মশায় নাখোশ নগরবাসী

মাহমুদ সালেহীন খান

প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২১, ১২:৩৪ পিএম

রাজধানীর উত্তর সিটি করপোরেশনে বসবাস করেন তানজিরুল বাশার। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। খুব অতিষ্ঠ হয়ে ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘মশার জ্বালায় আর বাঁচি না।’ গ্রিন রোডের বাসিন্দা নাজমুস সাকিবের পরিবারের পাঁচজনেরই চিকুনগুনিয়া হয়েছিল। তার মা এখনো চিকুনগুনিয়ার সমস্যায় ভুগছেন। মশার প্রকোপ বাড়ায় বেশ চিন্তায় আছে পরিবারটি। 

তানজিরুল বাশার ও নাজমুস সাকিবের মতো রাজধানীর বেশ কয়েকজনের সাথে ফোনে কথা বলে জানা গেছে, তারাও মশার উপদ্রবে রয়েছেন ও মশাবাহী রোগে ভুগছেন। মশা বেড়ে যাওয়ায় সিটি করপোরেশনের প্রতি নানান অভিযোগ করছেন তারা। 

তাদের দাবি, যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, তা কোনো কাজ করে না। শুধু জনগণকে দেখানোর জন্যই এসব করা হচ্ছে। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে মশা নিয়ে বইছে সমালোচনার ঝড়। মশা নিয়ন্ত্রণে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধুপ জ্বালাতেও দেখা গেছে। মশা নিয়ে শুধু নাগরিকরাই নন, অভিযোগ করেছেন সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ও মশক নিধনে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও। অনেকে আবার সিটি করপোরেশনের ছিটানো ওষুধ পরীক্ষার দাবিও জানিয়েছেন। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রিউম্যাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিনহাজ রহিম চৌধুরী বলেন, ‘শহরবাসী কিন্তু বিপদমুক্ত নয়। মশা বাড়ছেই। এখনই প্রতিরোধ করা না হলে পুনরায় বড় ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা হতে পারে। মশা থেকে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার পাশাপাশি মানুষ জিকা ভাইরাসেও আক্রান্ত হতে পারে।’

বছরের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ঢাকায় কিউলেকস মশা বেড়েছে প্রায় চারগুণ। আগে যেখানে প্রতি ডিপ-এ (মশার ঘনত্ব বের করার পরিমাপক) মশার ঘনত্ব ছিল ১০ থেকে ১৫টি, সেখানে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০টির মতো। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় জরিপ চালিয়ে এ তথ্য জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। মশা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে কীটতত্ত্ববিদরা সিটি করপোরেশনের অবহেলা ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসকে দায়ী করেছেন। কীটতত্ত্ববিদ খায়রুল বাশার বলেন, ‘যদি প্রতিটি ওয়ার্ডে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে পারে। তবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রকৃতির ওপর ভরসা করা ছাড়া কিছুই করার নেই।’

সিটি করপোরেশনের ভূমিকা নিয়ে মেয়র বরাবর চিঠি দিচ্ছেন কাউন্সিলররা। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি মো. ইব্রাহিম মেয়রকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগে তিনি বলেন, তার ওয়ার্ডের জন্য সিটি করপোরেশনের বরাদ্দকৃত মশার ওষুধ প্রতিদিন ছিটানো হচ্ছে; কিন্তু কাজ হচ্ছে না। একই অভিযোগ করে ৮৩নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সাহানা আক্তার জানান, ‘মেয়র বরাবর আবেদন করেছি। যাতে প্রতিদিন আমার ওয়ার্ডে মশার ওষুধ ছিটানো হয়; কিন্তু আবেদনের ১০ দিন পার হয়ে গেলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও মশা গবেষক ড. কবিরুল বাশার নতুন কীটনাশকেও মশা নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা দেখছেন না। তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে এখনো এত বেশি ছোট ছোট বদ্ধ জলাশয় রয়েছে, যেগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সুতরাং সে সব জায়গা থেকে মশা বৃদ্ধি পায়, বিস্তার লাভ করে, প্রজনন ছড়ায়, সেসব জায়গায় মশার বংশবিস্তার আগে রোধ করতে হবে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘জরুরি পদক্ষেপ না নিলে মার্চের পর থেকে আরো বাড়তে থাকবে। ডিসেম্বরেই মিডিয়াকে বলেছিলাম, মার্চ মাস নাগাদ মশার পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং বাড়তেই থাকবে। এখন মশার অবস্থা খুবই খারাপ। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। এগুলো কিউলেকস মশা।’

ড. বাশার আরো বলেন, ‘মশার রয়েছে দুটি ধাপ। একটি লার্ভার ধাপ, যা পানিতে থাকে। অন্যটি পূর্ণাঙ্গ, যা উড়ন্ত মশা। গবেষণার ক্ষেত্রে আমরা এসব মশার ডেল সিটি ইনডেক্স বের করি। লার্ভার ডেল সিটি ইনডেক্সের ক্ষেত্রে ডিভাইস দিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে পানি নিয়ে এর সংখ্যা হিসাব করি। গড় বের করে দেখি, প্রতি ডিপে মশার সংখ্যা কত। যেখানে আমরা এপ্রিলের পর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পেয়েছি গড়ে ১৫ থেকে ২০টি মশা, সেখানে এখন গড়ে প্রতি ডিপে পাচ্ছি ৬০টি। প্রায় চারগুণ বেশি। অর্থাৎ এ মুহূর্তে চারগুণ বেশি মশা রয়েছে বছরের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায়।’

সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘মশার ওষুধ বা কীটনাশকের মান যেন ঠিক থাকে, সেজন্য আমরা বারবার পরীক্ষা করাই। আর দীর্ঘদিন যদি কোনো কীটনাশক বারবার ব্যবহার করা হয়, তখন তাতে মশক সহনশীল হয়ে যায়। পরিস্থিতি উন্নয়নে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন কীটনাশক আনা হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যে কীটনাশক প্রয়োগে সুফল পাওয়া গেছে, কিউলেকস মশার জন্য তা কার্যকর হয় না। সে জন্য কীটনাশকের পরিবর্তন করছি। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন কীটনাশক চলে আসবে। সেটি আমরা কিউলেকস মশার জন্য ব্যবহার করব। মশার উপদ্রব বাড়ার যে অভিযোগ আসছে, সেটিরও নিরসন করা হবে।’

মশার প্রকোপ নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাকির হাসান বলেন, ‘নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি মশা নিয়ন্ত্রণে গত অক্টোবর ও নভেম্বরে বিশেষ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এতে মশা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ছিটানোর পরিমাণ দ্বিগুণ করা হয়; কিন্তু কাঙিক্ষত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না।’ 

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নালাগুলো অপরিষ্কার। আবার অনেক মানুষ সচেতন নন। এর পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি দফতরের মধ্যে সমন্বয়হীনতাকেও একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

ডিএসসিসির স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মীর মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যে একটি ক্রাশ কর্মসূচি চালানো হয়েছে, যেখানে একটি অঞ্চলে ডিএসসিসির সব লোকবল একসঙ্গে কাজ করেছে। প্রয়োজন হলে আরও বাড়তি পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh