পুরুষতান্ত্রিক মিডিয়ায় শৃঙ্খলিত নারী

গাজী তানজিয়া

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২১, ০৮:৫৩ এএম | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২১, ০৯:২৯ এএম

যদিও মার্কিন মুলক থেকে এই উপমহাদেশ, সর্বত্র দ্বিতীয় তরঙ্গের নারীবাদকে লেজবিয়ানিজম বা ব্রা পোড়ানোর আন্দোলনগুলোর সাথে গুলিয়ে ফেলার একটা প্রবণতা দক্ষিণপন্থী বা প্রতিষ্ঠানবাদীদের মধ্যে আছে। 

অন্যদিকে বামপন্থীদের চোখে মধ্যবিত্ত নারীদের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন নেহাতই ছেলেমানুষী। কেননা তারা উপেক্ষা করে অসংখ্য দরিদ্র শ্রমজীবী নারীর আন্দোলনকে। তথাপি সময়ের প্রয়োজনে দ্বিতীয় তরঙ্গের আন্দোলনের গুরুত্ব উপেক্ষা করা যায় না।

আমাদের চারদিকে কীভাবে পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে পুরুষতান্ত্রিক কিছু ধ্যান-ধারণার আপাত সিদ্ধ জাল, এটা আধুনিক মিডিয়ায় নারীর উপস্থাপন না দেখলে বোঝা যাবে না। নারী আজ যখন তার নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা ও কৃতিত্বে উজ্জ্বল, তখনো মিডিয়ায় নারীর ধারণায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখা যায়। নারী তিনি হোন করপোরেট লিডার, রাজনৈতিক নেত্রী,  শিক্ষিকা, চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রকৌশলী বা অন্য যে কোনো শ্রেণি-পেশার, মিডিয়ায় আমরা তাকে পাই গুণের চেয়ে বেশি দর্শনধারী হিসেবে।

যেকোনো পেশার একজন নারী যখন নিজের রূপচর্চা করেন আয়নার সামনে বসে, তখন তিনি যে মুখকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে তোলেন- এটা কি তার নিজের মুখ?  নিজেকে সাজানোর ছলে নিজেকে সাজিয়ে তুলছে আসলে পুরুষের ভালোলাগার, আকর্ষণের, কামনা-বাসনার পুতুল বানিয়ে ফেলছে না তো! আর এটি করতে গিয়ে ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে নিজের মুখ? কাকে বলে প্রকৃত নারীত্ব আর কোনটি তার খোলস? নারীর নারীত্ব সে তো কলমের খোঁচায়, প্রভাবশালীর ফতোয়ায় হারিয়েছে বারবার। রয়ে গেছে নারীর আকারের এক কাঠামোয়। এখনো করপোরেট দুনিয়া তার প্রয়োজনে নারীকে ব্যবহার করে যাচ্ছে কখনো শ্রমিক, কখনো বা তাদের পণ্যের ক্রেতা- তথা টার্গেট অডিয়েন্স হিসেবে। 

পুরুষকেন্দ্রিক বিশ্ব ভাবনায় নারীকে নানাভাবে তার প্রয়োজনের সামগ্রী হিসেবে দাঁড় করানো হয়। পুরুষ যখন কেন্দ্রে তার দরকার হয় মা, স্ত্রী, বোন, কন্যা, সেবিকা, শিষ্য, উৎসাহদাত্রী ও প্রেরণাদাত্রী হিসেবে। সবটিই তার প্রয়োজনভিত্তিক নির্মাণ, যার সঙ্গে সঙ্গে চলে নির্মিত প্রাণীটি। 

বিনোদন মিডিয়ায় আধুনিক নারী কীভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে দেখা যাক। নাটক, সিনেমা, সিরিয়াল বা মেগা সিরিয়ালের নামে যা প্রচারিত হয়, সেখানে নারী থাকেন প্রধান চরিত্রে। তিনি চাকরি ও ব্যবসা করছেন এবং ঘর ও পরিবার সামলাচ্ছেন। আর তার সঙ্গী পুরুষ ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন,  কখনো বা অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়াচ্ছেন। এসব সম্পর্কে জড়ানো নিয়ে মোটা দাগে নারীকেই দায়ী করা হচ্ছে। আবার যৌথ পরিবারের ধারণাকে গ্লোরিফাই করতে গিয়ে ওই নারীকেই বলি দেয়া হচ্ছে। যে কিনা ঘরে-বাইরে দশভুজা। অথচ তার শেষ আশ্রয়স্থল তার স্বামী, সেখানেই তার স্বর্গ! 

১৮৭৯ সালে লেখা ইবসেনের বিখ্যাত নাটক ‘দ্য ডলস হাউস’- এ নোরা প্রশ্ন করে তার স্বামীকে- আমার সবচেয়ে পবিত্র দায়িত্ব বা কর্তব্য কী? উত্তর আসে স্বামী ও সংসারের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা। 

নোরা তখন প্রশ্ন তোলে না, আমার প্রথম কর্তব্য নিজের প্রতি নয় কেন? আমিও তো এক ব্যক্তি, এক মানুষ ঠিক তোমারই মতো। আমার স্বামী ও সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতা আমি স্বীকার করব; কিন্তু নিজের মূল্যে নয়। আমি জানি তুমি তোমার ওই বইগুলো পড়ে বলে দেবে কেন আমার প্রস্তাবনাগুলো সব ভুল; কিন্তু আমি তোমার কথার আর ওই বইগুলোর ধার ধারি না। আমি মানুষ, নিজের পথ আমাকে নিজেই খুঁজতে হবে। 

অবাক ব্যাপার হলো, এই শতকের মিডিয়ার নারীরাও তা বলে না। তারা বিয়েকে নারী নিরাপত্তার একটি মানদণ্ড হিসেবে এখনো ধরে বসে আছে। মূলত এই ধারণাকে লালন করছে পুরুষতান্ত্রিক মিডিয়াও।  

অথচ নারীবাদী লেখক জার্মেন গ্রিয়ার তার ‘দ্য ফিমেল ইউনাখ’ গ্রন্থে নারীর নিরাপত্তার মানদণ্ড হিসেবে বিয়েকে নাকচ করেছেন। আমাদের এই নিরাপত্তার ধারণা নিয়ে যে রহস্য তার তো অনেকটাই ‘ইনসিকিউর’। নিরাপত্তা বোধের অভাবে ভোগা বিশেষণটি যখন কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যা তার মধ্যের নিহিত দোষারোপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। যে নারীরা বিয়ে করেন না বা না করার সিদ্ধান্ত নেন, তাদের ধরে নেয়া হয় নিরাপত্তাকে তুচ্ছ করছেন। 

এরপর আসা যাক মিডিয়ায় প্রচারিত বিজ্ঞাপন বিষয়ে- নারী-পুরুষের প্রসাধন সামগ্রী বাদ দিলেও, যেকোনো বিজ্ঞাপনে বাধ্যতামূলকভাবে থাকবেন লালস্যময়ী একজন নারী। গাড়ির এক্সিবিশনে গাড়ির পাশে শরীরের সব ভাঁজ প্রকাশ করে দাঁড়িয়ে থাকবেন নারী। স্টেডিয়ামে খেলার ফাঁকে ফাঁকে নারীকেই লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চিয়ার আপ করতে হবে, নতুবা নাকি খেলাটি ঠিক জমে উঠবে না। আবার একই রকমভাবে নারীদের খেলায় কিন্তু পুরুষ চিয়ার লিডার আমরা দেখতে পাই না। 

যেকোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে সেক্সুয়ালি অবজেক্টিফাই করা হয় না! যতটা করা হয় নারীকে। উল্টো মজার ব্যাপার হলো, যাদের হাতে এই বিশাল ইন্ডাস্ট্রি তারাই ‘নারী স্বাধীনতা’, ‘নারী স্বাধীনতা’ বলে ব্যাপক মায়াকান্না করে। তার ওপরে হাতের নাগালেই আছে পর্নোগ্রাফির বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি- যা নারীকে ভোগ্যপণ্য ছাড়া আর কোনোভাবেই উপস্থাপন করে না। এর ফলে, একজন ছেলে শিশু যে কি-না এক সময় পুরুষ হয়ে উঠবে,  তার ভেতরে বদ্ধমূল হচ্ছে এই ধারণা যে, একজন নারীকে যেমন খুশি তেমনভাবে ভোগ উপভোগ করা যায়। সৃষ্টি হয় একটি ধর্ষকামী সমাজ, যার কারণে বেড়ে যায় নারীর প্রতি সহিংসতা। 

ভারতে কোর্টের দেয়া একটি রায়ের ভিত্তিতে এই উপমহাদেশে যখন ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’, ‘গ্লো অ্যান্ড লাভলি’ নাম নিয়ে তার বাণিজ্যিক পসার বজায় রাখতে তৎপর হয়, তখন আমাদের এটি ভাববার কোনো অবকাশ নেই যে, নারীর প্রতি পুরুষের বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কোনো বদল হবে। বরং নারী যতদিন প্রেজেন্টেবল থিং (প্রদর্শন বস্তু) হিসেবে পুরুষের কাছে উপস্থাপিত হওয়ার মনোবৃত্তি থেকে বের হয়ে আসতে না পারবে, বা সমাজ এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্তি না পাবে, ততদিন আক্ষরিক অর্থে নারীর মুক্তি ঘটবে না।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh