ফরহাদ মজহার
প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২০, ০৭:২১ পিএম | আপডেট: ১৬ মে ২০২৩, ০১:০৩ পিএম
ফরহাদ মজহার
১৭ নভেম্বর গরিব-মজলুম-নিপীড়িতের মুর্শিদ, জমিদার-মহাজন-সুদখোর, ব্যাংক-ডাকাত-লুটেরা পুঁজিপতি শ্রেণির ত্রাস মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যু দিবস ছিল। বাংলাদেশে যারা বিদ্যমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার জুলুম এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির ফাঁদ বা খাঁচা থেকে সতেরো কোটি জনগণকে মুক্ত করার কথা ভাবেন, তাদের উচিত ১৭ নভেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর তার জন্মদিন পর্যন্ত শুধু তাকে নিয়ে আলোচনা-সেমিনার ওয়েবিনার করা। কারণ ভাসানীকে গৌণ করে ফেলবার একটা প্রক্রিয়া জারি রয়েছে। এটাকে প্রতিরোধ করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।
ভাসানীর মধ্যে লাল এবং সবুজের যে মিশ্রণ ঘটেছে এটাই আগামী বিপ্লবী মতাদর্শের বাস্তব রূপ। শুধু লাল, কিংবা শুধু সবুজ দিয়ে আমরা কিছুই অর্জন করতে পারব না। আমাদের নতুন বিপ্লবী বয়ান তৈরি করতে হবে। সস্তা বইপুস্তক পড়া বিপ্লবী বকোয়াজি বন্ধ করতে হবে। মানুষকে ‘মানুষ’ গণ্য করতে হবে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, জীব হিসেবে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ দাবি; কিন্তু মানুষ জীব মাত্র নয়। তার আত্মিক বা পরমার্থিক আকুতি আছে। সেই আকুতিগুলো জবরদস্তি দমন করা যায় না। এই প্রাথমিক বিষয়গুলো বুঝলে আমরা মজলুম মেহনতি জনগণকে সংগঠিত করতে পারি।
কথা পরিষ্কার যে, যদি আমরা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণশক্তি নির্মাণ এবং গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই, তাহলে মওলানাকে কেন্দ্রে রেখেই সেটা সম্ভব। ভাসানী বাংলাদেশের রাজনীতিতে লিটমাস টেস্টের মতো। কে তাকে কীভাবে ভাবছে, তা দিয়ে তারা কোন শ্রেণি বা গোষ্ঠীর পক্ষে রাজনীতি করেন তা সহজে বোঝা যায়। তার মৃত্যু দিবসে বড় লেখা লিখতে চাই না। বরং তাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বর্তমান গণ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির সারার্থ পেশ করতে চাই, যাতে মওলানার জিহাদি লাল-সবুজ ঝাণ্ডা বাংলাদেশের রাজনৈতিক আসমানে আরও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ও দীপ্যমান হয়। সেই ক্ষেত্রেও সংক্ষিপ্ত হতে চাই। যারা মওলানাকে কমিউনিস্ট গণ্য করেন আর যারা পীর মানেন তাদের মধ্যে সম্ভাব্য মৈত্রীর ক্ষেত্র পরিষ্কার করার কাজটা মনে করিয়ে দেয়াই যথেষ্ট। বাংলাদেশে বড়সড় পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হলে জনগণের মধ্যে মৈত্রীর জায়গাটা নির্মোহভাবে চিহ্নিত করা দরকার।
১. বাংলাদেশে একদল আছে যাদের কাছে শুধু কমিউনিস্ট ‘লাল ভাসানী’ ভালো, বিপরীতে ইসলামের রবুবিয়াত বা পালনবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ‘সবুজ ভাসানী’ ভালো না। এরা মনে করে ইসলাম নাম মুখে আনাই প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং প্রগতি বিরোধিতা। ওয়ার অন টেরর নামক বিদ্যমান বিশ্বযুদ্ধে এরা বুশ-টনির স্থানীয় বরকন্দাজ হিসাবে কাজ করে। কারণ বাংলাদেশে তারা ইসলামকেই শত্রু জ্ঞান করে। তাদেরই ছানাপোনা হিসেবে হয়ে থেকে তারা প্রভূত আনন্দ অনুভব করে। এদের আমরা সেক্যুলার নামেও চিনি। এদের মধ্যে ভালো মানুষ নেই, সেটা আমি বলব না। এরা লিবারেল ডিমোক্রাসি চায়; কিন্তু বাংলাদেশে সেটা অসম্ভব কেন বুঝতে পারে না। মাঝে মধ্যে মানবাধিকার নিয়ে তারা বাদ-প্রতিবাদ করে। এরা আসলে সাম্রাজ্যবাদী বলয়ের বাইরের কেউ না। ভাসানীর রাজনীতি হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। পিরিয়ড। ফুলস্টপ। সেক্যুলারিজম নামে সাম্রাজ্যবাদের দালাল হওয়া ভাসানীর রাজনীতি না; নিজেদের প্রগতিবাদী প্রমাণ করতে এরা ভাসানীর ‘লাল’টুকু নেয়, ‘সবুজ’টুকু মৌলবাদ গণ্য করে ছেঁটে ফেলতে চায়; কিন্তু যখন ‘সবুজ’টুকু বাদ দেয়, তারা বাংলাদেশের জনগণকেও তাদের রাজনীতি থেকে ছেঁটে দেয়।
এদের ট্রাম্পের খালাতো ভাই বলতে পারেন। যুদ্ধবাজ হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট না হওয়ায় এরা খুব দুঃখ পেয়েছিল। ট্রাম্প নিয়ে এরা ইয়ার্কি করতে খুব ভালোবাসে। এখন ডেমোক্র্যাট বাইডেন অল্প মার্জিনে জিতে যাওয়ায় এদের মধ্যে খুশি খুশি ভাব দেখছি। এরা খেয়াল করেনি, ট্রাম্পের আমলে কোনো ইসলাম প্রধান দেশগুলোর বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধ শুরু হয়নি। তবে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার্স’ নামক যুগান্তকারী আন্দোলন হয়েছে, যার রেশ পৃথিবীব্যাপী ছড়াবে। কারণ সাম্রাজ্যবাদ একই সঙ্গে বর্ণবাদও বটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এখন বিভক্ত। বাইডেন যুদ্ধ ছাড়া কীভাবে মার্কিন অর্থনীতি গোছাবেন সেটা এখন দেখার বিষয়।
ইসলামের কি সমস্যা নেই? আছে। সেটা ইসলামের ঠিক না, সমস্যা আছে ধর্মসর্বস্ব পরিচয়বাদী, সাম্প্রদায়িক বা জাতিবাদী রাজনীতির। তাই উচিত কাজ হচ্ছে ইসলামকে জাতিবাদ ও পরিচয়বাদ থেকে দূরে রাখা। কীভাবে সেটা সম্ভব? জনগণকে মনে করিয়ে দেয়া যে, ইসলাম সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতিবাদ বরদাশত করে না। রক্তবাদ, গোত্রবাদ, বংশবাদ, ভূখণ্ডবাদে ইসলামের কোনো আস্থা নেই। এই আলোকে ইসলামের ইতিবাচক তাৎপর্য ও অর্জনগুলো জনগণকে ধরিয়ে দেয়া জরুরি। যেন জাতিবাদী বা পরিচয়বাদী সাম্প্রদায়িক বিপর্যয় বাংলাদেশে না ঘটে। যেমন, দরকার হচ্ছে জনগণকে বুঝিয়ে বলা আধুনিক ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের গায়ে রাষ্ট্রধর্মের লেবাস পরিয়ে দিলে সেটা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রই থাকে। ইসলাম কায়েম হয় না। সভ্যতার আবর্জনা ‘ইসলাম’ দিয়ে ঢেকে দেয়া কোনো কাজের কথা না। তাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেয়াই কাজ। ইসলামের স্বর্ণ যুগের ভালোমন্দ বিচার করে মানবেতিহাসে তার অর্জনগুলো বুঝে নেয়া এবং অন্যদের বুঝিয়ে দেয়া দরকারি কাজ। ইসলাম মানবসভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফলে ইসলাম শুধু মুসলমানদের মুক্তির জন্য আসেনি। সব মানবজাতির মুক্তির জন্য এসেছে। রবুবিয়াত বা আল্লাহর প্রতিপালক রূপের এবাদতকে রাজনীতির কেন্দ্রে এনে মওলানা বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রতিপালক হিসেবে আল্লা হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আস্তিক ও নাস্তিক ভাগ করে না। ভোরে যখন সূর্য ওঠে, তখন তার আলো শুধু মুসলমান পায় না, সবাই পায়। বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে জীব যখন জীবিত থেকে প্রাণের সেই অধিকার আল্লা রাব্বুল আলামীন হরণ করেন না। তেমনি মেঘ, বৃষ্টি, নদী ও সাগরের জল সবার। রবুবিয়াতের রাজনীতি মানে তার এই প্রতিপালক রূপকে কীভাবে আমরা সমাজে ও ইতিহাসে বাস্তবায়িত করব, সেই দিকেই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।
সতর্ক থাকলে দোষের কিছু নেই, জাতিবাদী ইসলাম বাঙালি জাতিবাদের মতোই ফ্যাসিস্ট রূপ নিতে পারে। ভাসানী তাই ইহকাল বাদ দিয়ে পরকালবাদী মাওলানা, মৌলভিদের অপছন্দ করতেন। তারাও তাকে পছন্দ করত না, এখনো করে বলে মনে হয় না; কিন্তু সেক্যুলাররা সবসময় বোঝাতে চায় ইসলাম মানেই মৌলবাদ। অতএব, ভাসানীর ইসলামও মৌলবাদ থেকে ভিন্ন কিছু নয়। তার মধ্যেও মৌলবাদী প্রবণতা আছে। তাদের আক্ষেপ, তিনি আগে কমিউনিস্ট ছিলেন, পরে ইসলামপন্থি হয়েছেন। সেক্যুলারকুল, যারা এখনো লাল ভাসানীকে ভালোবাসেন; কিন্তু সবুজ ভাসানীকে অপছন্দ করেন, ভাসানীকে তারা আদৌ বুঝেছেন কি না সন্দেহ।
২. এর বিপরীতে আরেকটি ধারা হচ্ছে, যারা মনে করে মওলানা ভাসানীর ঘাড় থেকে সমাজতন্ত্র বা কমিউনিস্টদের ভূত তাড়াতে হবে। ভাসানী তাদের মহব্বতের ধন। আলবৎ। তারাই তার একমাত্র মুরিদ। অতএব, পীর রূপই মওলানা ভাসানীর একমাত্র ছহি রূপ। কমিউনিজম কিংবা সমাজতন্ত্র না। এদের আমরা ‘সবুজ কোম্পানি ভাসানী আনলিমিটেড’ বলতে পারি। এরা ভাসানীর ‘লাল’টুকু চায় না। খালি সবুজটুকু চায়। তার তালপাতার টুপিটা চায়, তার ইহলৌকিক জিহাদ বা শ্রেণি সংগ্রাম চায় না। এদের মধ্যে প্রচুর ভালো মানুষ আছে। সবচেয়ে বড় কথা নিপীড়িত মজলুমদের বিশাল সংখ্যা এই পক্ষেই রয়েছে। ‘আনলিমিটেড’ বলছি কারণ তাদের সংখ্যা বিশাল। ভাসানীকে নিয়ে তাদের স্বপ্ন, লড়াই, ব্যর্থতার, হতাশার কথা কেউই জানতে চায়নি। তারা ইহলোকে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের কারণে ভাসানীর পেছনে লাল টুপি আর বাঁশের লাঠি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কারণ তারা বুঝে গিয়েছিল তাদের পীর তাদের হৃদয় কিংবা পারলৌকিক জগতের খবরটুকুও জানেন। তারা কমিউনিজম কিংবা সমাজতন্ত্র বিরোধী হয়েছে ‘লাল ভাসানী’ওয়ালাদের দৌরাত্ম্যে। ইসলাম বিদ্বেষ, ইসলামাতঙ্ক, ইসলাম বললেই বামদের আঁতকে ওঠার বিরুদ্ধে এটা ছিল সঙ্গত গণবিদ্রোহ। এটা সাময়িক বলে আমি মনে করি। যদি আমরা ভাসানীকে ভালোভাবে বুঝি এবং তার বৈপ্লবিক কর্তারূপকে ফুটিয়ে তুলতে পারি, তাহলে সাম্রাজ্যবাদকে গোড়াসহ উপড়ে তুলে আনার হিম্মত এদের আছে। নিদেনপক্ষে বাংলাদেশের এ রাষ্ট্র ব্যবস্থা উপড়ানোর কাজটা হোক। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। ভাসানীর মুরিদানদের প্রতি তাই আমার পক্ষপাত আছে, এটা আমি লুকাতে চাই না।
তাহলে বাংলাদেশে আমাদের প্রধান কাজ কি হতে পারে? ভাসানীকে অর্ধেক গ্রহণ করে এই দুই পরস্পরবিরোধী ধারার মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনা। কীভাবে সেটা সম্ভব?
প্রথম পর্বে কাজের ভরকেন্দ্র হবে মতাদর্শিক। ভাসানীর মধ্যে লাল এবং সবুজের যে মিশ্রণ ঘটেছে এটাই আগামী বিপ্লবী মতাদর্শের বাস্তব রূপ। শুধু লাল, কিংবা শুধু সবুজ দিয়ে আমরা কিছুই অর্জন করতে পারব না। আমাদের নতুন বিপ্লবী বয়ান তৈরি করতে হবে। সস্তা বইপুস্তক পড়া বিপ্লবী বকোয়াজি বন্ধ করতে হবে। মানুষকে ‘মানুষ’ গণ্য করতে হবে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, জীব হিসেবে মানুষের গুরুত্বপূর্ণ দাবি; কিন্তু মানুষ জীব মাত্র নয়। তার আত্মিক বা পরমার্থিক আকুতি আছে। সেই আকুতিগুলো জবরদস্তি দমন করা যায় না। এই প্রাথমিক বিষয়গুলো বুঝলে আমরা মজলুম মেহনতি জনগণকে সংগঠিত করতে পারি।
প্রথম পর্বের কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন করা গেলে পরবর্তীতে সেটাই ক্রমে ক্রমে বিপ্লবী, ঈমান ও আকিদার বিষয় হয়ে আমাদের চিন্তা ও পর্যালোচনার বিষয় হয়ে উঠবে। মনে রাখতে হবে, আমরা লাফ দিয়ে ইতিহাসের খালি স্থানগুলো টপকে পেরিয়ে যেতে পারবো না। দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা আমরা ভবিষ্যতের আশায় আপাতত স্থগিত রাখতে পারি। আগে দরকার ভাসানীকে বোঝার জন্য আমাদের নিজেদের প্রস্তুতি এবং আলোচনার পরিবেশ গড়ে তোলা।