ভারতীয় ঋণের সড়কে অস্তিত্ব সংকটে কৃষি

আনছার আহাম্মদ

প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:১৭ এএম

আশুগঞ্জ নৌ-বন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত চারলেন মহাসড়ক প্রকল্পের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে ‘আশুগঞ্জ-পলাশ কৃষি সেচ’ খাল। সড়ক চওড়া করতে গিয়ে ভরাট হয়েছে খাল। এতে ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে চলতি মৌসুমেই সেচ সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ভারতীয় ঋণে (এলওসি) আশুগঞ্জ-সরাইল-ধরখার-আখাউড়া ট্রানজিট মহাসড়ক চারলেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। নৌ প্রটোকল অনুযায়ী, এ রাস্তা ব্যবহার করে কলকাতা থেকে নদীপথে আসা পণ্য আশুগঞ্জ নদী বন্দর থেকে আখাউড়া হয়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে যাবে। তিন হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন ৫০.৫৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মহাসড়ক প্রকল্পে ভারত ঋণ দিচ্ছে দুই হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। বাকি এক হাজার ৩১২ কোটি জোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ। 

তিনটি প্যাকেজে এ মহাসড়কের কাজ চলছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) এ প্রকল্পের প্রথম প্যাকেজে নদী বন্দর থেকে সরাইল মোড় পর্যন্ত ১২.২১ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। মহাসড়কের দু’পাশে ধীরগতির যান চলাচলে পৃথক দুটি লেন থাকবে। এ প্যাকেজ ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অংশ। সেচ খালের সঙ্গে ‘সংঘর্ষ’ বেঁধেছে এ অংশে। সড়ক চওড়া করতে গিয়ে ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল ভরাট চলছে। কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ইতিমধ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে চিঠি দিয়ে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মেঘনা নদী থেকে তোলা পানি আশুগঞ্জ তাপভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের পর সেচ খাল হয়ে আশুগঞ্জ, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর এবং নবীনগর উপজেলার ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে কৃষি কাজে ব্যবহƒত হয়। ৪০ বছর ধরে সাশ্রয়ী এ সেচ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ কারণে বিকল্প সেচ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি এসব এলাকায়। সেচ খাল বন্ধ হলে কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে। 

গত ৭ ডিসেম্বর বিএডিসির চেয়ারম্যান সায়েদুল ইসলাম কৃষি সচিবকে দেওয়া চিঠিতে জানিয়েছেন, রাস্তার পাশে ‘বরোপিট ক্যানেল’-এর বিভিন্ন স্থান বালি দিয়ে ভরাট করে চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণ কাজ চলছে। বিষয়টির সমাধান না হলে চলতি শুষ্ক মৌসুমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সেচ পরিচালনা সম্ভব হবে না। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কৃষকবান্ধব এই সেচ প্রকল্প হুমকির সম্মুখীন হবে। 

বিএডিসি এবারই প্রথম নয়, মহাসড়ক প্রকল্পের শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছে। গত জুনে খাল ও মহাসড়কের বিরোধ মেটাতে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। এই ‘বিরোধ’ মেটাতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়কের বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাকির হোসেনকে প্রধান করে কমিটি গঠিত হয়। গত অক্টোবরে ৯ সদস্যের কমিটি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে। 

কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আশুগঞ্জ-আখাউড়া মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে বিদ্যমান সড়কের পার্শ্ববর্তী জমি অধিগ্রহণ করেছে সওজ। অধিগ্রহণ করা জমিতে বিএডিসির সেচ খাল অবস্থিত। বিএডিসির প্রস্তাবÑ মহাসড়কের পাশে ধীরগতির লেনের পর ‘রিটেনিং ওয়াল’সহ আট মিটার প্রশস্ত খাল নির্মাণ করতে হবে; কিন্তু বিদ্যমান জমিতে ছয় লেনের সড়ক নির্মাণের পর আট মিটার জায়গা নিরবচ্ছিন্নভাবে অবশিষ্ট থাকবে না। সওজ বলছে, ১১.৬ কিলোমিটার মহাড়কের পাশে বিচ্ছিন্নভাবে আড়াই কিলোমিটার খাল রাখা সম্ভব হবে। 

চার মিটার প্রশস্ত ও দুই মিটার গভীর খাল রাখার প্রস্তাব করেছে সওজ। তবে বিএডিসি বলছে, এখনই পানি রেশনিং করতে হচ্ছে। খাল থেকে তিন এলাকায় সপ্তাহে ২+২+৩ দিন নীতিতে পানি দেওয়া হচ্ছে। সেচ এলাকায় বোরো ধানের রোপণ ও মাড়াই মৌসুম একইসঙ্গে হওয়ায় সাত দিনই পানি সরবরাহ করা প্রয়োজন; কিন্তু পানির উৎসও সংকোচিত হয়েছে মহাসড়ক প্রকল্পের কারণে। আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জলাধার থেকে পানি আসে সেচ খালে। জলাধারটির একটি অংশ মহাসড়ক সম্প্রাসারণে চলে যাচ্ছে। জলাধারে ইতিমধ্যে বালি ভরাট শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগও (পিডিবি) নতুন ভবন নির্মাণে জলাধার ভরাট করছে। এ কারণে সেচের পানি সংকট দেখা দিয়েছে। ভরাট অপসারণ করতে জলাধার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ জানিয়েও সাড়া পায়নি বিএডিসি। বরং পানির গতি বাড়াতে কমিটি সুপারিশ করেছে, জলাধারের উচ্চতা বাড়াতে। সওজ বলছে, খাল নিয়মিত পরিষ্কার ও নাব্য ধরে রাখলে চার মিটার প্রশস্তেই প্রয়োজনীয় সেচের পানি পাওয়া যাবে। তবে বিএডিসির চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সেচ কার্যক্রম পরিচালনার সমস্যা সমাধানে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সওজ এবং পিডিবি আন্তরিক নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়।’ গত জুনে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় ভরাট করা জলাধার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে গত অক্টোবরে সমস্যা সমাধান কমিটির সভায় পিডিবি প্রতিনিধি জানান, জলাধারের বালি অপসারণ করা হলে সওজকে সড়ক সম্প্রসারণের জন্য জমি দেওয়া সম্ভব হবে না।

বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের টারবাইন ঠান্ডা রাখতে মেঘনা নদী থেকে যে পানি ওঠানো হয়, তা ব্যবহারের পর সেচ খালে যায়। বর্জ্য পানি হলেও এতে রাসায়নিক উপাদান না মেশানোর কারণে কৃষিকাজে ব্যবহারের উপযোগী। নদীর পানি সেচে ব্যবহার হওয়ায় জমির উর্বরতা বাড়ে, ফসল ভালো হয়। ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে হয় না। এতে জ্বালানি সাশ্রয় ও পরিবেশ রক্ষা হচ্ছে। ৩৪ হাজার কৃষক নামমাত্র মূল্যে সেচ সুবিধা পান এ প্রকল্প থেকে। বিএডিসির দাবি, আশুগঞ্জ-পলাশ সেচ প্রকল্পটি সারাদেশে সেরা। 

সেচ খাল রক্ষার দাবিতে একাধিকবার মানববন্ধন করেছেন কৃষকরা। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এক সভায় কৃষক প্রতিনিধিরা খালে গভীরতা ও প্রশস্ততা ঠিক রেখে মহাসড়ক নির্মাণ করার দাবি জানান। জাতীয় কৃষক সমিতির জেলা আহ্বায়ক মো. নাছির মিয়া বলেন, ‘প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করে সেচ খালটি সচল রাখা হোক। হাজার হাজার কৃষকের জমি অনাবাদি থাকবে খাল বন্ধ হলে।’

কমিটির প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়, সড়ক নির্মাণের পর যে অংশে খাল সচল রাখা সম্ভব এবং যেখানে ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে, তা নিরুপণ করতে পারে সওজ। টো-ওয়াল এবং রিটেনিংয়ের মাধ্যমে খালের জন্য জায়গা রাখার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। খালের গভীরতা বৃদ্ধি, জলাধারের উচ্চতা বাড়ানোরও সুপারিশ করা হয়। 

তবে গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে বিএডিসি চিঠিতে জানিয়েছে, খাল ভরাট অব্যাহত রয়েছে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বোরো চাষের সেচ চালু হয়। এবার তা অনিশ্চিত। তবে চলতি মাসে মহাসড়ক প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আকবর হোসেন পাটোয়ারী চিঠিতে জানিয়েছেন, সেচের পানি প্রবাহমান রাখতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হচ্ছে। কৃষি কাজ ব্যাহত না করে সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে। 

আশুগঞ্জ নদী বন্দর থেকে সরাইল অংশ ধীরগতির দুই লেন এবং চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৫৭২ কোটি টাকা। চার লেনে উন্নীত হওয়ার পর মহাসড়কটির প্রশস্ততা হবে ১১৪ ফুট। ৫০ কিলোমিটার মহাসড়কে ১৬টি সেতু, দুটি রেলওয়ে ওভারপাস, তিনটি আন্ডারপাস, ৩৬টি কালভার্ট, ১০টি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh