ফিরে দেখা ২০২০
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:২৬ এএম | আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ০১:১৯ পিএম
ছবি: ইউএনএ
ইতিহাস থেকে বিদায় নিলো আরো একটি বছর। মহামারি করোনাভাইরাসের ভায়াল ছোবলে বিদায়ী বছর শোকের বছর হিসেইে চিহ্নিত থাকবে বিশ্ববাসীর মাঝে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে বিদায়ী বছর স্বজন হারানোর বছর।
চলতি বছর গত এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে করোনায় তিন শতাধিক প্রবাসী বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। কমিউনিটি নেতা, সামাজিক সংগঠন, মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, বিভিন্ন মিডিয়া আর বার্তা সাংস্থা ইউনাইটেড নিউজ অব আমেরিকার (ইউএনএ) অনুসন্ধানে এই তথ্য জানা গেছে।
এদিকে করোনার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে আবার নতুন করে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে গোটা কমিউনিটি। নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বাংলাদেশিদের ঘরে ঘরে এখন হানা দিয়ে ফিরছে এই মরণব্যাধি। তবে করোনার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি অধ্যুষিত অঙ্গরাজ্য নিউইয়র্ক, মিশিগান আর ক্যালিফোর্নিয়ায়। এই তিন অঙ্রাজ্যের অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
মহামারি করেনায় অনেক পরিবার হারিয়েছেন একাধিক সদস্য। কেউ হারিয়েছেন মা-বাবা, কেউ বা ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী। আবার কেউ হারিয়েছেন বাড়ির একমাত্র উপার্জনকারী। করোনায় পিতা-পুত্র আর দুই সহদরের মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। মৃতের তালিকায় আছেন মুক্তিযোদ্ধা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সমাজসেবীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। বলা যায় বিদায়ী ২০২০ সাল ছিলো শোকের বছর। ছিলো ঘরে ঘরে স্বজন হারানোর বেদনা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কমিউনিটির অনেকেই করোনায় মৃত্যু লোকলজ্জার কারণে গোপন রাখতে চান। যার ফলে মৃত্যু বা আক্রান্তের সঠিক তথ্য-পরিসংখ্যান পাওয়া খুবই কঠিন। কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্টরা মৃত্যুর এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে বলে মত প্রকাশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ২৮৫ জন বাংলাদেশির মৃত্যুর তথ্য জনসমক্ষে এসেছে। এই পরিসংখ্যান কমিউনিটির বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া।
এদিকে মহামারি করোনার টিকার প্রয়োগ শুরু হলেও থেমে নেই মৃত্যুর মিছিল। প্রথম ধাপে ভ্যাকসিন পাচ্ছেন ডাক্তার, নার্সসহ যারা ফ্রন্ট লাইনে কাজ করছেন কেবল সেইসব লোকজন। সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য হতে কয়েক মাস সময় লাগবে। তারপরও ভ্যাকসিন নিলেই কভিড থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে সেটাও পরিস্কার নয়। বিদায়ী বছরের বিদায়ী মাস ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় অর্ধশত প্রবাসীর মৃত্যু হয়েছে এরমধ্যে নিউইয়র্কে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে। এরপর রয়েছে মিশিগান, নিউজার্সি ও ভার্জিনিয়া। করোনায় আক্রান্ত হয়ে শত শত প্রবাসী নিউইয়র্ক ও মিশিগানসহ বিভিন্ন রাজ্যের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
করোনায় মৃত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে ‘বাংলাদেশ সোসাইটি’র সভাপতি কামাল আহমেদ, সহসভাপতি আবুল খায়ের খয়ের ও কার্যকরী সদস্য বাকির আজাদ, প্রবাসের অন্যতম সামাজিক সংগঠন চট্টগ্রাম সমিতি ইউএসএ’র সভাপতি অব্দুল হাই জিয়া, ছাতক সমিতি ইউএসএ’র সাবেক সভাপতি ও নিউইয়র্কের ব্রঙ্কসের স্টারলিং বাংলাবাজার বিজনেস এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট গিয়াস উদ্দীন, নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের নর্থ শোর এলএইজের প্যাথোলজিক্যাল বিভাগের ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন অব নর্থ আমেরিকার সাবেক সভাপতি ডা. তৌফিকুল ইসলাম, ফটো সাংবাদিক এ হাই স্বপন, সঙ্গীত শিল্পী বীনা মজুমদার, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ইউএসএ’র সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার বিদ্যুৎ দাস, ডা. রেজা চৌধুরী, ডা. শামীম আল মামুন, মোস্তফা আল্লামা, আব্দুস সালাম খান।
মৃতের তলিকায় রয়েছেন- দুদু মিয়া, গোলাম রহমান, কামরুজ্জামান, লুৎফুর রহমান, মাদারিস আলী, মোহাম্মদ জাফর, মনির উদ্দিন, মন্তাজ খান, পেয়ারা হোসেন বেবী, রাশিদা আহমেদ, রওশন আরা ফেরদৌস, এস দুদু, শাহানা আহমেদ তালুকদুর, সানাউর আলী, শামীম খান, আমানুল হক, শহীদুল হায়দার, সাইফুর হায়দার খান আজাদ, শফি হায়দার, শিপন আহমেদ ও ইকবাল হক ভূঁইয়া প্রিন্স প্রমুখ।
ডিসেম্বর মাসে মিশিগানে নিজ বাসায় মারা যান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জন্মভূমি পত্রিকার সম্পাদক ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর বঅর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা আল্লামা (৭৭)। স্থানীয় পুলিশ তার বাসার দরজা ভেঙে লাশ উদ্ধার করে। মৃত্যু পর পরীক্ষায় তার করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসে। মোস্তফা একাই বসবাস করতেন। তার বাড়ী সিলেটের গোলাপগঞ্জে।
গত ২৩ ডিসেম্বর বুধবার মিশিগানে করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর এবাদুর রহমান (৭৪)। তার বাড়ী মৌলভীবাজারের বড়লেখার বর্ণি গ্রামে। এবাদুর রহমানের পুরো পরিবার করোনা আক্রান্ত হয়েছে। তার স্ত্রী ও দুই ছেলে বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠছেন। এবাদুর হ্যামট্রামিক শহরের বাংলাদেশ এভিনিউসহ বায়তুল মামুর মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
এছাড়া করোনা ছিনিয়ে নেয় মিশিগান কমিউনিটির শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ হোসেনের পিতা সানাওর আলী, আওয়ামী লীগ নেতা ও বিশিষ্ট সংগঠক সিরাজম মুনির, দুদু মিয়া, মদরিছ আলী, বড়লেখা সমিতির উপদেষ্টা চুনু মিয়ার মা নেওয়ারুন নেসা ও পিতা মনির উদ্দীন, আনোয়ার হোসেনের মা, বিয়ানী বাজার সমিতির সভাপতি নুরুজ্জামান এখলাসের শ্বাশুড়ি সামসুন নেহার, লুৎফুর রহমান, আব্দুল আহাদ লোদী ও সুফিয়া খাতুন। মারা গেছেন মসজিদের মুয়াজ্জিন মন্তাজ খান।
ডেট্রয়েট শহরের অন্যতম মসজিদ আল ফালাহর খতিব ও বিশিষ্ট আলেম মাওলানা আব্দুল লতিফ আজম জনান, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। মসজিদের ফিউনারেল হোমে কভিড-১৯-এ মৃতদের লাশ আসছে প্রতিনিয়ত। তারা প্রায় প্রতিদিন জানাযা পড়াচ্ছেন।
নিউইয়র্কের জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টার (জেএমসি) আর মিশিগান কমিউনিটির সব থেকে পুরনো মসজিদ মসজিদুর নুরেও প্রায় প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হচ্ছে মৃতদের নামাজে যানাজা। মসজিদ নুরের প্রবীন সদস্য কমিউনিটি নেতা ইকবাল হোসেন চৌধুরী এ তথ্য জানিয়ে বলেন, কেবল ডিসেম্বর মাসেই কম করে ৩০ জন কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন মিশিগানে। -ইউএনএ