মোরালেসদের প্রত্যাবর্তন
স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২০, ১০:৪৭ এএম
ইভো মোরালেস ও লুইজ আরসে
গত এক বছর ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতার পর ১৮ অক্টোবর বলিভিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেসের দল মুভমেন্ট ফর সোশ্যালিজম (এমএএস) পার্টির প্রার্থী লুইজ আরসে।
এর মধ্য দিয়ে লাতিন অঞ্চলে বেশ কয়েক বছর ধরে চলা ডানপন্থীর উত্থান ও মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে জনগণের অধিকার আদায়ের স্থানটুকু আরো খানিকটা ভিত্তি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী, প্রথম রাউন্ডে ৪০ শতাংশ ও নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে ১০ শতাংশ বেশি ভোট পেলে সরাসরি জয় ঘোষণা করা হয়। অন্যথায় দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে হবে। আরসে প্রথম রাউন্ডেই ৫২.৪ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। অভ্যুত্থানের সরকারের মদদপ্রাপ্ত সাবেক প্রেসিডেন্ট কার্লোস মেসা পেয়েছেন ৩১.৫ শতাংশ এবং ‘উই বিলিভ’ জোটের প্রার্থী লুইস ফার্নান্ডো কামাচো পেয়েছেন ১৪.১ শতাংশ ভোট। উগ্র-ডানপন্থীরা ভোটের ফলাফল মেনে নেবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল; কিন্তু যেভাবে একের পর এক প্রদেশে এমএএসের পক্ষে ভোটের জোয়ার দেখা গেছে, তাতে বিরোধীরা সাহস পায়নি।
মার্কিন মদদপুষ্ট অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট হওয়া জেনিন আনেজ নিজে ভোটে দাঁড়াননি। তার দাবি- এতে ডানপন্থী ভোট বিভক্ত হয়ে পড়বে। তবে সব ডানপন্থী মিলেও আরসের পাওয়া ভোটের ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারেনি।
সংকটের এক বছর
২০১৯ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ইভো মোরালেস জয়ী হন। ওই নির্বাচনের ফল মানতে অস্বীকার করে ডানপন্থীরা। গত বছর ২০ অক্টোবরের ওই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হিসেবে ছিল অরগানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস (ওএএস)। তারাই নির্বাচনে ‘জালিয়াতির’ অভিযোগ তোলে। অথচ সেসব অভিযোগের কোনোটিই প্রমাণ করতে পারেনি। মার্কিন মদদে শুরু হয় রাস্তা দখল করে সহিংস আন্দোলন। এ থেকে দেশকে রক্ষা করতে নতুন করে নির্বাচন দিতেও রাজি হন প্রেসিডেন্ট মোরালেস। অথচ নতুন নির্বাচনের আগেই সামরিক বাহিনী মোরালেসকে পদত্যাগ করতে বলে। সহিংসতা রোধ করতে ক্ষমতা ছেড়ে প্রথমে মেক্সিকো ও পরে আর্জেন্টিনায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেন মোরালেস।
১০ মাস পরও ওই নির্বাচনে কথিত জালিয়াতির কোনো প্রমাণ নেই ওএএসের কাছে। তারা এবারো নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের কাজ করেছে। তবে এবারের ফল হজম করা তাদের পক্ষে কঠিনই হবে ধারণা করা যায়!
১৮ অক্টোবর গভীর রাতে লা পাজে আরসে জয়ের কথা জানিয়ে বলেছেন, ‘আমরা আমাদের আত্মা ফিরে পেয়েছি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছি, সর্বোপরি আশার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছি। সব বলিভিয়ানের জন্য সরকার চালাব আমরা, দেশকে ঐক্যবদ্ধ করব।’
তবে এর আগেই বুয়েনস আইরেসে নির্বাসনে থাকা ইভো মোরালেস সাংবাদিকদের কাছে জয়ের সংবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘জনগণের ইচ্ছা জয়ী হয়েছে। আমরা বিপুল জয় পেয়েছি।’
নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ ক্যানেল বলেছেন, ‘সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের নির্দেশে যে অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছিল, তা ফিরিয়ে এনেছেন বলিভিয়ার জনগণ। কিউবা এই আনন্দের অংশীদার। বলিভারিয়ান মতাদর্শের জয় হোক।’ ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বলেছেন, ‘মহান জয়! ঐক্যবদ্ধ ও সতর্ক বলিভিয়ার জনগণ আমাদের সহোদর ইভোর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানকে পরাস্ত করতে ভোটকে ব্যবহার করেছেন।’ ২০০৯ সালে এমনই অভ্যুত্থানে অপসারিত হন্ডুরাসের সাবেক প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়াল জেলায়াও ‘অভ্যুত্থান ও প্রতারণাকে পরাভূত করার জন্য’ অভিনন্দন জানিয়েছেন বলিভিয়ার মানুষকে।
নতুন প্রেসিডেন্ট
প্রেসিডেন্ট হতে চলা লুইজ আলবার্তো আরসে কাতাকোরা ‘লুচো’ নামেই বেশি পরিচিত। ব্রিটেনের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আরসে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন আগেই। মোরালেস সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি হাইড্রোকার্বন, টেলিযোগাযোগ, খনি জাতীয়করণের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মোরালেসের মতো তার বিরুদ্ধেও ক্ষুব্ধ ছিল বিভিন্ন বহুজাতিক করপোরেশন। তিনি অর্থমন্ত্রী থাকার সময়ে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি হয় ৩৪৪ শতাংশ। চরম দারিদ্র্যের হার ৩৮ শতাংশ থেকে কমে আসে ১৫ শতাংশে।
২০০৬ সাল থেকে বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন মোরালেস। তখন থেকেই অর্থমন্ত্রী ছিলেন আরসে। তিনি খনিজসম্পদ জাতীয়করণ, করপোরেট কর ৫০ শতাংশে উন্নীত করেন এবং এই অর্থ শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যের মতো সেবা খাতগুলোতে ব্যয় করেন। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানে যে উন্নতি ঘটেছে, তা খোলা চোখেই দেখা যায়। ২০০৫ সালে বলিভিয়ার মানুষের গড় আয়ু ছিল ৬৫ বছর। ২০১৭ সালে তা ছয় বছর বেড়ে দাঁড়ায় ৭১ বছরে। একের পর এক গণমুখী সংস্কারে মোরালেসের সরকার পাল্টে দিয়েছিল বলিভিয়ার চেহারা। আর এ সংস্কার কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেয়া আরসে মোরালেসের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবেই সামনে এসেছেন।
ফিরছেন মোরালেস
সমসাময়িককালে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে বলিভিয়া নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছিল দেশটির প্রথম আদিবাসী প্রেসিডেন্ট মোরালেসের নেতৃত্বে। তিনি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বদলে পুঁজিবাদের সাথে সমাজতন্ত্রের মিশেল ঘটাতে চেয়েছিলেন, যা ইভোনোমিক্স নামে পরিচিতি পায়। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আরসে যার অন্যতম নির্মাতা।
ওই অর্থনীতির মূল কথা- জাতীয়করণের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের প্রসার সমর্থন করা, বিশেষ করে কৃষি খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা। সম্প্রতি বলিভিয়ার অর্থনীতি খুব নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। ২০০১ সালের পর গত বছর সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি ছিল, ২.১ শতাংশ। অনেকেই আশা করছেন, ক্ষমতায় না থেকেও মোরালেস ঠিকই বলিভিয়াকে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাবেন।
মোরালেস বলিভিয়া ছাড়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। তখন ওই সরকারের প্রধান জেনিন আনেজ বলেছিলেন, ‘মোরালেসের বিচারের মুখোমুখি হওয়া উচিত।’ পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিযোগ করেন, বিতর্কিত নির্বাচনের পর মোরালেস অশান্তি সৃষ্টি করেন। ওই সময় সংঘটিত সংঘর্ষ-সহিংসতায় বহু মানুষ হতাহত হন। সে সময় সরকারি কৌঁসুলিরা রাষ্ট্রদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে মোরালেসের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়। গত সপ্তাহে ওই আদেশ বাতিল করেন দেশটির আদালত। তবে মোরালেসের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ফৌজদারি অভিযোগ বাতিল হয়নি। এই অভিযোগের তদন্ত চলবে বলে জানিয়েছেন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা।
মোরালেসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়ার অভিযোগ করা হয়। অথচ বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে মোরালেস ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী’ নেতা হিসেবেই পরিচিত। তিনি জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তির পক্ষে বলেছেন; ভেনেজুয়েলার হুগো শ্যাভেজের সাথে জোট বেঁধে দক্ষিণ আমেরিকায় মার্কিনবিরোধী বলয় তৈরি করতে চেয়েছিলেন; বহুজাতিক করপোরেশনের ওপর করারোপ করেন; ফকল্যান্ড দ্বীপের ওপর আর্জেন্টিনার দাবিকে যৌক্তিক বলে মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্র স্বভাবতই উগ্র ডানপন্থীদের বিজয় দেখতে চেয়েছে। তবে ষড়যন্ত্রের পরও বলিভিয়ার জনগণ রাজপথ ও ভোটের মাধ্যমে যে প্রতিরোধ দেখিয়েছেন, তা অনন্য।
সিনেটর আন্দ্রোনিকো রদ্রিগেজ জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে যথাক্রমে লুইজ আরসে ও ডেভিড চোকহুয়াঙ্কা শপথ নেওয়ার একদিন পর আগামী ৯ নভেম্বর বলিভিয়ায় ফিরতে চলেছেন মোরালেস।
তিনি আরো জানিয়েছেন, মোরালেস দেশে ফেরার ২ দিন পর অর্থাৎ ১১ নভেম্বর ট্রপিক অব কোচাবাম্বাতে যাবেন। সেখানেই আপাতত তিনি থাকবেন বলে ঠিক হয়েছে। গত বছর ১১ নভেম্বর অভ্যুত্থান হয় তার বিরুদ্ধে। এই কারণে এই দিনটিকে ঐতিহাসিক করে রাখতে গণজমায়েতের ঘোষণা করা হয়েছে। রদ্রিগেজ জানিয়েছেন, মোরালেসের ফিরে আসাকে উদযাপন করবে পুরো দেশ।
এদিকে গত ৩০ অক্টোবর বলিভিয়ার পার্লামেন্ট অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট জেনিন আনেজের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে। সেইসঙ্গে তার মন্ত্রিসভার ১১ জনের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়। জেনিন আনেজ ক্ষমতায় আসার পর তার নির্দেশে সেনাবাহিনী ও পুলিশ ভয়াবহ নিপীড়ন চালায় মোরালেসপন্থী নেতা-কর্মীদের ওপর। এতে অন্তত ৩০ জন নিহত হন।
উল্লেখ্য, একুশ শতকের গোড়ার দিকে লাতিন আমেরিকায় নতুন করে বামপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটে। জাতীয়করণ ও কল্যাণমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করে ব্যাপক জনসমর্থন অর্জন করেন হুগো শ্যাভেজ, ড্যানিয়েল ওর্তেগা, ইভো মোরালেসের মতো নেতারা। সাম্প্রতিক সময়ে তা ভীষণভাবে ধাক্কা খায়। পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন ইস্যু তৈরি, কখনো বা ছোট ইস্যুকে বৃহৎ আকারে প্রকাশ করে ডানপন্থার উত্থান ঘটানো হয়।
আর এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মদদের ক্ষেত্রে প্রথম সারিতেই থাকে যুক্তরাষ্ট্র। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, মার্কিন প্রশাসন তার আশপাশের দেশগুলোর রাজনীতিতে ক্রমাগত হস্তক্ষেপ করে থাকে। বিভিন্ন দেশে বামপন্থীদের ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে সক্ষমও হয়। তবে বলিভিয়ার নির্বাচন আবার এক নতুন মোড়ে দাঁড় করালো দক্ষিণ আমেরিকাকে।