উচ্ছেদের চেয়েও জরুরি লুটপাট নিয়ন্ত্রণ

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৮:৫৯ এএম | আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:০১ এএম

মোহাম্মদপুরের বসিলায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। ফাইল ছবি

মোহাম্মদপুরের বসিলায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। ফাইল ছবি

রাজধানীর চারটি খাল উদ্ধার করে সেগুলো দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তুলতে ৯৮১ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ঢাকা ওয়াসা থেকে খালের দায়িত্ব পাওয়ার পর এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। 

খাল উদ্ধার করে দুই পাড়ে বানানো হবে ওয়াকওয়ে, বাইসাইকেল লেন, মাছ ধরার শেড, বাগান, ফোয়ারা, ফুটওভার ব্রিজ, ইকোপার্ক, পাবলিক টয়লেট ও খেলার মাঠ। 

খবরটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ও সত্যি সত্যি এই ঘটনাগুলো ঘটলে, বসবাস অনুপযোগী শহরের তালিকায় থাকা শহরটির চেহারা বদলে যাবে। হয়তো একদিন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এখানে আসবেন; এখন যেমন ইউরোপের ভেনিস, প্রাগ, আমস্টারডাম ঘুরতে যান লাখ লাখ মানুষ। 

তবে ইউরোপের সাথে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা, রাজনীতি ও ক্ষমতাকাঠামোর তফাৎ যেহেতু ঢের ও বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বস্তরে যেহেতু দুর্নীতি অন্যতম প্রধান নিয়ামক- ফলে যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পই, বিশেষ করে যার সাথে ক্ষমতাবান লোকদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে, তা বাস্তবায়ন একদিকে যেমন বেশ কঠিন, তেমনি সেই উন্নয়ন টেকসই করা আরো বেশি কঠিন।

শুধু রাজধানী ঢাকাই নয়, দেশের আরো অনেক বড় শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলো দখল হয়েছে। কোথাও সড়ক ও ভবনের নিচ দিয়ে খালের সরুরেখা নর্দমার আকারে কোনোমতে টিকে আছে, অনেক জায়গায় যে একসময় বড় খাল ছিল, তা বিশ্বাস করাও কঠিন। কারণ সেখানে নর্দমার ক্ষীণরেখাও অবশিষ্ট নেই।

পরিসংখ্যান বলছে, একসময় ঢাকার ভেতর দিয়ে প্রায় অর্ধশত খাল প্রবাহিত ছিল। যেগুলো নগরীর চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল; কিন্তু এখন এর প্রায় অর্ধেকেরই অস্তিত্ব নেই। টিকে থাকা খালগুলোও প্রাণহীন। অনেকগুলো পরিণত হয়েছে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে। আবর্জনায় জমাটবাঁধা খালের নর্দমায় খুঁটি পুঁতে পাটাতন বসিয়ে তার উপর গড়ে তোলা হয়েছে বস্তি।

তারপরও গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা শহরের সব খাল আনুষ্ঠানিকভাবে দুই সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেয় ঢাকা ওয়াসা। অনুষ্ঠানে দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘ঢাকার খালগুলো উদ্ধারের যে অঙ্গীকার আমরা করেছিলাম, সেটার বাস্তবায়ন শুরু করতে যাচ্ছি। জানি, কাজটি অনেক কঠিন; কিন্তু অঙ্গীকার থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ নেই। যদি এই কাজে সফল হতে পারি, তাহলে ভেনিসের চেয়ে কোনো অংশে কম হবে না ঢাকা শহর।’ 

বাস্তবতা হলো, একটি ড্রেন বা ক্ষীণ জলরেখাকে সংস্কার করে যত দ্রুত নৌপথে রূপ দেয়া যায়, একশ’ ভাগ দখল হয়ে যাওয়া বা অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়া খালকে আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনা তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। সেই কঠিনেরে যেহেতু মেয়রদ্বয় ভালোবেসেছেন, অতএব নাগরিক হিসেবে আমরা এই প্রত্যাশা করতে চাই যে, এই কঠিন কাজ বাস্তবায়নে তাদের পলিটিক্যাল উইল বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে ও রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের গ্রিন সিগন্যালও তাদের কাছে রয়েছে। কেননা সেই সিগন্যাল না থাকলে যতই সদিচ্ছা থাকুক, আর্থ-রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান লোকদের বহুতল ভবন ভাঙতে গিয়ে তাদের উল্টো বিপদে পড়তে হবে। কারণ টাকার জোর যেখানে রাষ্ট্রীয় নীতিও পাল্টে দেয়, সেখানে দুই মেয়র চাইলেই যে সবকিছু সহজে করে ফেলতে পারবেন- এমনটি ভাববার কোনো কারণ নেই।

তারপরও রাজধানীর বুকের ভেতরে সুন্দর ওয়াকওয়ে দ্বারা বেষ্টিত খাল ও সেখানে কংক্রিটের বেঞ্চিতে বসে মানুষ পরিষ্কার পানিতে মাছ ধরছে; বাইসাইকেল চালাচ্ছে; শিশুরা খেলছে ও তাদের নাকে কোনো দুর্গন্ধ লাগছে না- সেই দৃশ্য কল্পনা করার মধ্যেও এক ধরনের আনন্দ আছে। 

সমস্যা হলো- এই দৃশ্যগুলো বাস্তবে রূপ দেয়ার পথটি যে কত কঠিন, তার বড় উদাহরণ মিরপুরের জনৈক প্রভাবশালী এমপি। তার দখলে থাকা সরকারি জমিতে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গিয়ে বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন সরকারি লোকজন। এ রকম জনপ্রতিনিধির সংখ্যা অগণিত, যাদের দখলকৃত জমিতে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে সেখানে জনগণের জন্য কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন।

রাজধানী ঢাকার ভেতরে যেখানে এক ইঞ্চি জমির দামও লাখ টাকা; কোনোমতে একটি স্থাপনা নির্মাণ করা গেলেই যেখানে পয়সা বানানো যায়; যেসব স্থাপনা ঘিরে স্থানীয় এমপি ও কাউন্সিলরদের লোকজন নানাভাবে পুনর্বাসিত বা আর্থিকভাবে লাভবান হয়- সেখানে উচ্ছেদ অভিযান স্থায়ী করা শুধু কঠিনই নয়, অনেক সময় অসম্ভবও। 

তবে সাম্প্রতিককালে এই অসম্ভব কাজ অনেক জায়গায় যেহেতু সম্ভব হতে দেখা যাচ্ছে, সে কারণে রাজধানী ঢাকা নিয়ে নাগরিকরা নতুন করে ভাবতে পারছেন। তারা ১০ বছর পরে একটি সুন্দর, নির্মল ও বিশুদ্ধ বাতাসের শহরের স্বপ্ন দেখতেই পারেন। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য মূলত দরকার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং উচ্ছেদ ও প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে যুক্ত মানুষের দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা। 

ঢাকার দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধার করে নৌপথের বিস্তৃতি ঘটানো ও একটি সুন্দর শহর গড়ে তুলতে দুই সিটি মেয়রের রাজনৈতিক সদিচ্ছা যে রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জ হলো- ক্ষমতাকাঠামোর ভেতরে, বিশেষ করে অবৈধ দখলদারদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন, যারা মেয়রদের চেয়েও বেশি শক্তিশালী- তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে প্রশাসনের সর্বস্তরের যে সহায়তা ও শক্ত মেরুদণ্ডের প্রয়োজন- সেটি অনুপস্থিত থাকলে ‘তিলোত্তমা ঢাকা’ শব্দযুগল কেবল সাহিত্যেই শোভা পাবে, বাস্তবে ধরা দেবে না। 

বলা হয়, প্রকল্প মানেই বিশাল টাকা-পয়সার খেলা। কমিশন বাণিজ্য। সরকারি কাজে এক কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলে ৬০ লাখ টাকাই নানা ঘাটে দিয়ে দিয়ে বাস্তবে এর ৪০ লাখ টাকাও যে খরচ করা হয় না, সেই নির্মম বাস্তবতা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অথচ কমিশনের নামে লুটপাট করে নেয়া ও ক্ষমতা বলয়ে থাকা লোকজনের ব্যাংক ব্যালান্স ভারি করার এই পয়সাগুলো হয় জনগণের কষ্টার্জিত নয়তো মোটা সুদে আনা বিদেশি ঋণ। 

সেই বাস্তবতায় এটিই আমাদের প্রত্যাশা যে, নগরীর সৌন্দর্য বাড়ানো, তথা রাজধানী ঢাকাকে পৃথিবীর খারাপ শহরগুলোর তালিকা থেকে বের করে এনে একে বাসযোগ্য করার মিশনে অবৈধ দখল উচ্ছেদ যেমন জরুরি, তেমনি উচ্ছেদ-পরবর্তী উন্নয়ন প্রকল্পের পয়সার সিংহভাগই যাতে ঠিকাদার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসন ও রাজনীতিবিদদের পকেটে চলে না যায়- দুর্নীতি যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে, সেটি নিশ্চিত করা আরো বেশি জরুরি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh