ভাষার যাত্রা ভাষার প্রাণ

আনু মুহাম্মদ

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৩:১৪ পিএম

বাংলা ভাষা আজ যে পর্যন্ত এসেছে তার এই যাত্রা কখনোই মসৃণ ছিল না। শেকড় থেকে কাদামাটি মাখা মানুষের মাথা তুলে দাঁড়ানোর ক্রমাগত লড়াইয়ের মধ্যে বাংলা ভাষা নিজের যাত্রাপথ খুঁজে পেয়েছে। এই ভাষার গায়ে দমন, অশ্রদ্ধা, ঘৃণা ও অপমানের অসংখ্য দাগ আছে। 

শুধু তাই নয়, বর্তমান পর্যায়ে আসতে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে রক্তের সাগর; কিন্তু সময় দাবি করছে বাংলা ভাষার আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে নিজের মতোই করে তার প্রতিষ্ঠা পেতে, তার অন্তর্গত শক্তি ও মর্যাদা নিয়ে দাঁড়াতে, তার মানুষদের প্রাণকে ধারণ করতে।

দুই

যদিও ভাষাতাত্ত্বিক ও গবেষকদের দীর্ঘ শ্রমের মধ্য দিয়ে এটি এখন প্রতিষ্ঠিত যে, বাংলা ভাষা সংস্কৃত থেকে জন্ম নেয়া কোনো ভাষা নয়, বরঞ্চ তার বিপরীতেই তার পথ সন্ধান, তারপরও কারও কারও কথার সুরে এরকম সিদ্ধান্ত এখনো বাজে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার সম্পর্ককে এতই দূরবর্তী বলেছেন যে এ দুটিকে আত্মীয়ও বলা কঠিন। বলেছেন, ‘অনেকের সংস্কার বাঙ্গালা ভাষা সংস্কৃতের কন্যা। শ্রীযুক্ত অয়চন্দ্র সরকার মহাশয় সংস্কৃতকে বাঙ্গলা ভাষার ঠানদিদি বলিয়াছেন। আমি কিন্তু সংস্কৃতকে বাঙ্গালীর অতি- অতি- অতি- অতি- অতি-বৃদ্ধপ্রপিতামহী বলি।’

সৈয়দ মুজতবা আলী তার ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ গ্রন্থে বাংলাভাষার উৎপত্তি ও বিবর্তনের সারসংক্ষেপ করেছেন এভাবে যে, ‘বুদ্ধদেব যে রকম একদিন বৈদিক ধর্ম ও তার বাহন সংস্কৃতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তৎকালীন দেশজ ভাষায় (পরে পালি নামে পরিচিত) আপন ধর্ম প্রচার করেন, ঠিক সেই রকম বাংলা ভাষার লিখিত রূপ আরম্ভ হয় বৌদ্ধ চর্যাপদ দিয়ে। পরবর্তী যুগে বাংলা সাহিত্য রূপ নেয় বৈষ্ণব পদাবলির ভিতর দিয়ে। আজ পদাবলি সাহিত্যকে হিন্দু ধর্মের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়; কিন্তু যে যুগে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারিত সে যুগে তাকে বিদ্রোহের অস্ত্রধারণ করেই বেরুতে হয়েছিল। তাই শ্রীচৈতন্য প্রচলিত ধর্ম সংস্কৃতে লেখা হয়নি, লেখা হয়েছিল বাংলায়।’ সুতরাং সংস্কৃতের আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রেই বরং বাংলার উৎপত্তি। আর তার জন্মভূমিও এই বঙ্গেই।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘চর্যাপদগুলোর অধিকাংশ রচয়িতা আমাদের বাংলাদেশের অধিবাসী ছিলেন। সুতরাং আমরা বলিতে পারি যে, বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তি বাংলাদেশে- বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ বা রাঢ় দেশে প্রথমে শূর রাজবংশ ও পরে সেন রাজবংশ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই কারণে রাঢ় বা পশ্চিম বঙ্গে প্রাচীনকালে বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব সম্ভব হয় নাই; কিন্তু প্রাচীন গৌড় ও বা বর্তমান বাংলাদেশে মুসলিম রাজত্বের পূর্বেই বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তি ও শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছিল।’

দীনেশচন্দ্র সেন অবশ্য মুসলিম শাসনেই বাংলা ভাষার বিকাশের ওপর গুরুত্ব দেন। ‘বঙ্গভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘অপূর্ব্ব সব গুণ’ থাকা সত্ত্বেও ‘মুসলমান আগমনের পূর্ব্বে বঙ্গভাষা কোনো কৃষক-রমণীর ন্যায় দীনহীন বেশে পল্লী কুটিরে বাস করিতেছিল।’ এই ভাষা নিয়ে ইউরোপীয় পন্ডিতদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসার উল্লেখ করেছেন দীনেশ সেন। ‘কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবারীর অপো করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোন শুভদিন, শুভণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল। মুসলমান বিজয় বাঙ্গলাভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনিল। গৌড়দেশ মুসলমানগণের অধিকৃত হইয়া গেল, তাঁ হারা ইরান, তুরাণ যে দেশ হইতেই আসুন না কেন, বঙ্গদেশ বিজয় করিয়া বাঙ্গালী সাজিলেন। আজ হিন্দুর নিকট বাঙ্গলাদেশ যেমন মাতৃভূমি, সেই দিন হইতে মুসলমানের নিকট বাঙ্গলাদেশ তেমনই মাতৃভূমি হইল।’ 

দীনেশ তাই স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘বঙ্গভাষা অবশ্য বহু পূর্ব্ব হইতে এদেশে প্রচলিত ছিল, বুদ্ধদেবের সময়ও ইহা ছিল, আমরা ললিত বিস্তরে তাহার প্রমাণ পাইতেছি; কিন্তু বঙ্গ সাহিত্যকে একরূপ মুসলমানের সৃষ্টি বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না।’

লেখক:  আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ

তবে ভাষার এই যাত্রাপথে, ভাষাভাষীর মধ্যে নানাবিধ বৈষম্য, প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। জনগোষ্ঠীর উপর আধিপত্য নিশ্চিত করতে গিয়ে ক্ষমতাবানরা প্রথম দখল করতে চেয়েছে ভাষা। ভাষা শৃঙ্খলিত করতে চেয়েছে ধর্ম জাতি আর সমাজভেদকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। জনসম্পৃক্ততা, তাদের আকাঙ্খা বা প্রবেশাধিকারের পথে বাধা সৃষ্টির জন্য ভাষাকে কতিপয়ের হাতে বন্দী করবার নানা কৌশল চলেছে নানাভাবে।

তিন

বাংলাভাষায় ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত, পর্তুগিজ শব্দের ভিড় প্রসঙ্গে কারও কারও এরকম মন্তব্য শুনি যে, বাংলা তো মিশ্র ভাষা। এই কথার মধ্যে হীনম্মন্যতার সুরও পাওয়া যায়; কিন্তু এতে হীনম্মন্যতার কিছু নেই বরং এই বৈচিত্র্য ও সম্ভার ভাষার শক্তির প্রতিফলন। আসলে সব জীবন্ত ভাষাই মিশ্রভাষা। 

একটি ভাষা যদি মরে যায় কিংবা মরণোম্মুখ হয়, তাহলে তার গ্রহণের ক্ষমতাও শেষ হয়ে যায়। সেই ভাষার সাথে অন্য কোনো ভাষার যোগ ঘটে না, নতুন শব্দের যোগ হয় না, নতুন চিন্তা বা ধারণা যোগ হয় না; কিন্তু ভাষা যদি জীবন্ত থাকে, সেই ভাষার মানুষেরা যদি জীবন্ত থাকেন, তাহলে তাকে অন্য ভাষা ও অন্য ভাষার মানুষের সংস্পর্শে আসতেই হয়। প্রতিযোগিতা, সহযোগিতা, সংঘাত, ঐক্য, নতুন চিন্তা, নতুন প্রযুক্তি, নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার কারণে ভাষায় যোগ হয় নতুন নতুন শব্দ। 

প্রথমে জনগোষ্ঠীর মুখে জন্ম নেবে, চলাচল করবে, পরে ভাষার লিখিত রূপে জায়গা নেবে। এমনকি নিজের ভেতর থেকেও যোগ হবে নতুন নতুন ভাব ও শব্দের। তার সব যে টিকে থাকবে তা নয়।

উনিশ শতকে যখন বাংলা ভাষা সাহিত্যের নতুন পর্বের যাত্রা শুরু সেসময় থেকে দুটি বিষয়ে বিতর্ক প্রায়ই মাঠ সরগরম করেছে। একটি হলো বাংলা ভাষায় সংস্কৃত বা আরবি, ফার্সি শব্দের ব্যবহার, আরেকটি হলো সাধু ও কথ্য ভাষার চর্চার গ্রহণযোগ্যতা। ভাষার যাত্রাপথে এরকম বিতর্ক প্রায়ই উঠে, নানা ধরনের। বঙ্কিমচন্দ্রও সাহিত্যে সংস্কৃত শব্দের অনাবশ্যক ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষার তৎকালীন অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন, আজিও অকারণে প্রচলিত বাঙ্গালা ছাড়িয়া সংস্কৃত ব্যবহারে, ভাই ছাড়িয়া অকারণে ভ্রাতৃ শব্দের ব্যবহারে অনেক লেখকের বিশেষ অনুরক্তি আছে। অনেক বাঙ্গালা রচনা যে নীরস নিস্তেজ ও অস্পষ্ট ইহাই তাহার কারণ।’

পরবর্তী সময়ে ধর্ম ও জাতি চিন্তায় প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান নিয়েছিলেন সেই বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘বাঙ্গলা ভাষা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘যদিও আমরা বলি না যে ‘ঘর’ প্রচলিত আছে বলিয়া গৃহ শব্দের উচ্ছেদ করিতে হইবে, অথবা মাথা শব্দ প্রচলিত আছে বলিয়া মস্তক শব্দের উচ্ছেদ করিতে হইবে; কিন্তু আমরা এমত বলি যে অকারণে ঘর শব্দের পরিবর্ত্তে গৃহ, অকারণে মাথার পরিবর্ত্তে মস্তক, অকারণে পাতার পরিবর্ত্তে পত্র, অকারণে তামার পরিবর্ত্তে তাম্র ব্যবহার উচিত নহে... বাঙ্গালা লিখিতে গিয়া অকারণে বাঙ্গালা ছাড়িয়া সংস্কৃতে কেন লিখব? আর দেখা যায় যে সংস্কৃত ছাড়িয়া বাঙ্গালা শব্দ ব্যবহার করিলে রচনা অধিকতর মধুর, সুস্পষ্ট ও তেজস্বী হয়।’

ভাষাকে অনাবশ্যক জটিল ও জনবিচ্ছিন্ন করবার প্রবণতা তখনও ছিল, এখনও আছে। বঙ্কিমচন্দ্র তাই যথার্থই লিখেছেন, ‘স্থুল কথা, সাহিত্য কি জন্য? গ্রন্থ কি জন্য? যে পড়িবে তাহার বুঝিবার জন্য। না বুঝিয়া, বহি বন্ধ করিয়া, পাঠক ত্রাহি ত্রাহি করিয়া ডাকিবে, বোধ হয় এ উদ্দেশ্যে কেহ গ্রন্থ লিখে না।’

তাই তাঁ র সিদ্ধান্ত খুবই স্পষ্ট, ‘বলিবার কথাগুলি পরিস্ফুট করিয়া বলিতে হইবে- যতটুকু বলিবার আছে সবটুকু বলিবে- তজ্জন্য ইংরেজি, ফার্সি, আরবি, সংস্কৃত, গ্রাম্য, বন্য, যে ভাষার শব্দ প্রয়োজন, তাহা গ্রহণ করিবে, অশ্লীল ভিন্ন কাহাকেও ছাড়িবে না; তারপর সেই রচনাকে সৌন্দর্য্যবিশিষ্ট করিবে- কেননা যাহা অসুন্দর, মনুষ্যচিত্তের উপরে তাহার শক্তি অল্প।’

চার

‘মায়ের মুখের ভাষা’ তথাকথিত শুদ্ধ বা মান বাংলা নয়। বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন শব্দভাভান্ডার, ভাষা বৈচিত্র আমাদের সম্পদ। ভাষার অপরিমেয় শক্তি যেহেতু শেষ পর্যন্ত মানুষ থেকেই আসে, সেহেতু বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের উপস্থিতি গতিশীল ভাষার অনিবার্য দিক। মান ভাষা বলে কোন নির্দিষ্ট স্থায়ী ধরন গতিশীল ভাষায় থাকতে পারে না। অনেক শব্দ যা গতকাল মানভাষায় অগ্রহণীয় মনে হয়েছে তা আজ হয় না। আজ যেগুলো হচ্ছে তা আগামীকাল হবে না। মুখের ভাষা সবসময়ই লিখিত ভাষা থেকে এগিয়ে থাকে। এর কারণ খুব সোজা। মানুষ লিখিত ভাষায় নিজেকে প্রকাশ শুরু করেছে মাত্র কয়েক হাজার বছর; কিন্তু মুখের ভাষার বয়স তো লক্ষ বছর। মুখেই নতুন যোগ হয় প্রথম। তারপর তার ঝাড়াই বাছাই হয়ে তা লেখ্য ভাষায় প্রবেশ করে। তারপরও তা টিকবে কিনা তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। চাইলেও রাষ্ট্র বা ব্যক্তি তা নির্ধারণ করতে পারে না। শুধু বয়স নয়, লিখিত ভাষার তুলনায় মুখের ভাষার বৈচিত্রও অনেক বেশি, কারণ সেখানে স্বতস্ফুর্ততা স্বাধীনতাও তুলনায় অনেক বেশি। এতটা স্বতস্ফুর্ততা ও স্বাধীনতা লেখ্য ভাষায় সম্ভব না, যথোপযুক্তও না। কোন ভাষা যদি জনগণের মুখের ভাষার এই গতিশীলতা ধারণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তার নিজেরও অগ্রযাত্রা আটকে যায়।

বাংলা কেন সব ভাষাতেই অঞ্চলের বৈচিত্র থাকে। পুরনো-নতুন, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সংঘাত বা টানাপোড়েনও থাকে। এর মধ্যেই সবার জন্য বোধগম্য একটি ধরনেই লিখিত/রাষ্ট্রীয় ভাষা ও সাহিত্য দাঁড়ায়। তবে কখনোই তা স্থির থাকে না। স্থির রাখার চেষ্টাও চলে; কিন্তু পরিবর্তনও অনিবার্য থাকে। তবে এই কথাটি মনে রাখতে হবে যে, অঞ্চলের ভাষা মানেই নিম্নবর্গের ভাষা নয়। অঞ্চলের কথ্য ভাষাতেও শ্রেণি ও নানা সামাজিক বৈষম্য থাকতে পারে। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণি, ক্ষমতাবান বা চোরাই কোটিপতিরাও অঞ্চলের ভাষায় কথা বলে থাকেন, খুব কম এমপি মন্ত্রী বা ব্যবসায়ী আছেন যারা ‘মান’ ভাষায় কথা বলেন। ইদানিং বাংলাদেশে কেউ কেউ নিম্নবর্গের ভাষা চর্চা করবার নামে ঢাকাই চলতি ভাষার ওপর ভর করেন, এটি অনেক ক্ষেত্রেই আরেকটি আরোপিত ব্যাপার। কেননা ঢাকায় আমরা এখন যে ভাষার ধরনে কথা বলি আইস্যা পড়লাম, খাইলাম, খাইতেছি এগুলো বহু অঞ্চলের মানুষের মুখের কথা থেকে দূরে। অন্যদিকে করেছি, খেয়েছি বললেই তা এলিট হয় না, কারণ কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনাসহ অনেক অঞ্চলের একজন শ্রমজীবী মানুষও এভাবেই কথা বলেন।

বিদেশি ভাষায় যেমন বুকের বা মনের ভাব প্রকাশে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, ‘শুদ্ধ মান’ ভাষাতেও তা হতে পারে। সেক্ষেত্রে মুখের কথায়, লেখায় ‘আঞ্চলিক’ ভাষার গ্রহণযোগ্যতা যত বাড়বে, তত যোগাযোগ সম্প্রসারিত হবে, তা নিশ্চিতভাবে ভাষা ও সাহিত্যেরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটাবে।

একসময় বেতার টিভি এমনকি মঞ্চ নাটকে সব চরিত্রই একইরকম ‘শুদ্ধ’ ও ‘মান’ ভাষায় কথা বলতো। এর ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চরিত্রগুলো অবাস্তব লাগতো। স্বাধীনতার পর এতে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। সম্প্রতি মঞ্চ তো বটেই, অনেক টিভি নাটকে বহু অঞ্চলের ভাব, ভাষা, আবেগ ও অভিব্যক্তি নিয়ে চরিত্রগুলো প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে।

বাংলাভাষায় ইংরেজি বা হিন্দীর যথেচ্ছাচার মিশ্রণ নিয়ে ইদানিং একটি উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে। আসলে এই সমস্যা সাম্প্রতিক নয়, এটি সেই সময়ও ছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, ‘আমি ল্যান্ডো গাড়ীতে ড্রাইভ করিতে করিতে হাওড়া ষ্টেশনে পঁহুছিয়া বেনারসের জন্য বুক করিলাম। ফার্ষ্ট ক্লাশে লোয়ার বার্থ ভেকান্ট ছিল না, আপার বার্থে বেডিংটা স্প্রেড করিয়া একটু সর্ট ন্যাপ নিবার চেষ্টা করিতেছি, এমন সময় হুইসিল দিয়া ট্রেন ষ্টার্ট করিল।’ আতংকের কিছু নেই, এগুলো কিছু লোকের হীনমন্যতার প্রকাশ কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে বাজারী প্রতিযোগিতায় চকচকে আকর্ষণ তৈরির চেষ্টা। এগুলো কোন স্থায়ী প্রভাব রাখতে পারে না।

পাঁচ

বাংলাদেশের বাইরেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বাংলাভাষী মানুষ আছেন। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বহু প্রান্তে উভয় দেশের প্রবাসী বাঙালী সম্প্রদায়ের আয়তন ক্রমেই বাড়ছে। রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক ভিন্নতা সত্ত্বেও আমরা সবাই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অভিন্ন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। এই ধারায় বঙ্কিম-বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-রোকেয়াদের মতো মুদ্রিত সাহিত্যের দিকপালরা যেমন, লালন, পুঁথি সাহিত্য মৈমনসিংহ গীতিকার মতো বিশ্বনন্দিত সমৃদ্ধ জনসাহিত্যও তেমনই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রাণ, শেকড় ও ঐতিহ্য সন্ধানে দ্বিতীয়টি বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের ভূমিকা অগ্রণীর। সৈয়দ মুজতবা আলী বলেন, ‘পূর্ববঙ্গের লোকসাহিত্য যখন বিশ্বজনের সম্মুখে আত্মপ্রকাশ করল তখন দেশ-বিদেশে বহু রসিকজন তার যে প্রশংসা করলেন, সে প্রশংসা অন্য কোনো দেশের লোকসাহিত্যের প্রতি উচ্ছ্বসিত হয়নি...।

১৯৪৭ থেকে পূর্ব বাঙলা ভিন্ন পথে অগ্রসর হয়েছে। সমাজের ভেতর শ্রেণি গঠন-পুনর্গঠনও ঘটেছে নানাভাবে। বাংলাভাষার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বৈরীতা, ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন ও তার বিরুদ্ধে আন্দোলন, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এবং একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মতো ঘটনাবলী এই অঞ্চলের বাংলা ভাষাকেও প্রভাবিত করেছে। অন্যদিকে বাঙালী শাসক শ্রেণির কর্তৃত্ব নিশ্চিত হবার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে দমনপীড়নের কর্তা যেমন আর পরদেশী নয়, স্বদেশী; বাঙলা ভাষার শত্রুও তেমন এখন ঘরের ভেতর।

এই শাসকশ্রেণি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে, তাদের ভাষা সংস্কৃতিকে অস্বীকার ও কোণঠাসা করেছে। বাঙালী বা বাংলাদেশী আওয়াজ তুলে অন্যান্য জাতিকে পদদলিত করলেও বাংলার তাতে যে বাড়তি সুবিধা হয়েছে তা নয়। স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরে আমরা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি যে, বাংলা নিজেই এখন প্রান্তিক ভাষা। শাসক শ্রেণি যাদের নিয়ে গঠিত, যারা দখলদার কমিশনভোগী ও অপরাধ তৎপরতার মধ্যে দিয়ে নিজেদের হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটাচ্ছে, তারা নিজেদের সন্তানদের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক ছিন্ন করতে ব্যগ্র। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা ও রাষ্ট্র পরিচালনা এখন অগ্রাধিকারের বিষয়। 

কয়েক বছর আগে হাইকোর্ট রায় দিয়েছে বাংলা ভাষার শুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য; কিন্তু সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও উচ্চ আদালতে এখনও প্রধান ভাষা হিসেবে বাংলার স্থান হয়নি। শিক্ষা এখন প্রধানত বাণিজ্যিক, সেখানে ইংরেজি মাধ্যমেরই আধিপত্য। ইংরেজি জানার সাথে কর্মসংস্থান, বিদেশ গমনের সম্পর্ক যতটা, তার চাইতে বেশি সম্পর্কিত হীনমন্যতা ও দাসত্বের মনেবৃত্তি।

ছয়

অনেকে প্রশ্ন করেন আমরা কি রাবীন্দ্রিক যুগেই আটকে থাকবো? না। রাবীন্দ্রিক যুগে আমরা আটকে নেইও, ইচ্ছা করলেও কেউ থাকতে পারবে না। বাংলাভাষা ও সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব তো থাকবেই; কিন্তু তার মধ্যেই আটকে থাকা মানে গতি হারানো, বন্ধ্যাত্বের শিকার হওয়া। আমাদের তাই রবীন্দ্রনাথকে স্বীকার করেও তাঁকে অতিক্রম করতে হবে।

প্রসঙ্গক্রমে বলি, একপর্যায়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কলকাতা কেন্দ্রিকতার নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের ভাষা আর বাংলাদেশের ভাষা দুটোই বাংলা, কাঠামো একই; কিন্তু পার্থক্য শরীর ও প্রাণমনে। এই অভিন্নতা ও ভিন্নতা দুটোই আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে। বলা ও লেখা দুই ক্ষেত্রেই পার্থক্য যে কোন সজাগ মানুষ টের পাবেন। বাংলাদেশের স্থান, কাল অভিজ্ঞতার ভিন্ন যাত্রা, আর সেই সাথে দীর্ঘদিনের উপেক্ষিত বিভিন্ন অঞ্চলের শব্দভান্ডার সক্রিয় হয়ে উঠায়, দুই ভাষার দূরত্ব বাড়ছেই।

উপরন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ একটি জাতীয় রাষ্ট্র, এদেশের ভাষায় উঠে আসছে বিশ্বে যথাযথ সম্মান নিয়ে দাঁড়ানোর জাতীয় আকাঙ্খা, আর অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ একটি প্রদেশ, তাই তাদের ভাষা অন্য একটি জাতীয় রাষ্ট্রের কাঠামোয় আঞ্চলিক ভাষা, বহু জাতির একটির কুন্ঠিত প্রকাশের বাহন, ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হবার হুমকির মুখে। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ তাই বাংলাদেশেই। বিশ্বভাষার পর্যায়ে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করা, সবরকম জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় তাকে উপযুক্ত করবার দায়, তাগিদ এবং আবশ্যকতা আমাদেরই। কৃত্রিম আরোপিত ভাষা দিয়ে এই কাজ হবে না।

সাত

ভাষা কোনো নির্দেশ মেনে চলে না, কোনো নির্দেশের জন্য অপেক্ষাও করে না। তবে সমাজের নানা ব্যক্তি, গোষ্ঠী, মতাবাদের ‘যা খুশি তাই’ করার হাত থেকে ভাষাকে রক্ষা করা ও তার শক্তিকে বিকশিত হতে সাহায্য করায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। এই দায়িত্বের অংশ হিসেবে স্বীকৃত কোন জাতীয় সংস্থা নানাচিন্তার সমন্বয় করতে পারে, দিক-নির্দেশনাও দিতে পারে; কিন্তু তা অবশ্যই সমাজের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা করে ও বিভিন্ন মতকে গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে। তাতে গ্রহণের নমনীয়তা থাকতে হবে।

লেখ্য ও কথ্য ভাষায় বিভিন্ন অঞ্চলের সরব উপস্থিতি উৎসাহিত করা ভাষার বিকাশের জন্য অপরিহার্য। অঞ্চলের ভাষার ব্যবহারে হীনমন হবার কোন কারণ নেই। কারণ সেখানেই ভাষার প্রাণ।

প্রকৃতপক্ষে ভাষা সমাজ ও মানুষের সঙ্গেই চলতে থাকে। শুধু মধ্যবিত্তের আলগা, কপট আর খন্ডিত জীবনে ভাষা ও সাহিত্য আটকে থাকলে তার জড়তা দুর্বলতা কাটবে না। মানুষ ও প্রকৃতি বিনাশী আধিপত্যবাদী, পুরুষতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, শ্রেণি- জাতি-লিঙ্গ বৈষম্য বিরোধী লড়াইয়ের ভাব, তত্ত্ব ও লড়াই যত বিস্তৃত হবে, ততো মানুষের অন্তর্গত শক্তির প্রকাশ ঘটবে, ভাষাও ততো মানুষের কলরবে মুখরিত হবে, শক্তিমান হবে।

বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এই চিন্তা ও লড়াইয়ের সাথে লিখিত সাহিত্যের যোগ ভাষার শক্তিবৃদ্ধির অন্যতম শর্ত। সরব মানুষ ছাড়া ভাষার প্রাণ কী করে বাঁচে?

-লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh