ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আলোর মুখ দেখছে না অনলাইন ক্লাস

আবু সাঈদ ইসিয়াম

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২০, ০৯:১১ এএম

করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে নিরাপদ রাখতে চলতি বছরের মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। 

প্রথমদিকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকে অনলাইন ক্লাসে সবার সমান অংশগ্রহণ সম্ভব নয় বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান জানালেও মার্চের শেষ দিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন শিক্ষকদের অনলাইনে ক্লাস নিতে পরামর্শ দেয়। তবে পরীক্ষা, মূল্যায়ন ও ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রাখবে বলেও নির্দেশনা দেয়। 

এর মাস তিনেক পর ৭ জুলাই অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তবে প্রয়োজনীয় ডিভাইস, ইন্টারনেট ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি না থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। 

যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘অনলাইনে বেশ যথাযথভাবেই চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীরা আগ্রহ সহকারে অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করছেন। আর শিক্ষকরা নিয়মিত অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করছেন।’

ক্লাসের বাইরে অর্ধেক শিক্ষার্থী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস নিয়ে লেজে-গোবরে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষকদের প্রস্তুতিহীনতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কাস্টমাইজড সফটওয়ার না থাকা, জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের জুম প্ল্যাটফর্মে ক্লাস নেয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা, শিক্ষক প্রশিক্ষণে ঘাটতি, সব শিক্ষার্থীর স্মার্টফোন না থাকার কারণে অনলাইন ক্লাস এখন পর্যন্ত খুব একটা আলোর মুখ দেখতে পারেনি। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের বাইরেই থাকছে। দূরবর্তী জেলা ও দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেটের ধীরগতি ক্লাসের জন্য ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। কোনো কোনো এলাকায় ক্লাস চলাকালীন বিদ্যুতের লোডশেডিংও শিক্ষার্থীদের যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী আফরা নাওমী বলেন, ‘আমাদের ব্যাচে মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৬০ জন। করোনাকালের আগে ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিতি ছিল পঁয়চল্লিশ জনের উপরে। আমি ঢাকাতেই থাকি, যার কারণে অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হতে আমার কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। কিন্তু অনলাইনে আমরা ১০ থেকে ১৫ জনের মতো ক্লাস করি। বাকি সহপাঠীরা গ্রামে থাকায় ইন্টারনেট জটিলতার কারণে যুক্ত হতে পারছেন না।’ 

মার্কেটিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সজীব আল মামুন বলেন, ‘আমাদের ব্যাচে ২২০ জনের বেশি শিক্ষার্থী আছি। অনলাইনে আমরা ১৭০ জনের মতো ক্লাসে প্রতিনিয়ত কানেক্ট হচ্ছি; কিন্তু সমস্যা হলো- সবাই প্রথমদিকে যুক্ত হতে পারলেও ক্লাস শেষ হওয়া পর্যন্ত অনেকেই নিরবচ্ছিন্নভাবে সংযুক্ত থাকতে পারেন না।’ 

ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, ‘করোনাভাইরাস মহামারির কারণে আটকে গেছে আমাদের তৃতীয় বর্ষের একটি ল্যাব পরীক্ষা। সেই পরীক্ষা নেয়ার আগে আমাদের কোনো ক্লাসেই নিচ্ছে না ডিপার্টমেন্ট। এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো অনলাইন ক্লাস হয়নি।’

পরীক্ষা ছাড়াই নতুন সেমিস্টার

করোনাকালে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চলমান রাখার স্বার্থে এক শিক্ষাবর্ষ/সেমিস্টার ক্লাস শেষ হওয়ার পর পরবর্তী শিক্ষাবর্ষ/সেমিস্টারের ক্লাসও অনলাইনে শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সম্প্রতি রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগ ও ইনস্টিটিউট প্রধানদের কাছে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। 

বিষয়টি নিশ্চিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মুনসী শামস উদ্দিন আহম্মদ বলেন, ‘এক সেমিস্টার শেষ করার পর আরেক সেমিস্টারের ক্লাস শুরু করার একটি নোটিস বিভিন্ন বিভাগে গেছে।’ তবে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হলে সব পরীক্ষা নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।

বেড়েছে শিক্ষা বৈষম্য

করোনাকালে অনলাইন ক্লাসের ফলে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন অনেক শিক্ষার্থী। তাদের অভিযোগ- বেশিরভাগ শিক্ষার্থী গ্রামে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান করায় নেটওয়ার্কের সমস্যা হচ্ছে। তাছাড়া সবার স্মার্টফোন নেই। যাদের আছে তাদের সবার পক্ষে প্রতিদিন চার-পাঁচ জিবি ডেটা কেনা সম্ভব নয়। তাই দিনে দিনে অনলাইন ক্লাসে উপস্থিতি কমছে। ফলে তৈরি হচ্ছে বৈষম্য। 

শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা, অনেকের বাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলে। প্রয়োজনীয় ডিভাইস ও সুবিধাদি না থাকায় তারা অনলাইন ক্লাসে যুক্ত হতে পারছেন না। ফলে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ শিক্ষা কার্যক্রম থেকে পিছিয়ে পড়ছেন। 

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগে অনেকেই টিউশন, পার্টটাইম চাকরি, অনলাইনে ছোটখাটো ব্যবসাসহ বিভিন্নভাবে অর্থ উপার্জন করে নিজের খরচ কিছুটা হলেও নিজেরাই চালাতে পারত। বর্তমানে তাদের সেই আয়ের রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ। ইতিমধ্যে পরিবারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন অনেকেই। তাই এই মুহূর্তে প্রতিদিন ইন্টারনেটে ডেটা কিনে বাড়তি খরচের কোনো উপায় নেই তাদের। 

অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের শিক্ষার্থী সিরাজুল ইসলামের বাড়ি কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। আবার তাদের বড় একটা অংশ প্রত্যন্ত অঞ্চলের। অনেক জায়গায় মোবাইলে কল করার জন্য টু-জি নেটওয়ার্কও পাওয়া যায় না। সেখানে থ্রি বা ফোর-জি কল্পনাতীত! ওইসব অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা আর্থিক অস্বচ্ছলতা ও দুর্বল ইন্টারনেটের কারণেই মূলত অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। ফলে তারা ক্লাস থেকে বঞ্চিত ও বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন।’

শিক্ষাবিদদের বক্তব্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘অনলাইনে পড়িয়ে কোনো আনন্দ পাওয়া যায় না। এখন তো অনলাইন ক্লাস ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। সুতরাং আমাদের এটি করতেই হবে; কিন্তু ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাস করতেই পারছে না। সুতরাং একটি ডিজিটাল বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। ফলে এই বৈষম্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো অসম করে দেবে। অনলাইন ক্লাস মানে তো সবাই উপস্থিত থাকবে; কিন্তু বড় একটা অংশকে বাদ রেখে কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থীকে আমরা পড়াব, এটি আমার কাছে আপত্তিকর লাগে। এটি না হয় আপদকালীন সময় চলছে; কিন্তু সরকারকে এখনই কোমর বেঁধে নামতে হবে- আমাদের দেশে যত অস্বচ্ছল শিক্ষার্থী আছে, তাদের সবাইকে ইন্টারনেট সুবিধাসহ ল্যাপটপ দিতে হবে। এছাড়া অনলাইন শিক্ষাকে বৈষম্যহীন করা যাবে না।’

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘প্রথমদিকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বলছিল- যাদের ইন্টারনেট সংযোগ নেই, তাদের ইন্টারনেট সুবিধা দেবে, ডেটার জন্য আলাদা করে টাকা দেবে। কিন্তু আমরা খেয়াল করলাম, বিশ্ববিদ্যালয় একটি কথাও রাখেনি। আমরা যতটুকু পেরেছিলাম করোনাকালে ডিপার্টমেন্ট থেকে আর্থিক সুবিধা দিয়েছি। অনেক ডিপার্টমেন্ট থেকেই এটি করা হয়েছে। আমি নিজেও ক্লাস নিতে গিয়ে দেখেছি- ডেটা খুবই ব্যয়বহুল, যা অনেক শিক্ষার্থীর পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। আবার কোথাও ইন্টারনেট সংযোগের পরিবেশও নেই। ফলে একদল ক্লাস করবে, আরেক দল বঞ্চিত হবে। তখন আরো বৈষম্য বাড়বে। কারণ শহরের শিক্ষার্থীরা এখনো ইন্টারনেট পাচ্ছেন, আর গ্রামের শিক্ষার্থীরা আরো পিছিয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং শিক্ষায় বৈষম্য আরও প্রকট হচ্ছে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো নিজস্ব কোনো সফটওয়্যার এখন পর্যন্ত তৈরি করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাস্টমাইজড কোনো সফটওয়্যারও নেই। কাস্টমাইজড সফটওয়্যারে সুবিধা হলো- এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আইডি নম্বর দিয়ে অনলাইন ক্লাস বা পরীক্ষায় ঢুকবে এবং বের হবে, অন্য কেউ ঢুকতে পারবে না। এসব সুযোগ তৈরি না করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেকেন্ড সেমিস্টার শুরু করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এসব আসলেই আমার কাছে অযৌক্তিক মনে হচ্ছে।’

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘অনলাইনে যথাযথভাবেই চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীরা আগ্রহ সহকারে অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করছেন। শিক্ষকরা নিয়মিত অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করছেন। আর যারা ক্লাসে অংশ নিতে পারছেন না করোনা-পরবর্র্তী সময়কালে মেকআপ ক্লাস ও তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন তা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করা হবে।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh