ধর্ষণের মনস্তত্ত্ব

এ কে এম মাজহারুল ইসলাম

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২০, ০৯:৪৩ এএম

‘ধর্ষণ’ শব্দটি বোধ করি বাংলাদেশে এই বছরের সবচেয়ে আলোচিত শব্দ। অনেকে বলে থাকেন ধর্ষণ খুনের চেয়েও ভয়ংকর। কারণ খুন হয়ে গেলে ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটে। ধর্ষণের দায় পুরুষের হলেও এর কলঙ্ক নারীকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। 

কলঙ্ক বাঙালি সমাজে এমন এক বিষয়, বার কয়েক হজব্রত পালন বা গঙ্গা স্নানও- এ আপদ থেকে বিপদগ্রস্ত নারীকে উদ্ধার করতে পারে না। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক পীড়াপীড়ির কারণে সেকালের বিখ্যাত ‘সুলেখা কালি’র জন্য এক লাইনের একটা বিজ্ঞাপন লিখে দিয়েছিলেন। কবিগুরু নাকি লিখেছিলেন, ‘সুলেখা কালি- এ কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।’ সমাজে ধর্ষণের কলঙ্ক সুলেখা কালির চেয়েও কালো। 

সামাজিক ও ব্যক্তিগত কারণে কাম-বাসনা মেটাতে না পেরে অপরিতৃপ্ত যৌনাআকাক্ষা পুঞ্জিভূত হতে হতে এক সময় ধর্ষণের মতো ভয়ানক অপরাধ ঘটে থাকে। আর এসব ধারণা বেশ পুরনো হয়ে গেছে। সুসান ব্রাউনমিলার তার ‘এগেন্সট আওয়ার উইল’ বইয়ে সেই ১৯৭৫ সালে এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে ধর্ষণকে একটি লিঙ্গ রাজনীতির ফসল বলে আখ্যায়িত করেছেন। ধর্ষণের পেছনের প্রেষণা যে যৌনতা নয়, বরং এটা যে এক আধিপত্য ও ক্ষমতার বিষয় সেটা আরও পরিষ্কার করে বলেছেন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী নিকোলাস গ্রথ। ১৯৭৯ সালে তার প্রকাশিত ‘ম্যান হু রেইপ’ বইটিতে তিনি দেখান যে, সব ধর্ষকের তিনটি মোটিভ থাকতে পারে। যথা; ধর্ষকাম (স্যাডিজম), ক্রোধ আর ক্ষমতা। 

তিনি বলেন, ধর্ষণ সাধারণত সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, কোনো স্থায়ী অথবা সাময়িক মনোবিকারগ্রস্ত মানুষের পক্ষেই তা ঘটে থাকে। তিনি আরো দেখান যে, ধর্ষণ একটি যৌনক্রিয়ার আড়ালে ক্ষমতা ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ।

লেখক: এ কে এম মাজহারুল ইসলাম

অন্যভাবে ধর্ষণ এমন এক মানসিক দুর্বলতা, যেই দুর্বলতার কারণে সে তার যৌন তাড়নাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ঐতিহাসিকভাবেই পুরুষের যৌনতা একটু সহিংস ও আদিম (Violent and Predatory)। এটিকে কালে কালে পুরুষের শক্তিমত্তার এক বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হতো। সমাজবিজ্ঞানী স্কালি তার গবেষণার জন্য বেশ কিছু ধর্ষকের সাথে কথা বলেছেন। তাদের একজন জানান, ‘আমি জানতাম আমি একটি অন্যায় করছি; কিন্তু আমি এটিও জানতাম যে বেশির ভাগ নারীই বিষয়টি চেপে যায় এবং আমি ভেবেছি আমি যাকে ধর্ষণ করেছিলাম সেও ব্যাপারটি গোপনই রাখবে।’

স্কালি দেখেছেন যে বেশির ভাগ ধর্ষক বিষয়টিকে তেমন ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে না। এমনকি অনেকে এটিকে প্রায় স্বাভাবিক, ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ ভাবেন। কয়েকজন বলেছেন, যদি তারা দোষী হিসেবে শনাক্তও হন, তবুও তারা শিগগির দায় মুক্তি পেয়ে যাবেন। বন্ধু বা সমাজের কাছে তারা বেশি বিপদগ্রস্ত হবেন না এবং সমাজে তাদের মান মর্যাদার তেমন কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি ঘটবে না।‘

গবেষণায় আরো দেখা গেছে, যৌন ফ্যান্টাসিতে ভুগতে থাকা অনেকেই ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর প্রেনকি নামে একজন গবেষকও দেখিয়েছেন যে, শতকরা ২৫ ভাগ ধর্ষণ এই ধরনের যৌন ফ্যান্টাসির কারণে ঘটে থাকে। প্রতিশোধপরায়ণ ধর্ষকের সংখ্যাও কম নয়। প্রেনকির মতে, শতকরা ৩২ ভাগ ধর্ষকই সেই দলের। তারা সবাই নারী বিদ্বেষী ও তারা নারীকে অত্যাচারের শিকার হতে দেখতে চায়।

দায়মুক্তির ব্যাপারটি কিংবা শাস্তি না হওয়ার বিষয়টিও বিরাটভাবে কাজ করে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের মতো দ্বিতীয় কোনো দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা বলা মুশকিল। বাংলাদেশে গত এক দশকে ধর্ষণ মামলার সুরাহার হার মাত্র ৩.৪৫ শতাংশ। শাস্তির হার মাত্র ০.৪৫ শতাংশ।

১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন মানিকের ধর্ষণের সেঞ্চুরির ঘোষণা সারাদেশের মানুষকে হতবাক করে দিয়েছিল। সেই ঘটনায় দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। ২০০০ সালে থার্টিফার্স্ট নাইটে ক্ষমতাসীন দলের একদল ছাত্রনেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এক ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করে। সেবারও উল্টো শাস্তি মেলে ছাত্রীদেরই। থার্টিফার্স্ট নাইটে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ হয়। ক্রমে ক্রমে এই দেশ এক ধর্ষণের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। ইয়াসমিন, সীমা, তনু, নুসরাতের ঘটনা দেশকে নাড়িয়ে দেয়। আমাদের সমাজ হয়ে ওঠে এক ধর্ষণপ্রবণ সমাজ।

সম্প্রতি সিলেটের এমসি কলেজ আর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের ঘটনা আবারো সবাইকে চমকে দেয়। আন্দোলন, প্রতিবাদ আর কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়; কিন্তু শুধু তাতেই কি ধর্ষণ কমে যাবে বলে মনে হয়?

নৃবিজ্ঞানী ম্যালিনোস্কি বলেছেন, ‘কাম, ব্যাপক অর্থে, শুধু দুটি মানুষের শারীরিক সম্পর্ক নয়, এটি এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি।’ নৃতাত্ত্বিকেরা মনে করেন- নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক পার্থক্যের পেছনে প্রাকৃতিক যে ভিত্তিই থাকুক না কেন, নারী আর পুরুষ, কাম আর সন্তান উৎপাদন সাংস্কৃতিক বিষয়। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ধর্ষণের রকমফের দেখে এ-মতটিকেই মেনে নিতে হয়। পুরুষ জন্মসূত্রেই পাশবিক বা ধর্ষণপ্রবণ এটা এত ঢালাওভাবে বলা যায় না। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে সব সময় ধর্ষণকে ব্যাখ্যা করা যায় না। কামের জৈবিক ভিত্তি অবশ্যই রয়েছে, তবে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ধর্ষণের ঘটনার যে ভিন্নতা দেখা যায়, তাতে এটি স্পষ্ট যে সংস্কৃতি মানুষের কামপ্রবৃত্তিকে প্রবলভাবেই চালিত করতে পারে। 

প্রাবন্ধিক হুমায়ুন আজাদ একবার বলেছিলেন ‘ধর্ষণ পুরুষাধিপত্যের সামাজিক ভাবাদর্শেরই প্রকাশ’। ধর্ষণপ্রবণ সমাজে পৌরুষ বলতে বোঝানো হয় হিংস্রতা আর কঠোরতা। বাংলাদেশ বলা যায় এমনই এক সমাজ।

বাংলাদেশে একক ও সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয়; এবং ধর্ষণের পর ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়। এখানে পিতা ধর্ষণ করে কন্যাকে, জামাতা ধর্ষণ করে শাশুড়িকে, শিক্ষক ধর্ষণ করে ছাত্রীকে, সহপাঠী ধর্ষণ করে তার সহপাঠিনীকে, আমলা ধর্ষণ করে কার্যালয়ের অধঃস্তন নারী কর্মচারীকে, ঈমাম ধর্ষণ করে কিশোরীকে, দুলাভাই ধর্ষণ করে শ্যালিকাকে, শ্বশুর ধর্ষণ করে পুত্রবধূকে, দেবর ধর্ষণ করে ভ্রাতৃবধূকে; এবং দেশজুড়ে চলছে এমনি অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা। চলছে দলবদ্ধ ধর্ষণ- রাতে গ্রাম ঘেরাও করে পুলিশ দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে গৃহবধূদের, নিজেদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে পুলিশের দল মিলে ধর্ষণ করে হত্যা করে বিচারপ্রার্থী কিশোরীকে। প্রেমিকের কাছ থেকে, স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ছাত্ররা দলগতভাবে ধর্ষণ করে প্রেমিকাকে, স্ত্রীকে, পাড়ার মাস্তানরা বাড়িতে ঢুকে পিতা-মাতার চোখের সামনে দলগতভাবে ধর্ষণ করে কন্যাকে। বাংলাদেশ আজ এক ধর্ষণের জনপদ। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি নারীর মনের মধ্যে যেই ভীতি স্থায়ী হয়ে আছে তার নাম হলো এই ধর্ষণ ভীতি।

একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যাবার পর কী হয়? ধর্ষণের শিকার শিশু, বালিকা, তরুণী, যুবতী, প্রৌঢ়া, এমনকি বৃদ্ধা নারীর জীবনে কী ঘটে বাইরে থেকে আমরা কেউ তা দেখতে পাই না। সারাজীবনের গ্লানি নিয়ে সে কীভাবে তার জীবন কাটায় তার খোঁজ আমরা রাখি না। পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজ সব জায়গা থেকে নিগৃহীত হতে হতে ধর্ষণের শিকার নারীটি জীবনভর কত শতবার মরতে থাকে, মরতেই থাকে তার খবর কেউ রাখে না। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় ধর্ষিত নারী হলো এক আনবিক বোমাগ্রস্তনগরী, যার কিছুই আর আগের মতো থাকে না। তারপর সে আবার বাস করতে শুরু করে ধর্ষণকারীর দীর্ঘ ছায়ার নিচে।

এভাবে তো আর চলতে পারে না।

লেখক: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh