষাসহ সবকিছুর পর দুর্নীতির কারণে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। অথচ করোনা মোকাবেলা করার জন্যই বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী আদেশে পদ তৈরি করে, নিয়োগ পরীক্ষা হয়। বলা হয়েছিল দ্রুততম সময়ে পরে আবার সার্কুলার দেওয়া হবে; কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। অথচ প্রায় ২৫ হাজার টেকনোলজিস্ট বেকার বসে রয়েছে। তাদের অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে হলেও, পরে পদ সৃষ্টি করে নিয়োগ দেওয়া যায়।