উদ্বৃত্তের চালে ঘাটতি!

হারুন-অর-রশিদ

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২০, ১০:৪৮ এএম | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২০, ১০:৪৯ এএম

করোনাকালে অধিকাংশ মানুষের আয় কমেছে। বিশেষ করে ছোটখাটো অপ্রাতিষ্ঠানিক পেশা, নিম্নআয়ের মানুষ ও দরিদ্রদের আয় ব্যাপকহারে কমেছে।

এমনিতেই আয় কমে অসহায়ত্বের মধ্যে পড়েছেন এই শ্রেণির মানুষ। তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে নিত্যপণ্যের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধি। পেঁয়াজ, ডাল, তেল, বিভিন্ন সবজির পর এবার দাম বেড়েছে আবশ্যিক পণ্য চালের। এতে সংকটে থাকা মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত আরো বিপাকে পড়েছে। 

এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি হিসাবে দেশে প্রচুর ধান-চাল মজুদ আছে; কিন্তু সেটি কৃষকের গোলায় নয়, চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের গুদামে। সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সরকার চেষ্টার কথা বললেও দাম নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এখনো পেঁয়াজের দাম ৮০ থেকে ৯০ টাকায় রয়েছে, যা স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। অধিকাংশ সবজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ১৮০ টাকায়। তেলের দামও বেড়েছে। সর্বশেষ বাড়ল চালের দাম। বাজার ভেদে প্রতি কেজিতে চালের দাম বেড়েছে চার থেকে ছয় টাকা। ৫৪ টাকা কেজি দরের মাঝারি মানের মিনিকেট চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা। আর ৫৬ টাকা কেজি দরের নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ টাকায়। ৪৭-৪৮ টাকার মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকায়। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গত ২৩ সেপ্টেম্বরের হিসাবে, গত এক বছরে গরিব মানুষের মোটা চালের দাম বেড়েছে ২৭ শতাংশ। চিকন চালের দামও বেড়েছে ১৪ শতাংশ। মাঝারি মানের বিভিন্ন চাল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৪৮ থেকে ৫৩ টাকা। আর প্রতি কেজি চিকন মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে বাজারভেদে ৫৬ থেকে ৬০ টাকায়। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এখন মাঝারি মানের চালের দাম ৯ শতাংশ ও সরু চালের দাম ১৫ শতাংশ বেশি। 

  • বোরো উৎপাদন ২ কোটি টন
  • কৃষকের গোলা শূন্য
  • দাম বাড়ছে হু হু করে

চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে গত সপ্তাহে সরকার চালের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে; কিন্তু সরকার নির্ধারিত দামে চাল পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ ভোক্তাদের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধান কাটার মৌসুম শুরু হতে এখনো মাস দেড়েক বাকি। এ সময়ে কৃষকের কোনো ধান থাকে না। অনেক কৃষক চাল কিনতে বাধ্য হন। কৃষকের কাছে ধান না থাকলেও দেশে ধানের কোনো সংকট নেই। সরকারি হিসাবে কয়েক বছর ধরেই দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ধান উৎপাদন হয়েছে। কয়েকবার রফতানির উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। করোনাকালে সব খাত বিপর্যস্ত হলেও কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক ছিল। গত বোরো মৌসুমে প্রায় দুই কোটি মণ ধান উৎপাদন হয়েছে; কিন্তু এরপরও দুর্যোগে বিপদাপন্ন মানুষের ঘাড়ে নতুন করে চেপে বসেছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। কিছুদিন ধরে চালের বাজারও ভোক্তাদের বড় অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, চালের এই মূল্য বৃদ্ধির পেছনে কোনো ধরনের কারসাজি নেই। দাম বাড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে চালের চলতি মৌসুম শেষের দিকে। দ্বিতীয়ত, এবার সারাবছর কেটেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে। প্রথমে হলো শিলাবৃষ্টি। এরপর ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ছোবল। তারপর দেশের ৩৩ জেলাজুড়ে বন্যা, যা এখনো চলছে। এ ছাড়া বছরজুড়ে করোনার তাণ্ডব তো রয়েছেই। এর বাইরে এ বছর বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেশি। প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। এসব কারণে বাজারে ধানের সরবরাহ কমে গেছে বিধায় দামও বেশি। ধানের দাম বেশি হলে চালের দাম বাড়বেই।

তবে অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, দেশে অনেক বড় বড় রাইস মিলের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। দেশে শত শত চালের মিলের মধ্যে ৫০টির মতো বাজার প্রভাবিত করে থাকে। চলতি বছরেও মৌসুমের শেষে ও বন্যার কারণে তাদের বাজার প্রভাবিত করার বিষয়টি দৃশ্যমান হয়েছে। আইনের মধ্যেই তাদের ধারণক্ষমতা অনেক বেশি। এ জন্য মজুদ আইন সংশোধনের বিষয়টি ভাবনায় আনা প্রয়োজন। 

চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ধানের দাম বাড়ার অজুহাত দিচ্ছেন; কিন্তু এরই মধ্যে অভিযোগ উঠেছে, চালকল মালিক ও নতুন একশ্রেণির ব্যবসায়ী ধান-চাল মজুদ করছেন। তাদের কাছে ৮৪ শতাংশ ধান মজুদ আছে। ২০১৯-২০ বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ধানের বর্তমান মজুদ এবং বাজার মূল্যের বিশ্লেষণ ও নিয়ন্ত্রণে করা সরকারি জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। 

জরিপটি করেছে কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, কৃষি পরিসংখ্যান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। জরিপটি পরিচালিত হয় কৃষক, ধান ব্যবসায়ী ও চালকল মালিক পর্যায়ে। জরিপে দেখা গেছে, বাজারে বিদ্যমান মোটা ধানের মূল্য সরকার ঘোষিত ১০৪০ টাকা এখনো অতিক্রম করেনি। তবে চিকন ধানের বাজারমূল্য ১৯ থেকে ২৭ শতাংশ বেড়েছে। বাজারে প্রতিমণ চিকন ধান ৯৫০ টাকা থেকে ১১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বড় চালকল মালিকরা ধান কিনে মজুদ করে চালের জোগান সংকোচন করায় বাজারে মূল্য অস্থিতিশীল হচ্ছে। ধানের বাজারে অস্বাভাবিকতা না থাকলেও অটো-চালকল মালিকদের কারসাজির কারণে চালের বাজার অস্থিতিশীল হতে দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে চালের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও মূল্য নির্ধারণ পুরোটাই চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় তারা কোনোভাবেই সে ক্ষমতা হাতছাড়া করতে চায় না। চালের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, খাদ্য ঘাটতির আতঙ্ক ও অতিরিক্ত মজুদের কারণে চালের মূল্যের ওপর প্রভাব দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কৃষি মন্ত্রণালয় গত ২৮ সেপ্টেম্বর একটি চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। ওই চিঠিতে চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে ধান/চালের বাজারমূল্য পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। তবে এখন পর্যন্ত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।

বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, ‘সরকারের এমন ঢালাও অভিযোগ একেবারে সঠিক নয়। আমরা চালের ব্যবসা করি। তার মানে আমরাই দাম বাড়িয়ে দেবো- এটা ঠিক নয়। আমরা বেশি দামে ধান কিনলে চাল বেশি দামে বিক্রি হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে যে হারে চালের দাম বেড়েছে, তার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এত দ্রুত চালের দাম বাড়ার কথা নয়। কোনো কোনো ট্রেডার হয়তো অতিরিক্ত মজুদ করতে পারে। অথচ তাদের মিল বন্ধ।’

খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার সম্প্রতি চালকল মালিক ও চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাথে বৈঠকের পর বলেন, ‘একশ্রেণির অসাধু চালকল মালিক অবৈধভাবে ধান ও চাল মজুদ করার জন্য চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়েছে। দেশে কৃষকদের কাছে ২ শতাংশ ধানও নেই। আমি ৯ দিন নওগাঁ, বগুড়া, জয়পুরহাট এলাকায় ঘুরেছি। বড় বড় মিলাররা কিছু পরিমাণ ধান মজুদ রেখেছে, এতে কোনো সমস্যা নেই। তবে দেখা গেছে, অনেক মিল বন্ধ, লাইসেন্সও নবায়ন করেনি- অথচ সেখানে হাজার টন ধান মজুদ রয়েছে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘গত দুই দিন আমি গোপন সার্ভে করে প্রায় ৫০টি মিলের খোঁজ পেয়েছি- এসব মিলে নিম্নে ২০০ টন থেকে সর্বোচ্চ তিন হাজার টন ধান মজুদ রয়েছে। এমনকি ৫০০ টন চালও মজুদ রয়েছে। এ সার্ভে যদি আরও সাত দিন করা হয় তা হলে শত শত চালকল পাওয়া যাবে, সেখানে এভাবে ধান মজুদ রাখা হয়েছে। আড়তদাররাও ধান ও চাল মজুদ করে রাখছে।’

চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেছেন, ‘আমরা যদি নির্ধারিত দামে চাল বিক্রি করি, এরপর সেটা যখন পাইকারি ও খুচরা বাজারে যাবে তখন দাম আরো বেড়ে যাবে, সেটিও যেন মনিটর করা হয়, তা সরকারকে জানিয়েছি।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh