‘দশজনে বলে যাহা’ করোনাভীতির কর্তব্যচাপ

মানস চৌধুরী

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০২:২৫ পিএম | আপডেট: ১২ জুলাই ২০২১, ০১:১২ পিএম

মানস চৌধুরী

মানস চৌধুরী

প্রাক-কথন (বা কৈফিয়ৎ)

এই রচনাটি আমি লিখতে বসেছি অনুরোধে। সেটি বড় বিষয় না। অনুরোধটি রাখতে হচ্ছে পত্রিকায় কাজ করেন এমন নিকটজন কারও-কারও সঙ্গে সম্পর্কের কারণে। একে কখনো আমরা সৌজন্য বলে থাকি, কখনো বন্ধুকৃত্য বা কর্তব্য বলে থাকি। কখনো অস্বীকার করব না যে, ‘ঢেঁকি-গেলা’ও বলে থাকি। একবার রচনা দেওয়ার কথা দিয়ে ফেলার পর সেটিকে ঢেঁকি-গেলার মতো কষ্টকল্পিত দৃশ্যের উপমাতে হাজির করার মানে হয় না, ইত্যাদি। 

প্রসঙ্গটি আসছে কেন! আসছে, কারণ কোন মৌসুমে কী নিয়ে কথা বলতে হবে, কাকে দিয়ে কী করাতে হবে- এসবের একটি সুনির্দিষ্ট প্রণালি আছে চারপাশে, তাতে আমার আরাম লাগুক বা নাই লাগুক। কেবল তাই নয়, এখানে আশা করা হচ্ছে আমি ‘সামাজিকবিদ্যাগত’ বিশ্লেষণ তুলে ধরব। শিশুদের যেমন মধ্যবিত্তের বাসায় মেহমান এলেই কলাবিদ্যার কসরৎ দেখাতে বাধ্য করা হয়, এগুলোও অনেকটা তেমনি। তবে, শিশুদের তুলনায় আমাদের মানা-করার সামর্থ্য অধিক। তবে ‘নো মিনস নো’ সৌজন্যের জগতে অত সহজে কাজ করে না। যা হোক, আমার কাছে যা-ই আশা করা হোক না কেন, আমি মনমতো একটি রচনাই জমা দিচ্ছি।

‘ভয়ের পরে জয়’ 

আমি ভেবেছিলাম এখানে সামাজিক ভয়ের প্রণালি বিষয়ে কিছু ভাবনা বলব; কিন্তু লিখতে গিয়ে একটি কোমল পানীয়ের বহুদিন ধরে চলা বিজ্ঞাপন মাথায় জাঁকিয়ে বসল। তো মনে হলো, এটি মাথা থেকে না তাড়িয়ে আগে দুটি কথা বলে নিই। বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের যোগ্যতা-দক্ষতাকে আমি অতিশয় সম্মান করে থাকি। ত্রিশ সেকেন্ডে বা দেড় মিনিটে তারা যেভাবে রাজ্যের ভাবনা হাজির করেন তা দুর্দান্ত ব্যাপার-স্যাপার। তবে এটাও ঠিক যে বিজ্ঞাপন জগতের পৌনঃপুনিকতা বরদাশত করা দর্শক হিসেবে খুবই যন্ত্রণাদায়ক। টুথপেস্ট, সাবান, গুঁড়া সাবান, নুডলস ইত্যাদি কিছু পণ্যের বিজ্ঞাপন আশৈশব মোটামুটি একই রকম। অভিনেতাদের আর আবহসংগীত না খেয়াল করলে বোঝাই মুশকিল যে ৪০ বছরে কিছু বদলেছে। 

এছাড়া, অধুনা বাংলাদেশে কৌতুকাশ্রয়ী কিছু বিজ্ঞাপন বাজারে ভালো খাচ্ছে বিধায় উপর্যুপরি বানানো হচ্ছে। ওইগুলোর স্থূলতা হজম করাও কঠিন। এসব মনে পড়ল আসলে দুটি বিষয়ের প্রেক্ষাপটে। একটা হলো করোনাকালে বিজ্ঞাপনগুলোর যথেচ্ছ করোনা-সংযোগ বেড়েছে। আরেকটি হলো ওই সেই কোমল পানীয়ের বিজ্ঞাপন, যেখানে বলা হয় ‘ভয়ের পরে জয়’।

‘ভয়ের পরে জয়’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ, যা দিয়ে বহুজাতিক সংস্থার রাষ্ট্র-সীমানা পেরোনো পণ্যগুলোর বিজ্ঞাপনের হোমোজিনিটি বজায় রাখতে গিয়ে কী কী ধরনের বাজে অনুবাদ হয়, তা খতিয়ে দেখা যাবে। এই বস্তুটি খেতে (মানে পান করতে) কেমন তা সম্পূর্ণ আরেকটি প্রসঙ্গ এবং পয়সা পেলেও আমার বলার ইচ্ছে নেই; কিন্তু পাঞ্চলাইনটা এসেছে পাশের রাষ্ট্রে একই কোম্পানির একই পানীয়ের একই বিজ্ঞাপন থেকে। ওখানে বলা হয় ‘ডরকে আগে জিত হ্যায়’। হিন্দি ‘আগে’ যে বাংলায় ‘পরে’ তা চুক্তিবদ্ধ অনুবাদকরা ভালোই জানতেন। অবশ্য বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলে এই আগে-পরের ভেজাল বাঁধতে পারে। হয়তো ঠিকানাদাতা বলে দিলেন ‘তালগাছের আগে’; আর আপনার হাঁটতে হাঁটতে আসলে তালগাছ ডিঙিয়ে যেতে হবে, মানে গন্তব্যটি পড়বে পরে। এইখানেই আসলে মূল বিষয়। আপনার তালগাছ ডিঙাতে হবেই। হিন্দি ওই ‘আগে’টা আসলে ডিঙানোই। ফলে, তা হতো ‘ভয় ডিঙিয়ে জয়’। যা হোক, এই স্বপ্রণোদিত সঠিক মর্মার্থের অনুবাদ বাবদ আমাকে কোনো মজুরি দেয়া হচ্ছে না। বিজ্ঞাপনটিও বদলাবে বলে মনে হয় না, পানীয়ের স্বাদ বিষয়ে আগেও বলেছি, কোনো মতামত দেবো না; কিন্তু এই যে ভয় ডিঙিয়ে জয়, এটি করোনার সঙ্গে অতটা সুবিধা হবে না। কারণ এখানে ভয় করবেন সম্ভাব্য রোগাক্রান্তরা, আর জয় করবেন বলা হচ্ছে বিজ্ঞানীরা; কিন্তু বাস্তবে ওষুধ কোম্পানিগুলো। ফলে খুবই জটিল পরিস্থিতি। 

ভয়ের সামাজিক প্রণালি

আসলে বলতে চাইছিলাম এটি নিয়ে। রোগবালাই নিয়ে ভয় না পাবার কারণ নেই। বিশেষত, সেটি এমন একটি অভূতপূর্ব রোগ হলে যার সঙ্গে টেক্কা দিতে গিয়ে শক্তিমান রাষ্ট্রগুলো পর্যন্ত কুঁকড়ে আছে, পদ্ধতি নির্ণয়ে হিমশিম খাচ্ছে, আর লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। বিশেষত, বিজ্ঞানের অসীম ক্ষমতা অনুমান করে নেওয়া হয় যেই কালে; কিন্তু রোগ নিয়ে ভয় আর পাঁচটি ভয়ের থেকে খুব স্বতন্ত্র বলে আমার মনে হয় না। ভয় সাধারণভাবেই কতকগুলো বৈশিষ্ট্য ধারণ করে চলে। অনিশ্চয়তা আর অচেনাকে ভয় করে তামাম মানুষ; সাধারণত। আর করে অনিরাপত্তার বোধ থেকে। ফলে ভয়ের আলাপে নিরাপত্তাহীনতার বোধ খুবই প্রাসঙ্গিক। আর সেখানে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তির বিষয়ে ভাবতেই হয়। ব্যক্তি যখন ভয়ার্ত, তখন তো বটেই, সমষ্টি যখন ভয়ার্ত তখনো। নিরাপত্তা-বলয়ের অবস্থা যেখানে বেহাল অবস্থা, সেখানে ভয় তীব্র হবার কথা। 

বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য বিষয়ে নিরাপত্তা বোধ করা মানুষজনের পক্ষে খুব সহজ নয়; কিন্তু প্রশ্নটি আরও অন্তর্গতভাবে শ্রেণিগত। কার কী সামর্থ্য রয়েছে সেই হিসাবের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে তার ভয়ের বা আতঙ্কের পরিস্থিতি কী। অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন যে করোনা এক মহাসমতাবিধানকারী ভয়ের রাজ্য কায়েম করেছে। এখানে ধনী-গরিব, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য একত্রে সমরূপ ভয়ের প্রজা। আমি খুব একটা গা করি না এসব কথায়। এটা একটা আপাতগ্রাহ্যে সত্য লাগে এমন পরিস্থিতি; কিন্তু গূঢ় বাস্তবে এটি যে সত্য নয়, তা বোঝার জন্য সামাজিক পরিস্থিতির দিকে আপনার একটু গাঢ়ভাবে তাকাতে হবে। তারপরও যদি বুঝতে সমস্যা হয় তাহলে ভ্যাকসিন আসার পরিস্থিতিতে বসে ভাবুন। ভাবুন যে আপনি লটারিতে পেতে চান, নাকি নিলামে পেতে চান। নিলামে আপনি দবিরের সঙ্গে লড়তে চান নাকি সালমানের সঙ্গে লড়তে চান। এটুকু ভাবাভাবি করলেই ঐশী সমতাবিধানকারী আর মনে হবে না ভাইরাসটিকে। ভ্যাকসিন ছাড়া ভাইরাস নিয়ে ভাবা নিরর্থক। 

তবে ভয়ের বিষয়ে অন্য কিছু কথা না বললেই নয়। ভয় একটি সুনির্দিষ্ট শাসনপ্রণালি বিশেষ। অর্থাৎ, কীসে আপনার ভয় পাওয়া দরকার, প্রায় কর্তব্য, সেসব আপনার ইচ্ছানিরপেক্ষভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে বা আরও সূক্ষ্মভাবে বললে ব্যাকরণকৃত হয়ে আছে। যখন সাব্যস্ত হয়ে আছে আপনি ভীত বা সন্ত্রস্ত হয়ে থাকবেন তখন অন্যরকম দেখা গেলে শাসনপ্রণালির অসুবিধা হয়। আপনি কেন যথেষ্ট ভয় পাচ্ছেন না, কিংবা যথেষ্ট ভয়ার্ত আপনাকে দেখাচ্ছে না এই মর্মে তখন ভীতিপ্রদর্শন চলতে পারে। অনেকটা আবাহনীর জামা গায়ে দিয়ে মোহামেডানের গ্যালারিতে বসে পড়ার, বা উল্টো পরিস্থিতি হতে পারে। 

আমার জীবনে অনেকবার একটি ঘটনা ঘটেছে। কোলেচড়া শিশুদের মা-বাবারা জানিয়েছেন যে শিশুটি আমাকে ভয় পাচ্ছে। শিশুদের যে আমি কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে চাই তা নয়; কিন্তু মধ্যবিত্তদের সঙ্গে কুশলাদি দেখা-সাক্ষাৎ হলে, আর তাদের ভাষাহীন কোলশিশু থাকলে কোলে শিশু তোলা একটি সৌজন্য বলেই মনে হয়েছে আমার; কিন্তু এরকম একাধিক ক্ষেত্রে শিশুর মাতা-পিতা ঘোষণা দিয়েছেন যে শিশুটি আমাকে ভয় পাচ্ছে, যখন শিশুটি হয়তো আমার দাড়ি ধরে টানাটানি করছে। যদি ভাষাজ্ঞান থাকত ওইসব শিশুর, এই মর্মান্তিক মিথ্যাচারের জন্য মা-বাবার দিকে অভিশংসনের চোখে তাকাতেন শিশুরা। এটি কেন ঘটে? ঘটে, কারণ শিশুর পিতামাতা আশা করেন যে, শিশুরা শিশুকাল থেকেই পরিপাটি গালকামানো চকচকে এলিট দেখতে লোকদের অধিক পছন্দ করবেন। শিশুটি তখনো মা-বাবার বিধান শিখে উঠতে পারেননি। ফলে মা-বাবার আশাকে নস্যাৎ করে দিয়ে তিনি হয়তো কোলে চড়ে খুশিভাব দেখাচ্ছেন। তখন মা-বাবা ভয়ের প্রণালিটা আসলে শিশুকে মনে করিয়ে দেন না, যেহেতু শিশু তো ভাষাই জানেন না এখনো; তারা বরং আমাকে মনে করিয়ে দেন। মনে করান যে আমার একটা চকচকে চেহারা থাকা কর্তব্য ছিল। এই উদাহরণেও আপনারা ভয়ের শাসন প্রণালিটি বুঝতে পারবেন।

শ্রমিক শ্রেণির স্বাস্থ্য অসচেতনতা নিয়ে অনেক গালমন্দ করতে শুনেছেন করোনার কালে। বস্তুত, শ্রমিক শ্রেণির মানুষজন ‘অচেতন’ বিধায় রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াননি। তারা ঘুরে বেড়িয়েছেন তাদের নিরুপায় শ্রম বিক্রি করার জন্য, এবং অবশ্যই মধ্যবিত্ত ঘর গেরস্থালিতে জিনিসপত্র জোগান দেওয়ার জন্য; কিন্তু তাদের সেইরকম আক্রান্ত, সন্ত্রস্ত, বিলাপমুখর দেখা যায়নি যতটা দেখতে পেলে মধ্যবিত্ত চিত্ত শান্তি পেত। ফলে এই গালমন্দটা যতটা আক্রান্ত হবার ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণির মানুষজনকে বাহক কল্পনা করে, ততটাই একটা ভয়ের শাসনপ্রণালির মধ্যে যথেষ্ট ভীত হিসেবে তাদের প্রত্যক্ষ করতে না পারার কারণে ঘটেছিল। 

সামগ্রিক করোনাকালে এই শ্রেণিগত ক্রীড়াময়তাটি আমার অত্যধিক উপভোগ্য লেগেছিল। কিছু অন্তর্গত বিষাদ ছিল। নিজ শ্রেণির কিছু স্থূল বিচারবোধ, কিছু বিলাপ, অবসরের আর্ট-কালচার চর্চা করার বাতিক ইত্যাদি নিয়ে বিরক্তিও ছিল। আর ছিল এই ক্রীড়াময় সম্পর্ক নিয়ে দারুণ উপভোগের বোধ। এখন যে সবই প্রায় অতীত কাল দিয়ে বলছি, তা বিজ্ঞানকে সম্মান দেখিয়ে। 

যেহেতু ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে, মনুষ্য শরীরে দেবার জন্য তা বাজারে এসেছে, বাংলাদেশ সরকার প্রাইভেট করপোরেশনকে সেগুলো দেখভাল করার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, ফলে করোনাকে সাম্প্রতিক অতীতকালের বিষয়বস্তু হিসেবে দেখছি আমি। এটাকে ইতিবাচক মন হিসেবে দেখা উচিত। গুরুত্ব লাঘবের অভিযোগ করা ঠিক হবে না আমার বিরুদ্ধে, যেমনটা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য-অসচেতনতার অভিযোগও অমূলক ছিল। বিজ্ঞানী আর তাদের দোসর ওষুধ কোম্পানির ওপর বিশ্বাস স্থাপনই বরং আমাদের কর্তব্য! 

নিয়তি-ভবিতব্য নাকি বাস্তবতার পাটাতন!

এই যে ভয় না পাবার বোধ এটি একটি অনুভূতি হতে পারে; আবার রাজনৈতিক-ঘোষণাপত্র বা মেনিফেস্টো হতে পারে। কিংবা আরও সুনিশ্চিত করে বললে, যুগপৎ অনুভূতি আর মেনিফেস্টো দুই-ই হতে পারে। আমি সুনিশ্চিত যে, অনুভূতি আর ঘোষণার মধ্যকার সম্পর্ক দ্বান্দি¦ক। ঘোষণা করতে-করতে অনুভূতি গজাতে পারে, আবার অনুভূতি আছে তাই ঘোষিত হতে থাকতে পারে। জটিল এই সম্বন্ধটার ইতিহাস মনুষ্য আচরণের ও ভাষা আবিষ্কারের সুদীর্ঘ জটিল পরিক্রমার মধ্যেই দেখতে হবে বলে আমি মনে করি; কিন্তু প্রাণঘাতী সর্বব্যাপী ভাইরাসে ভয় না-পাবার কারণ কী থাকতে পারে সেটির ব্যাখ্যা করতে গিয়েই এই প্রসঙ্গের অবতারণা। আগেই বলতে চেষ্টা করছিলাম, যতটা দৈবাৎ বলে মনে হয় মৃত্যু কিংবা ব্যাধি সকল সময়ে ততটা দৈবাৎ নয় বরং, কিছু সামাজিক-রাষ্ট্রিক প্রণালি লিপিবদ্ধই থাকে। এতটা শক্তিশালী সেই লিপিবদ্ধতা যে তা অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা মনে হতে পারে। তাহলে নিয়তি বা অদৃষ্ট বা ভবিতব্যকে সর্বদাই ঈশ্বরের রাজ্য হিসেবে দেখার দরকার নেই। তা মনুষ্যরাজ্যও বটে। 

যারা এই পর্যন্ত এসে সংশয় বোধ করছেন, তাদের সবিনয়ে ভাবতে অনুরোধ করি যে, এই পত্রিকার পাঠকবৃন্দ, কিংবা নিবন্ধকাররা যে সহজে আর্সেনিক দূষণে মারা যাবেন না এটা জানবার জন্য কি আমাদের ঐশী অদৃষ্ট অবলম্বন করার দরকার আছে? আমরা কি জানি না যে, উত্তরবঙ্গের সুলভ পানীয়ের অনুসন্ধানকারী গরিব মানুষের তুলনায় ফ্ল্যাটবাড়িতে বসবাসকারী মানুষজন আর্সেনিকের শিকার হবার সম্ভাবনা কম রাখেন? আমরা কি জানি না যে, কলেরা বা ডায়রিয়াতে মধ্যবিত্ত মানুষদের আক্রান্ত হবার, কিংবা মৃত্যুবরণ করার সম্ভাবনা কম? আমরা কি জানি না অপুষ্টিজনিত অসুখগুলো কারখানার শ্রমিকদের আর আধপেটা কৃষি মজুরদের বেশি বাঁধবে? আমরা কি জানি না যে, ফুসফুসের সংক্রমণ রোগগুলো বাসের কন্ডাকটর, লেদ মেশিনের কারিগর কিংবা ইটের ভাটার শ্রমিকদের বাধারই সম্ভাবনা বেশি? নাকি আমাদের সন্দেহ আছে যে পুরান ঢাকার রাসায়নিক ছোট কারখানাগুলোতে পুড়ে মরার সম্ভাবনা গরিবের ১৬ বছরের বাচ্চাটারই বেশি, এবং মধ্যবিত্ত বাচ্চাদের নাই? রানা প্লাজাতে বা তাজরীন গার্মেন্ট কারখানাতে কিছু সচ্ছল মানুষ মারা পড়েছিলেন; কিন্তু আমরা কি লক্ষ্য করিনি যে ওখানে গরিব মানুষজনই ছিলেন? আমাদের কি সন্দেহ আছে, আবার কখনো হবে যখন, তখন কারা মারা পড়বেন?

এইসব বিস্তর সুনিশ্চিত মৃত্যুফাঁদ জানাজানির পরও রোগ ও মৃত্যু নিয়ে অনিশ্চয়তার হেঁয়ালি রচনা করা একটি সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণির। এটি এক ধরনের পলায়নপরতা, কিংবা এমনকি সচ্ছলতার অপরাধবোধ। এর থেকে অনেক জরুরি আচরণ এইসব বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া। 

ভ্যাকসিনের ঘোষণা এসেছে। ভ্যাকসিনও সম্ভবত চলে এসেছে। ভ্যাকসিনের আন্তর্জাতিক লড়াই, হৈচৈ ও ঝইঝগড়া কমবেশি প্রায় ভাইরাসটি আবিষ্কারের দু-এক মাসের মধ্যেই শুরু হয়েছে। বৈশ্বিক ওষুধ বাজারের বলবান হুংকার, মনুষ্য আতঙ্ক ও স্বস্তি নিয়ন্ত্রণের অভ্যাস আর মুনাফার পাটিগণিত ছাড়া নাগাল পাওয়া নিয়ে আমার বিশেষ কোনো অনুভূতি কাজ করেনি। করেনি, কারণ আজ করোনামুক্তি ঘটলেও কালকে নতুন ভাইরাসের আতঙ্কে থাকতে হবে, ঠিক যেমনটি সোয়াইন বা নিপাহ নিয়ে ছিল, সার্স বা ডেঙ্গু নিয়ে ছিল; আগের শতকগুলোতে যেমন ম্যালেরিয়া বা গুটিবসন্ত নিয়ে ছিল। 

প্রাণঘাতী ভাইরাস হোক আর যুদ্ধ হোক আর সিনথেটিক খাদ্যবাজার হোক, আতঙ্কে থাকা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে পড়তে পারে। তা ছাড়া আরেকটি কারণও আছে। শতেক রকম অব্যবস্থা আর সম্ভাব্য দুর্নীতি থাকার পরও, আমার জানা অসম্ভব নয় যে, বাসার দারোয়ান, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের মালী, কিংবা তাজরীনের কর্মচারীর থেকে সুইটা আমি আগে নিতে পারব। বাসায় গোঁয়ার্তুমি করে বসে না থাকলে এই সুরক্ষার ব্যবস্থা ‘স্বাভাবিক’ হিসাবে বিদ্যমান আছে। এই ‘স্বাভাবিকতা’ মৃত্যু আতঙ্কের থেকেও ভীতিপ্রদ। 

লেখক : অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh