শহীদ মিনার: আমাদের প্রেরণার মিনার

প্রতিভা মুৎসুদ্দি

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:৩৪ এএম

শহীদ মিনার এ দেশের সব সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস। বায়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তর, সত্তর, একাত্তর- শত সংগ্রামের শত সহস্র, লক্ষ লক্ষ শহীদের প্রতীক এই শহীদ মিনার। এ আমাদের জাতিসত্তার জাগরণের প্রতীক, বাঙালির জাতীয়তাবাদের প্রতীক। 

শহীদ মিনার আমাদের হাজার বছরের বাংলা ভাষা, সাহিত্য, বাংলা বর্ণমালার প্রতীক, শহীদ মিনার বাঙালির সংস্কৃতির প্রতীক। তাই তো বাঙালির শত্রু  বারবার এ মিনার ধ্বংস করতে চেয়েছে। অথচ কী আশ্চর্য- যা কিছু আমাদের নিজস্ব তাকেই পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে, দিতে হয়েছে রক্ত, করতে হয়েছে আত্মত্যাগ। 

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বাঙালির দাবি ছিল বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা নয়, অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার। বাংলাভাষা ছিল পাকিস্তানের সমগ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় শতকরা ছাপ্পান্ন জনের, গণতান্ত্রিক নীতিমালা অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা। তুর্কি শব্দ ‘উর্দি’ থেকে ‘উর্দু’ এসেছে। ইংরেজ আমলে উর্দু ভাষার বিকাশ ঘটে। উর্দু উত্তর ভারতের হিন্দু-মুসলিম অভিজাত শ্রেণির ভাষা। সে হিসেবে এ ভাষা পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলের ভাষা নয়। তদানীন্তন পাকিস্তানের পাঁচটি প্রধান ভাষা- বাংলা, পশতু, বালুচ, সিন্ধু ও পাঞ্জাবি। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার একগুঁয়েমি করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা রূপে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে সবার ওপর।

১৯৫২ সাল। আমি তখন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত সেচ্ছাসেবক দলে কাজ করি। এ সময়েই চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের হয়ে ভাষা আন্দোলনে যোগ দিই।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সমগ্র চট্টগ্রামে স্কুল-কলেজে হরতাল পালন করা হয়। আমরা একটি ট্রাকে করে প্রতিবাদ মিছিল করি। প্রথমে মিছিলটি নিয়ে ডা. খাস্তগীর স্কুলে যাই। স্কুল গেটের কাছে স্লোগান দিলে হালিমার নেতৃত্বে কিছু ছাত্রী বেরিয়ে আসে। এরপর নন্দনকানন স্কুল, গুলজার বেগম স্কুল, কুসুম কুমারী স্কুল ও আরও কয়েকটি স্কুল ঘুরে কলেজে ফিরে আসি। দুপুরের দিকে বের হয় ছাত্র-জনতার বিশাল মিছিল। এই মিছিলে শ্রমিক শ্রেণি, বিশেষ করে রেল ও দোকান শ্রমিক-কর্মচারী যোগদান করে।

ঢাকার রাজপথে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিকাল ৩টার দিকে গুলি চলে ছাত্রদের ওপর। কয়েকজন নির্মমভাবে হতাহত হওয়ার সংবাদ চট্টগ্রামসহ গোটা দেশে প্রচার হতে সময় লাগেনি। এ সময়ে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী জলবসন্তে আক্রান্ত। তার কাছে পৌঁছাল সেই নির্মম সংবাদ।

রোগশয্যায় থেকেই তিনি ২১ ফেব্রুয়ারিতে গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে লিখলেন জ্বলন্ত লাভার মতো এক দীর্ঘ কবিতা- ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি।’

একটু সেরে উঠতেই তিনি চট্টগ্রাম জেলা চষে বেড়িয়েছেন প্রতিক্রিয়াশীল সরকার ও তাদের সাম্প্রদায়িক দর্শনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে। লালদীঘি ময়দানে সেদিন শ্রমিকদের পূর্ব নির্ধারিত জনসভা হওয়ার কথা ছিল। ছাত্র-জনতার কণ্ঠে ছিল বিদ্রোহের আগুন। একটি কবিতা যে কিভাবে ভাষা আন্দোলনের প্রতিনিধি হয়ে সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল, তা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে জ্বলন্ত উদাহরণ। 

সদ্য লেখা কবিতাটি স্বয়ং কবিরই পাঠ করার কথা ছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি সভায়; কিন্তু তার অসুস্থতার কারণে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সফলতার সাথে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন শ্রমিক নেতা চৌধুরী হারুন-উর-রশীদ। তার আবৃত্তি করা সেই কবিতা জনতার মাঝে বিদ্রোহের জোয়ার বইয়ে দিয়েছিল। সেই ময়দানে কবিতা শোনার পর জনতা আওয়াজ তুলেছিল- ‘চল চল ঢাকা চল।’

সেদিন লালদীঘি ময়দানের জনসভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন চট্টগ্রামের মুসলিম লীগের নেতা রফিউদ্দিন সিদ্দিকী। তার পাশে বসেছিলেন আব্দুল হক দোভাষী ও নূর মোহাম্মদ এম সি এ। সভায় ফজলুল কাদের চৌধুরী ও তদানীন্তন পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য শিল্পপতি এ কে খান উপস্থিত ছিলেন। পরে জানা গিয়েছিল ফজলুল কাদের চৌধুরী তার বিপুলসংখ্যক কর্মী দিয়ে মঞ্চের চারপাশ ঘিরে রাখেন। তাদের কাজ ছিল ‘জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে সভা পণ্ড করা; কিন্তু সেদিন কোনো অঘটন ঘটেনি হয়তো সকলের সচেতনতার কারণে। পক্ষ-বিপক্ষ একই জনসভায় উপস্থিত থাকলেও তা সফলভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। 

এই জনসভা থেকে আমরাও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ফিরেছিলাম ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের মন্ত্র নিয়ে। সে পবিত্র মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই আমরা সংগ্রাম করে ছিলাম। শহীদের রক্তে ভেজা শহীদ মিনার তাই আমাদের সংগ্রামের প্রতীক, সৃষ্টির প্রতীক। শহীদ মিনার আমাদের প্রেরণার মিনার।

লেখক: ভাষাসৈনিক ও শিক্ষাবিদ

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh