অস্তিত্ব সংকটে বাগদি সম্প্রদায়

আহমেদ নাসিম আনসারী

প্রকাশ: ০৪ মার্চ ২০২১, ১১:২৭ এএম

বাগদি একটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে এদের বাস। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতেই সাধারণত এ সম্প্রদায়ের মানুষদের দেখা যায়। সমাজে অচ্ছুত বলে পরিচিত এ সম্প্রদায়ের মানুষ মাছ-কাঁকড়া-কুইচ্যা-কচ্ছপ-খরগোশ শিকার করে, ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান কুড়িয়ে চলে তাদের জীবন। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে চরম অস্তিত্ব সংকটে রেয়েছে সম্প্রদায়টি।

অস্তিত্ব সংকট নিয়েও  ঝিনাইদহ, মাগুরা, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নাটোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট এলাকাতেই এখনো কিছু বাগদী জনপদ টিকে আছে।

সরেজমিনে জানা যায়, ঐতিহাসিক ভাবেই বাগদী জাতি জলাভূমি প্রতিবেশী এলাকায় বসতি গড়ে তুলেছিলো। বিল, বাওড়, নদীর কিনার, নালা ও খালের ধারেই জলাভূমি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া সহায় সম্পদে গড়ে ওঠা সেই দুঃসাহসী স্বনির্ভর বাগদী আখ্যান এখন আর নেই। জীবন ধারণের জন্য নদি, বিল-হাওড়ে বা কৃষি খামারে নামতে গেলেই ঘটে বিপত্তি। বিল-বাওড় নদীর ইজারাদার কিম্বা খামারের মালিকের হাতে অনেক সময় হতে হয় শারীরিকভাবে নির্যাতিত।

এককালে বাগদীরাও নিজস্ব সর্বপ্রাণবাদী ধর্ম পালন করতেন কিন্তু বাঙালি হিন্দু সমাজের সাথে বসবাসের ফলে তারাও নিজস্ব ধর্ম থেকে বাধ্য হয়েছেন সনাতন হিন্দুধর্মে আত্তীকরণের। বাঙালি হিন্দু সমাজের কঠোর বর্ণপ্রথা বাগদীদের অচ্ছুত ও নিচুজাত বানিয়ে রেখেছে এখনো। এখনো বাগদীদের সাথে কথিত বর্ণহিন্দুর জলচল নেই।

আমন ধান কাটার পরই বাগদী সমাজও আপন জাতিগত আচাররীতিতে টানটান হয়ে ওঠে। বাঙালি কৃষকরা অগ্রহায়ণ থেকে পৌষের প্রথম দিকে বিল এলাকার আমন ধান কেটে ঘরে তুলেন। আমন মওসুমে বিল এলাকার দেশি আমন ধানের শীষ কেটে কেটে ইঁদুরেরা গর্তে নিয়ে যায়। আর তখন বাগদিরা ইন্দুরগাতি উৎসব পালন করে থাকে। কারণ এই ইঁদুরের গর্ত থেকে তারা ধান সংগ্রহ করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাগদি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই উৎসবে অনেকখানি ভাটা পড়েছে।

 সমাজের মূল ধারার বাইরে থাকায় এ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় তেমন কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার ভোগ করতেই এদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। অভিযোগ আছে, কয়েক বছর আগেও এ বাগদিরা কোন ধরনের সরকারি সাহায্য ভোগ করতে পারতো না। এমনকি তাদের ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়েও ভর্তির সুযোগ তেমনভাবে পেতো না।

এদিকে রয়েছে চিকিৎসা সংকট। এখনো এ সম্প্রদায়টি ঝাড়ফুঁকের ওপরই নির্রভশীল। এছাড়াও রয়েছে সুষ্ঠু পরিবেশের ঘাটতি। বাল্য বিবাহ যেন হরহামেশাই হচ্ছে। অপুষ্ট শিশুগুলোর দুরন্ত দৌড়ঝাঁপ আসলে বুঝতে দেয় না তাদের জীবন করুণ দিকটিকে। আর বয়স্কদের টিকে থাকার বিষয়টি আরো বেদনাদায়ক। এতোকিছুর পরও তাদেরকে ঘিরে নেই কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা।

স্থানীয় প্রশাসন থেকে তাদের উন্নয়নে সামান্য উদ্যোগ নেয়া হলেও, তা পরিমিত নয়।

এ বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলার তৈলকূপী গ্রামের ইউপি সদস্য মতিয়ার রহমান জানান, কালের বিবর্তনে অনেকেই ভারতসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে বাগদি সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী। এখন এই গ্রামে ১৫/১৬ টি বাগদি সম্প্রদায় পরিবারের বসবাস।  আমরা সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি তারা হিন্দু ধর্মের অনুসারী হলেও হিন্দুরাদের কাছে তাদের মূল্যায়ন সেইভাবে আসেনি। বাগদি সম্প্রদায়ের লোকেরা পূজাপার্বন সবই হিন্দুদের নিয়ম নীতিতেই করতে দেখে আসছি। আগে তারা সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা না পেলেও এখন কিছু কিছু সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে যেমন, প্রতিবন্ধি ভাতা, বসষ্কভাতা, গর্ভবতি ভাতা ইত্যাদি। তবে পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্টির দিকে সরকারি আরো সুযোগ সুবিধা পেলে তারা অস্তিত্ব সংকট থেকে মুক্তি পাবে বলেন এই ইউপি সদস্য।


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh