খন্দকার মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২১, ০৬:১৮ পিএম
বেশ দ্রুতগতিতেই উনবিংশ শতকে বাংলা শিশু-সাহিত্যের বিকাশ হয়েছিল। পাঠ্যপুস্তক, সাময়িকপত্র ও সৃজনশীল বই-পুস্তক হয়ে উঠেছিল শিশুসাহিত্যের বাহন। গোড়ার দিকে নীতিকথা ও অনুবাদনির্ভর হলেও ওই শতকের শেষভাগে এসে মৌলিক সাহিত্যসৃষ্টির ধারা বেগবান হয়। লেখক-প্রকাশক-মুদ্রণযন্ত্রের আনুকূল্য এক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল। লিপিধারা ও নীতিকথা (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগ) বাংলা শিশু-সাহিত্যের সূচনালগ্নের দুটি উল্লেখযোগ্য বই। প্রথমটি বর্ণমালা শিক্ষা ও দ্বিতীয়টি নীতিকথা শেখানোর বই ছিল। এগুলোর মধ্যে সাহিত্যসৃষ্টির কথা বিবেচনায় নিলে নীতিকথাকে অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে হয়।
এটির প্রথম ভাগ ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল এবং তখনো দৃশ্যপটে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন না, যাকে বাংলা শিশুসাহিত্যের আধুনিকায়নের অন্যতম পথিকৃৎ বলে গণ্য করা উচিত। শতাব্দীর শিশুসাহিত্য গ্রন্থে (পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ১৯৯৯) খগেন্দ্রনাথ মিত্র ১৮১৮ থেকে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিদ্যাসাগর পূর্ব ও কলকাতা স্কুল থেকে সোসাইটি যুগ, ১৮৪৭ থেকে ১৮৯১ পর্যন্ত বিদ্যাসাগর যুগ এবং ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিদ্যাসাগরোত্তর যুগের কালপূর্ব নির্ধারণ করেছেন। বিদ্যাসাগর যুগেই মধুসূদন দত্তের মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে মুক্ত সাহিত্যচর্চার সূচনা হয়। বিদ্যাসাগরোত্তর যুগেই যোগীন্দ্রনাথ সরকার, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ খ্যাতকীর্তির আবির্ভাব ঘটে। ঊনবিংশ শতকেই বাংলা শিশুসাহিত্যের গদ্য পরিপুষ্ট হয়েছিল এবং বিংশ শতকে এই ধারা আরও বেগবান হয়েছিল। তবে সাতচল্লিশের দেশবিভাগ পূর্বকাল পর্যন্ত তার প্রধান কেন্দ্র ছিল তখনকার বাংলার রাজধানী কলকাতা, যদিও ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গেও শিশুসাহিত্যের চর্চা চলমান ছিল।
পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় শিশু-সাহিত্যের চর্চা আগের চেয়ে অনেক বেশি ভালোভাবে শুরু হয়েছিল। তবে ষাটের দশকে এসে তা আরও পরিপুষ্ট হয়েছিল। এই পরিপুষ্টির উজ্জ্বল প্রমাণ আহসান হাবীব- এর রাণীখালের সাঁকো। ১৯৬৫ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। বক্তব্যের গভীরতার কারণে এটি একটি প্রশংসনীয় কাজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করার ক্ষেত্রে লেখক ছিলেন যত্নবান। সহজ ভাষা, বাক্যগঠনে দক্ষতা ও ঘটনার চিত্রকল্প আঁকার ক্ষেত্রে মুন্সীয়ানার বদৌলতে এবং এটিতে লেখকের নিজস্ব ভাষার পরিচয় পেয়ে পাঠক চমৎকৃত হয়েছিল।
আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫) তার চেনা শৈশবে ফিরে গিয়েছিলেন এ উপন্যাসের নায়কের শৈশব-কৈশরের চিত্রকল্প সৃষ্টির সময়। বর্তমান পিরোজপুর জেলার শঙ্করপাশায় কেটেছে তাঁর শৈশব। তবে সাহিত্যিক-সাংবাদিক হিসেবে দেশবিভাগ পূর্বকালের কলকাতাতেই তাঁর খ্যাতির সূচনা। সেই কলকাতা জীবনেই বিখ্যাত হাসির গল্প বোকা বকাই ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল বিখ্যাত পত্রিকার শিশু সওগাত-এ, ছোটদের যে বিখ্যাত পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দিন (১৮৮৮-১৯৯৪)। এটি গ্রন্থাকারেও বেরিয়েছিল। সেই বইয়ের গদ্য লিখেছিলেন মোহাম্মদ নাসির আলী (১৯১০-১৯৭৫) এবং ছড়া লিখেছিলেন আহসান হাবীব। বিখ্যাত শিল্পী কাজী আবুল কাশেম অলঙ্করণ করেছিলেন।
আহসান হাবীব এর শিশুসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে আছে ছড়া-কবিতা। ছুটির দিন দুপুরে, বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, রেলগাড়ি ঝমাঝম, পাখিরা ফিরে আসে- এই বইগুলো তারই উদাহরণ। তবে গদ্যের যে তিনি সিদ্ধহস্ত তার প্রমাণ রাণীখালের সাঁকো, হাট্টিম আর টিমটিম, হাজি বাবা। অবশ্য নানা কারণে রাণীখালের সাঁকো বিশেষ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। এখন এটি এদেশের কিশোর-সাহিত্যের একটি অমূল্য সৃষ্টিকর্ম বলে বিবেচিত হচ্ছে। আর এটি তো জানা কথাই যে, সাতচল্লিশ পরবর্তী ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যধারা বিকাশে যেসব সাহিত্য প্রতিভার মূল্যবান অবদান ছিল সেই তালিকা করতে গেলে অনিবার্যভাবে এসে যায় রাণীখালের সাঁকোরস্রষ্টা আহসান হাবীবের নাম। বইটিতে বেশ কিছু জায়গায় উপমার ব্যবহারও তিনি করেছেন।
তবে শিশু-কিশোরদের কল্পনার জগত থেকে সংগ্রহ করা উপমা ব্যবহারের পর তা কখনোই আরোপিত বলে মনে হয়নি। যেমন ঢাকায় আসার পর আশ্রয়হীন ‘আজীজ’ (উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র)- এর ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থা বোঝাতে গিয়ে যে বাক্যটি ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘একটা ভীষণ ভয় ভয় ভাব যেন চারদিক থেকে কালো বিরাট একটা দৈত্যের মত তাকে বারবার গিলতে এসেছে’। সাধারণভাবে উপন্যাসের বর্ণনা সহজ ভাষার; কিন্তু তাতে আলাদা একটি আকর্ষণ আছে। যেমন ঢাকা জীবনের সূচনাপূর্বে তার আশ্রয়দাতার সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে দেখা হবার বর্ণনা, যেখানে আছে- ‘আধবুড়ো লোক দেখতে তেমন সুশ্রী নয়- রোগা, কালো আর রুক্ষ তার চেহারা; কিন্তু হাসিটি ভারি সুন্দর’। রাণীখাল একটি খালের নাম। লেখকের বর্ণনানুযায়ী এ খালের অবস্থান বরিশাল জেলায় (এখন অবশ্য সেকালের সমান আয়তন নেই বরিশালের, সেই জেলাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছে পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ভোলা জেলা)।
খালের ধারের গ্রাম মতিজানের প্রেসিডেন্ট সেই খালে একটা সাঁকো গড়েছিলেন। বাপ-মা হারা মামা ও মামির সংসারে আশ্রয় পাওয়া নিরীহ ভদ্র স্কুল পড়ুয়া ছেলে ‘আজীজ’ ক্লাস শেষে ফেরার পথে প্রেসিডেন্টের ঔদ্ধত্য পুত্র জয়নালের আগে সাঁকোতে পা রাখায় লাঞ্ছিত হয়। এই ঘটনা তার মনে বিরাট প্রভাব ফেলে। অনেক আগে সংবাদপত্রে দেখা একটা বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত একটি ব্যায়াম সমিতির নাম তার মনে পড়ে যায়। সেখানে ভর্তি হয়ে দেহ গঠন করে ওই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞায় কাউকে না জানিয়ে ওই রাতেই গ্রাম ছাড়ে সে। নলবিলাশ বন্দরে গিয়ে মহাজনী নৌকায় ফাইফরমাশ খাটার চাকরি নিয়ে আট দিনের যাত্রা শেষে ঢাকায় পৌঁছে সে অবাক হয়ে গেল। শহরও যে এতবড় হতে পারে তা তার ধারণারও অতীত ছিল। ব্যায়াম সমিতির ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যত সহজ বলে ভেবেছিল তার চেয়ে ঢের কঠিন হলো। পদে পদে বিপদ এসে ছেঁকে ধরতে চাইল তাকে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত রহমানিয়া হোটেলের মালিক রহমান মিয়ার সঙ্গে তার পরিচয় হলো। স্ত্রী-সন্তানহারা রহমান মিয়ার কঠোর স্বভাবের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোমল পিতৃহৃদয় আজীজকে ভালোবাসা বিলিয়ে পরিতৃপ্ত হলো।
এরই এক পর্যায়ে আজীজকে তিনি বললেন, ‘ওরে নালায়েক তোর মতো সোনার ছেলের বাপ হওয়া কি যার তার কাজ রে।’ সেই রহমান মিয়ার সাহায্যে শহরে তার আশ্রয় জুটল, ব্যায়াম সমিতিতে সে ভর্তির সুযোগ পেল, এমনকি স্কুলেও ভর্তি হলো সে। ভালো ছেলে হিসেবে দ্রুত নামডাক ছড়িয়ে পড়ল তার; কিন্তু এরই মধ্যে অশনি সংকেত হিসেবে উদয় হলো রহমান মিয়ার দুরাচারী ভাইপো মন্তাজ। তার চক্রান্তে অনেক অনেক বিপদ হলো আজীজের। শেষ পর্যন্ত মন্তাজ তার চাচা রহমান মিয়াকে খুন করলে সন্দেহের বশে আজীজকেও ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। অবশ্য পরে সে ছাড়া পায়। জয়নালের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে এক রাতে গাঁয়ে ফেরে সে। ততদিনে সে সুগঠিত দেহের অধিকারী, মারধরের কলাকৌশলও অনেক শিখেছে। রাতের আঁধারে বাড়ি ফেরতা জয়নালকে রাণীখালের সাঁকোর গোড়ায় বাগে পায় সে; কিন্তু আত্মরক্ষার চেষ্টা করতেও রাজি না থাকায় জয়নালের ওপর কোনো প্রতিশোধ নিল না সে। এভাবে সে মহত্বের পরিচয় দিল।
সংক্ষেপে এই হলো রাণীখালের সাঁকোর কাহিনি। নানা কারণেই বাংলাদেশের কিশোর উপন্যাসের ক্ষেত্রে রাণীখালের সাঁকো স্মরণযোগ্য। এতে বাংলাদেশের গ্রামজীবন যেমন আছে, তেমনি আছে ঢাকা শহরের চিত্রও এবং সেই ঢাকা হলো পঞ্চাশের দশকের শেষভাগ ও ষাট দশকের গোড়ার দিকের ঢাকা। যেহেতু তখনো বাংলাদেশে সেভাবে নগরায়ন হয়নি তাই তখনকার পূর্ববঙ্গের শিশু-সাহিত্যে গ্রামজীবনের ছবি অপেক্ষাকৃত বেশি স্পষ্ট ছিল। সেই পটভূমিতে আহসান হাবীব যে ঢাকার চিত্র এঁকেছেন সেখানকার বাসিন্দাদের অনেকের জীবনের ফেলে আসা অংশটা ছিল গ্রামে। রহমান মিয়া এ উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এবং তিনিও এসেছেন গ্রাম থেকেই।
এ উপন্যাসে ঢাকার বর্ণনা দিয়ে আহসান হাবীব লিখেছেন ‘রাস্তা ভরতি মানুষ, দু’পাশে উঁচু উঁচু দালানকোঠা, তারই ফাঁকে ফাঁকে নানা রকম গাছপালা ও আর আছে ফুলের বাগান’। তাই এক্ষেত্রে ঔপন্যাসিকের কাল সচেতনতা স্পষ্ট। উপন্যাসটিতে বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। এও আমাদের শিশু-সাহিত্যে তখনো অভিনব। তাই এটি যে বাংলাদেশের নিজস্ব জীবন সমৃদ্ধ সাহিত্য তা খুব স্পষ্ট। বাড়ি পালানো কিশোরজীবন নিয়ে এর আগে শিবরাম চক্রবর্তী লিখেছেন ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’।
পরে আল কামাল আবদুল ওহাব লিখেছেন ‘নিরুদ্দেশের পথে’; কিন্তু এগুলোর প্রতিটির গল্প ও পটভূমি আলাদা হওয়ায় প্রতিটিই আপন বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে রেখেছে। তবে এই ধারায় বাংলাদেশের গ্রামজীবন থেকে ঢাকায় আসা কিশোরের দ্বন্দ্বমুখর জীবন নিয়ে লেখা এই উপন্যাসটি অবশ্যই পথিকৃতের মর্যাদা পাবার যোগ্য।