রাবেয়া আশরাফী পিংকি
প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৪৭ এএম
বিগত ৩১ বছরের মধ্যে গত বছর চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক সবচেয়ে কঠিন অধ্যায় অতিক্রম করেছে, যেখানে কোনো ভালো সংবাদ ছিল না। সত্যি কথা বলতে- গত বছরটি চীনের সঙ্গে কোনো দেশের ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, এমন নজিরও দেখা যায়নি। বরং অস্ট্রেলিয়া থেকে ভারত, মঙ্গোলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) বিভিন্ন দেশে বিচ্ছিন্নভাবে সম্ভাব্য মিত্র তৈরি হলেও প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোকে শত্রুতে পরিণত করেছে। আগেও বিশ্ব দরবারে চীন খুব একটা জনপ্রিয় ছিল না। এবার দেশটি আরও অজনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
উহানে মহামারি
করোনাভাইরাস মহামারির প্রকোপ পুরো বিশ্বকেই বদলে দিয়েছে। এই ভাইরাসের উৎপত্তি চীনের শহর উহান থেকে। তবে এ ভাইরাসের সৃষ্টি হলো কীভাবে, তা এখন পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে জানা যায়নি। কারণ এ ক্ষেত্রে বাইরের কোনো দেশের তদন্ত পরিচালনায় চীন সহযোগিতা করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে বলা হয় ২০১৯ সালের আগস্ট মাস থেকেই উহানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। চীনের পক্ষ থেকে এ জরিপ প্রতিবেদনটিকে ‘অবিশ্বাস্যরকম হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে অনেকেরই ধারণা- উহানে ভাইরাসটির উৎপত্তি হয়নি, বরং কাছাকাছি এক উপশহর থেকে এটি ছড়িয়ে পড়ে; যেখানে মানুষ ও প্রাণীদের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক বিষয়।
অন্যদিকে, উহানের স্থানীয় প্রশাসন ভাইরাসটির বিষয়ে জানলেও তা গোপন রেখেছিল। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকেও বিষয়টি লুকিয়ে রাখা হয়। আর ততদিনে সমস্যা অনেক বড় আকার ধারণ করে। কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল উহান। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে- শহরটিতে করোনাভাইরাসের কারণে তিন হাজার ৮৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে ধারণা করা হয়, মৃতের সংখ্যা আরও বেশি হবে। সংক্রমণ প্রতিরোধে একপর্যায়ে সমগ্র চীন থেকেই উহানকে বিচ্ছিন্ন করা হয়; কিন্তু এরপরও পুরো চীনে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে।
চীন কীভাবে মহামারির প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলো, এটি সম্ভবত ২০২০ সালের সবচেয়ে বড় বিস্ময়। বিশ্বে এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় লকডাউনের সুবাদে উহানে মহামারি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। চীনের প্রায় সব অঞ্চলই এখন উন্মুক্ত। সেখানকার মানুষজন ভিড়ের মধ্যেই মাস্ক ছাড়া চলাফেরা করছে। করোনাভাইরাসের সময়ে ক্ষমতাসীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) সুনাম ক্ষুণ্ণ হওয়ার পরিবর্তে আরও মজুবত হয়। ব্যাপকহারে সেন্সরশিপ, প্রপাগান্ডা এবং বল প্রয়োগের পরও দেশটির সাধারণ মানুষ এ নিয়ে কিছু বলেনি।
তবে নিজ দেশে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে যতটা সচেতন, অন্যদেশের বেলায় চীনকে ততটাই উদাসীন থাকতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। চীনের পর্যটকদের জন্য দেশটিকে তাদের সীমান্ত খোলা রাখতে হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম সুযোগ হয়ে উঠেছে। চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস এখন পুরো বিশ্বকেই বদলে দিয়েছে। ইতিমধ্যে বিশ্বে কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দশ কোটি ছাড়িয়েছে। আর এ ভাইরাসটিতে সংক্রমিত হয়ে মারা যান ১৮ লাখেরও বেশি মানুষ। বেশিরভাগ দেশে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে, আবার অনেক দেশে ভাইরাসটি নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে।
হংকংয়ের স্বশাসন হরণ
গত বছর চীনের সবচেয়ে বড় ঘটনার মধ্যে হংকংয়ের স্বশাসন হরণ অন্যতম। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে চীনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ২৩ বছর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বশাসন উপভোগ করেছে হংকং। এরপর জুনে নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন কার্যকর হয়। আইনটি হংকংয়ের জন্য আসলেই উদ্বেগজনক। ওই আইনে বলা হয়- বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন করতে বিদেশি বাহিনীর সঙ্গে আঁতাতমূলক যে কোনো কাজ শাস্তিমূলক অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং এ ধরনের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- হংকংয়ের আইনসভাকে পাশ কাটিয়ে যে কোনো নিরাপত্তাসংক্রান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা চীনকে দেওয়া হয়েছে এ আইনে। এ ছাড়া হংকংয়ে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হবে, যার উপদেষ্টা নিয়োগ দেবে বেইজিং। হংকংয়ের যেসব নাগরিক চীনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, চীনের পতাকাকে অবমাননা করছেন, স্বাধীনতা চাইছেন- তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব থাকবে ওই জাতীয় কমিটির ওপর। এ ছাড়া হংকংয়ের সন্দেহভাজন আসামিকে চীনে নিয়ে বিচার করারও সুযোগ পাওয়া যাবে নতুন আইনের বদৌলতে। অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদ-। এর মানে বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্র হংকং সরাসরি চলে যাবে চীনের নিয়ন্ত্রণে। আইনটির বিরুদ্ধে হংকংবাসী চরম আপত্তি জানিয়ে আন্দোলনে ফুঁসে ওঠে। আর সে সময় গণতন্ত্রপন্থীদের ব্যাপকহারে ধরপাকড় করা হয়। নভেম্বরে হংকংয়ের আইনসভা থেকে অনেক গণতন্ত্রকামী রাজনীতিবিদকে বহিষ্কার করা হয়, আবার অনেকে পদত্যাগও করেন। তবে এ নিয়ে উত্তেজনার রেশ হংকংয়ের গণ্ডি ছাপিয়ে অন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে হংকং ইস্যুকে কেন্দ্র করে ব্রিটেন ও চীনের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছে। সাবেক ব্রিটিশ কলোনি হংকংকে ১৯৯৭ সালে নিজেদের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার সময় চীনকে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। তখন ‘এক দেশ দুই নীতি’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ‘জয়েন্ট ডিক্লারেশন’ নামক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এ চুক্তির আওতায় হংকংয়ের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে বলেও সম্মতি দেয় চীন। নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য বেইজিংয়ের ওপর ব্রিটেন নাখোশ হয়। এতদিন ধরে বেইজিংকে দিয়ে আসা প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক ছাড় বন্ধ করে দেয় লন্ডন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ঘোষণা দেন, আবেদন করার মাধ্যমে গোটা হংকংবাসী যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পেতে পারেন।
উগ্র-জাতীয়তাবাদীদের হাতে দেশের চাকা
চীনের ভূসীমানায় বসবাস করা জাতিগত সংখ্যালঘুদের নির্মূলের চেষ্টা ২০২০ সালজুড়ে লক্ষ্য করা গেছে। উইঘুর, তিব্বতী এবং মঙ্গোলীয়দের ওপর দমন-নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে দেশটি। উইঘুরদের বন্ধ্যত্বকরণ পরিকল্পনা, বাধ্যতামূলক শ্রম এবং নির্যাতনের নতুন খবর প্রকাশ হয়েছে। সম্প্রতি জানা যায়, উইঘুর ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর নারীদের সন্তান জন্মদান নিয়ন্ত্রণ করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে চীনা প্রশাসন। তারা যেন সন্তান জন্মদানের কোটা অতিক্রম না করে সেজন্য নারীদের গর্ভধারণ এড়াতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। উইঘুর সম্প্রদায়ের নারীদের দুটির বেশি সন্তান জন্ম দেওয়ার নিয়ম নেই। সেখানে জন্মনিয়ন্ত্রক ওষুধ এবং স্টেরিলাইজেশন সার্জারি করাতে বাধ্য করা হচ্ছে। এ ছাড়া সেখানকার নারীদের প্রতি দুই মাস অন্তর বাধ্যতামূলক গাইনি পরীক্ষা দিতে হয় এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের থেকে গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করাতে হয়। এ ছাড়া ১০ লাখেরও বেশি উইঘুর পশ্চিমাঞ্চলীয় শিনজিয়াংয়ের কয়েকটি বন্দিশিবিরে আটক।
চীনের আরেক স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তিব্বতেও চীনা আগ্রাসন অব্যাহত রয়েছে। এর পাশাপাশি মঙ্গোলিয়ার সংস্কৃতির ওপর আঘাত হেনেছে চীন। গত বছর আগস্টে চীনা সরকার মঙ্গোলীয় অধ্যুষিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের একাডেমিক কারিকুলামের ওপর নজরদারির ঘোষণা দেয়। চীন সরকারের আরোপিত নতুন নিয়ম অনুযায়ী, অঞ্চলটিতে মঙ্গোলীয় ভাষায় শিক্ষাদান বন্ধ রেখে মান্দারিন ভাষায় সাহিত্য, রাজনীতি ও ইতিহাসের মতো বিষয় শেখানো হবে। এই কর্মসূচিকে চীন সরকার ‘সাংস্কৃতিক সম্পৃক্তকরণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। নিজেদের নীতির পক্ষ টেনে চীন সরকার বলছে, এটি মঙ্গোলীয়দের উচ্চশিক্ষা ও চাকরি পেতে সুবিধা দেবে। তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এটি চীনের আগ্রাসী নীতির একটি অংশ। আর চীনের এ নতুন ভাষানীতির প্রতিবাদে মঙ্গোলীয় শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসেন। অভিভাবকরা বলছেন, নতুন নীতি গ্রহণ না করে তারা নিজেদের সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে বাড়িতে বসিয়ে রাখবেন।
অন্যদিকে, চীনে নতুনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী মনোভাব কূটনৈতিক পর্যায়েও ছড়িয়েছে। চীনা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান অন্যান্য কূটনীতিবিদদের সঙ্গে নিয়ে চীনের সমালোচনা করা দেশগুলোকে সমালোচনা করেছে ও হুমকি দিয়েছে। চীনা কূটনীতিকরা অস্ট্রেলিয়াকে সরাসরি হুমকি দিয়েছে, দেশটির বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালিয়েছে।