শফিক হাসান
প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০২০, ০৪:৪৯ পিএম
বাসর রাতে নববধূ ভিন্ন অন্য কোনো নারীর চিন্তা মাথায় আসার কথা নয়। তবু কেন যে সে চিন্তাটাই এলো রাহিদের। পূর্বা এখন কী করছে? সে কি রাহিদের বিরহে পুড়ছে নাকি কেঁদে ভাসাচ্ছে বুক! ছেলে-মেয়েদের প্রেমকে খুব কম বাংলাদেশি পরিবারই মেনে নিতে পারে। তারা চান, বিয়েটা তাদের পছন্দেই হবে। এ পছন্দ-অপছন্দে কোনো কোনো ছেলেমেয়ের জীবনের বারোটা বেজে যায়। পরবর্তীকালে কারও কারও জন্য তা শুভ ফলও বয়ে আনে। সেটা পরের ব্যাপার! বর্তমানের মনকে কি বোঝানো যায়!
মৃদু পায়ে বাসরঘরে ঢুকল রাহিদ। ঢুকেই কেমন যেন হোঁচট খেল। এতদিন জেনে এসেছে বাসরঘরে মেয়েরা লাজনম্র হয়ে ঘোমটা আবৃত থাকে; কিন্তু ইতি বসে আছে সটান হয়ে। তার চুলের কারুকাজ ফুলের বেষ্টনী উঁচিয়ে জানান দিচ্ছে। নতুন বরকে দেখে একটু নড়ে উঠল সে। ধীরে ধীরে পোশাক ছাড়ল রাহিদ। শেরোয়ানি পরা যেমন ঝামেলার, খোলাও কম ঝামেলার নয়। ইতিকে আলিঙ্গন করে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘কেমন আছ গো?’
‘ভালো আছি গো!’ একই সুর অবলম্বন করে বলল ইতি।
‘আজ নাকি তোমার বিয়ে?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে! তোমার?’
‘আমারও বিয়ে হয়ে গেছে ইতি নামের এক রূপবতীর সঙ্গে।’
‘যাহ, দুষ্টু!’
‘দুষ্টুমির দেখেছ কী!’
ইতিকে আরও কাছে টানল রাহিদ। ইতি কৃত্রিম বিরাগে ঠেলে দিল দুষ্টু বরকে। রাহিদ ইতির চুল সরিয়ে চমু খেল কপালে। কপাল থেকে ঠোঁটে, গালে...।
দুই.
চুমোয় চুমোয় যখন ইতির উত্তেজিত হওয়ার কথা, পাল্টা চুমু দেওয়ার কথা রাহিদকে, তার মনে পড়ল ফেলে আসা এক তরুণের স্মৃতি। সে তরুণও তাকে এভাবেই চুমুতে চুমুতে পাগল করে দিত। মাথায় ঘোমটা টেনে এনে কিংবা ওড়না-আবৃত করে গভীর অনুরাগে ‘সোনাবউ’ ডেকে আদর করত। ইমন এখন কী করছে? তার বিরহে কতটা মুষড়ে পড়েছে। মন-গাঁজা ধরবে না তো আবার! নেতিবাচক আশঙ্কায় একটু বিচলিত হল সে। ইতির বিয়ের কথা শুনে প্রথমে ইমন বিশ্বাসই করতে চায়নি। পরে বলেছে, প্রয়োজনে ইতির বাবার সঙ্গে দেখা করবে। ইতি তাকে বুঝিয়েছে, বাবার কাছে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। এতে সমস্যা বাড়বে আরও। তারা ভুল বুঝবেন ইতিকে। এ খবর যদি বরপক্ষের কাছে চলে যায় বিয়ে ভেঙেও যেতে পারে। বাস্তবতা অনুধাবন করে ইমন সব মেনে নিয়েছে। শুধু একটা শর্তে সব ছাড়তে রাজি। সব কষ্ট মেনে নেবে, যদি ইতি তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসে। ইতির নিরাবরণ রূপ দেখতে চায়। অন্তত একবার সুদাসলে বুঝে নিতে চায় প্রাপ্য হিস্যাটুকু।
‘ছি’ বলে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইলেও ইতি পরে এক সময় উপলব্ধি করল, প্রেমিক হিসেবে এটা সে চাইতেই পারে। হ্যাঁ-না’র দোলাচলে থাকতে থাকতেই বিয়ে হয়ে গেল তার তুলনামূলক ধনাঢ্য ও রূপবান রাহিদের সঙ্গে। তবে কথা দিল, একবার নয়, একাধিকবার ইমনকে সঙ্গ দেবে সে। সুযোগ বুঝে, সবার চোখ বাঁচিয়ে।
তিন.
অতিমাত্রায় বিজ্ঞাপন প্রচারের কারণেও হতে পারে, ছবি বা বাস্তবে কাশফুল দেখলেই জন্মবিরতিকরণ পিলের কথা মনে পড়ে। মনে মনে হাসল পূর্বা। কাশফুল দেখতে সুন্দর, কিন্তু এর নরম-কোমল স্পর্শ খুব কম মানুষই নেয়। তাই ‘নরম ছোঁয়া’ অনেকেরই ভাবনায় থাকার কথা নয়। সুন্দরকে স্পর্শ করতে নেই। তাতে মহিমা ম্লান হয়। যা কিছু সুন্দর ও ব্যতিক্রম- দূর থেকে উপলব্ধি করাই ভালো। কয়েকজন বন্ধু মিলে দিয়াবাড়িতে এসেছে তারা। মাশুক অনেকদিন ধরেই চাইছে, পূর্বাকে একান্তে মনের কথা বলতে। আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেও; কিন্তু নারাজ পূর্বা। রাহিদের সঙ্গে যে সম্পর্কে আবদ্ধ, চাইলেই কি এ ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে পারে! অন্যদিকে মাশুকও নানাভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে রাহিদের চেয়ে ঢের যোগ্য সে। পূর্বা চাইলে বুদ্ধিমতীর মতো সেরা অপশনটি বেছে নিতে পারে। রাহিদ পূর্বাকে কোথাও বেড়াতে নিতে চাইলে দ্বারস্থ হতে হবে রিকশা বা অটোরিকশার। অন্যদিকে মাশুকের নিজেরই রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি। চালক হিসেবেও অতটা খারাপ নয় সে! আজও নিজে ড্রাইভ করে চার বন্ধুকে নিয়ে এসেছে। অন্যরা তার নিপুণ চালনার দিকে মনোযোগ দেয়নি। সবার গল্পের বিষয় ছিল পূর্বা ও রাহিদের সম্পর্কের ভাঙন। পূর্বা একসময় বলতে বাধ্য হল, ‘কী একটা ক্ষ্যাতমার্কা মেয়েকে বিয়ে করল রাহিদ!’
অন্যরাও একাত্মতা পোষণ করল এমন মন্তব্যে। শুধু প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপের হাসি হেসে মাশুক বলল, ‘আমি আগেই বলেছিলাম, ছেলে হিসেবে রাহিদ ভালো হতে পারে, কিন্তু প্রেমিক হিসেবে অনুপযুক্ত।’
একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল পূর্বা। প্রাক্তন প্রেমিকের চরিত্র ব্যবচ্ছেদ দেখতে আর ভালো লাগছে না। তাও ‘প্রতিপক্ষের’ মুখে। এ তর্কে মাশুক জিতে গেলে পূর্বারই হার। রাহিদেরও এখন কিছু যায় আসে না এসব উটকো মূল্যায়নে। অন্য তিনজন যখন কাশবন কিংবা সুনীল আকাশের মায়ায় জড়াতে গেছে কাছে-দূরে কোথাও, পূর্বার পাশাপাশি হাঁটছিল মাশুক। দীর্ঘ নীরবতার পর মাশুক বলল, ‘আমি তোমার হাতটা ধরি, পূর্বামণি?’ পূর্বা আলগোছে জড়িয়ে নিল মাশুকের হাত। তারপর কৃত্রিম ভ্রূকুটি হানল মাশুকের দিকে চেয়ে! মাশুক একটা কাশফুল ছিঁড়ে পূর্বার সুন্দর মুখে টোকা দিতেই সে আবার মনে করতে পারল বিজ্ঞাপনচিত্রটা। সেটা মাথায় বিক্রিয়া করছে বলেই পূর্বার গলা দিয়ে বেরোল- ‘দুষ্টু কোথাকার! ফুল সরাও!’
চার.
শিল্পীর সঙ্গে ইমনের পরিচয় ফেসবুকে। একদিন মেসেনজারে বার্তা পেল ইমন- ‘আমি শিল্পী। আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পারি?’
সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই দিল ইমন- ‘অবশ্যই। আপনি কি গানের শিল্পী নাকি অন্য কোনো মাধ্যমের?’
কথা প্রসঙ্গে বেরিয়ে এল ঘরোয়া অনুষ্ঠান কিংবা ফেসবুক লাইভে গান করে সে। ইমনকেও ভিডিওকলে গান শোনাল সেদিনই। শিল্পীর শিল্পসত্তা আর বন্ধুত্বে আগ্রহী মনোভাব ইমনকে এগিয়ে নিল নতুন ভুবনে। গতকাল ইতিকে কল করেছে সে। রিসিভ হয়নি ওদিকটায়। বোধহয় নতুন সংসারে এখনো থিতু হতে পারেনি। সব মিলিয়ে বিষয়টা মেনে নিয়েছে ইমন। ইতি ওর হবে, এখন এমন স্বপ্নে বুঁদ হয়ে আছে। তাই বলে পুরনো ইতিকে চায় না। যত দ্রুত একান্ত সান্নিধ্যে আসা যায় ততই ভালো।
ভাবনা-দুর্ভাবনার মধ্যেই আজ সকালে কল করেছে শিল্পী। মেসেনজারে ফোন নম্বর আদানপ্রদান হয়েছে আরও আগে। শিল্পী প্রস্তাব দিল, ইমনের যদি আপত্তি না থাকে, একসঙ্গে কফি খেতে চায়। ইমনের আপত্তির কোনো কারণ ছিল না। শিল্পী দেখতে সুন্দর, ভালো গান গায়, পারিবারিক স্ট্যাটাস আরও ভালো।
পূর্ব নির্ধারিত জায়গায় যখন পৌঁছাল ইমন, জিরো ফিগারের শিল্পীকে দেখে যেন চোখের পলক পড়ে না। মুগ্ধ চোখকে আরেকটু স্নিগ্ধতায় ভাসাবে, এসময়ই এল কলটা। ইতি! কল রিসিভ করেই ইমন বলল, ‘একটা মিটিংয়ে আছি। পরে ব্যাক করব।’
এর মধ্যে শিল্পীর ফোনেও কল এল। কথা বলতে বলতে একটু আড়াল হল সে। পেছনের দিক থেকে শিল্পীর একহারা ফিগার দেখতে দেখতে ইমনের মনে ভাবনা এল- যে গতিতে এগোচ্ছে সম্পর্ক, ইতি-প্রজেক্টের আগেই বোধহয় শিল্পী-প্রজেক্টের বাস্তবায়ন ঘটিয়ে ফেলতে পারবে!