চীন-ভারতের সীমান্ত বিরোধ

গৌতম দাস

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৪:৩৩ পিএম | আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৫:০৮ পিএম

চীন-ভারত সীমান্ত সংঘাত ও সংঘর্ষ গত মে থেকে প্রায় চার মাস পার হতে চলছে। ইতোমধ্যে গত জুনে অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে। এর পরে মোদি সরকার কিছুটা পিছু হটেছিল। মার খেয়ে হজম করেও স্বীকার করে নিয়েছিলেন- ভারতীয় কোনো ভূখণ্ড বা কোনো সীমান্ত পোস্ট চীনারা দখল করেনি। এখন পর্যন্ত এটাই ভারতের সরকারি আনুষ্ঠানিক ভাষ্য।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মতে, কোনো দুই রাষ্ট্রের সঙ্গে যা একবার আলোচনায় সাব্যস্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যায় তা খুবই সেনসেটিভ। কোনো একটা রাষ্ট্র এ নিয়ে পরে ‘একক’-ইচ্ছায় বলতে পারে না যে, আমি তা মানি না। এটাই অশিষ্ট রাষ্ট্রের লক্ষণ। আবার এর মানে এমন না যে, চুক্তি হওয়ার পরে আর কোনো পক্ষ বাতিল করতে পারবে না।

অথচ এটা একটা স্ববিরোধী গরমিলের ভাষ্য। কারণ চীনা সৈন্য যদি ভারতের দখলে থাকা কোনো ভূখণ্ড দখলে নিয়ে থাকে, তবে এর মানে হবে ভারতীয় সেনারাই চীনা ভূখণ্ডে অযাচিত অনুপ্রবেশ করার কারণেই চীনা সেনাদের হাতে নির্মমভাবে মৃত্যু হয়েছে। তাহলে বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে যে, মোদি নিজেই আগ্রাসী শক্তি- এটা স্বীকার করে নিচ্ছেন।

কিন্তু ঘটনাটা এমন হলো কেন? একটু পেছনে যেতে হবে। আজকের বিতর্কিত গালওয়ান উপত্যকাসহ পূর্ব লাদাখ এলাকা চীন দখলে নিয়েছিল ১৯৫৯-৬০ সালের দিকে, আর পুরোটাই দখলে নেয় ১৯৬২ সালের মধ্যে। এটা ওই সময়ের চীন-ভারত যুদ্ধ এবং দু’দিন চীনের আসাম দখল করে রাখার সময়ের ঘটনা। প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রিন্সলি স্টেট বা রাজকীয় কাশ্মীরেরই বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল এসব। এরপর থেকে কোনো কালেই এসব এলাকা চিহ্নিত সীমান্ত হয়ে থাকেনি। এরপর থেকে ইংরেজি এলএসি শব্দের চল শুরু হয়। এর মানে হলো, চীন ও ভারত যত দূর নিজের সীমান্ত এলাকা মনে করে (কিন্তু তাতে যদিও অপর পক্ষের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই) সেই দাগ হলো- এলএসি বা লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল। এখানে একচুয়াল শব্দের মানে বাংলায় ‘আসল’ সীমানা করলে ভুল হবে। অর্থটা হবে ‘বাস্তবের’ সীমানা। 

আসলে যে কোনো দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার আনুষ্ঠানিক ‘স্বীকৃত সীমান্ত’ বলতে বুঝতে হবে, সীমান্ত ডিমার্কেটেড বা উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে দাগ টানা হয়েছে এবং পারস্পরিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি মানচিত্র নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এটাকেই বলে ডিমার্কেটেড বা চিহ্নিত সীমান্ত। বলা বাহুল্য ওই একটি মানচিত্রের দুটি কপি দু’পক্ষ শেয়ার করে নেয়ার কারণে, ওই সীমান্ত নিয়ে আর কোনো বিতর্ক ওঠার সম্ভাবনা মূলেই নষ্ট হয়ে গেছে। তাই কেবল এসব ক্ষেত্রেই দু’দেশের মধ্যে আর কোনো সীমান্ত বিতর্ক থাকে না। চীন-ভারতের পূর্ব লাদাখ সীমান্ত- এটা ব্রিটিশ আমল থেকে কখনই ডিমার্কেটেড সীমান্ত ছিল না। মূল কারণ এটা ব্রিটিশ কলোনির সরাসরি অধীকৃত ভূমি নয়, কাশ্মীর তো করদ রাজ্য ছিল। তাই ১৯৬২ সাল থেকে এই এলএসি বা ‘যার দখলে যেটা আছে’ ধরনের সীমান্ত রেখা দিয়ে কাজ চলছে। তবে পরবর্তীতে এরও অনেক অগ্রগতি হয়েছিল। 

যে রাষ্ট্র ক্রমেই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পরাক্রমশালী হয়ে উঠছে, তার সীমান্ত অচিহ্নিত ফেলে রাখা ভালো সিদ্ধান্ত নয়। কারণ অচিহ্নিত থাকা মানেই তা থেকে কোনো সীমান্ত বিরোধ আর শেষে তা কোনো যুদ্ধ লেগে অস্থিতিশীলতার উৎস হয়ে উঠতে পারে; কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে কাশ্মীর করদ রাজ্য ছিল মানে সরাসরি ব্রিটিশ-কলোনির ভূখ- নয় বলে কখনই তা ডিমার্কেটেড করা হয়নি। আর তা থেকেই এত জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। তবে ১৯৯৩-৯৬ এই চার বছর অচিহ্নিত সীমান্ত কী করে ঐকমত্যে চিহ্নিত সীমান্ত করে নেয়া যায়, তা নিয়ে বিস্তর চীন-ভারত আনুষ্ঠানিক আলাপ আলোচনা হয়েছিল। আর তাতেই প্রতি বছর একেকটা নতুন এলএসি ওই আলোচনার ফলাফল হিসেবে বের হয়ে এসেছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল মূলত চীনের একটি নীতির কারণে। সীমান্ত চিহ্নিত হয়ে গেলে এর সুফল ভারতের চেয়ে চীনের বেশি হবে। কারণ সে পাওয়ারফুল রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে। তাই সে নীতি নেয় যে, সীমান্ত চিহ্নিত করতে গিয়ে বিতর্ক উঠলে, যেসব টুকরার তর্কের ভূমি স্ট্রাটেজিক্যালি চীনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেগুলোতে ছাড় দিয়ে ঐকমত্যের চিহ্নিতকৃত সীমান্ত করে ফেলার দিকে চীন জোর দেবে। না এ থেকে চীন ভারতের চেয়ে কত ভালো বা সুবোধ রাষ্ট্র এমন কোনো সিদ্ধান্ত আসাটা জরুরি না। মূলত চীনের আরো যেসব স্বার্থ আছে যেমন যে রাষ্ট্র অর্থনীতিতে গ্লোবাল নেতা হতে যাচ্ছে- তার সে সম্পর্কিত স্বার্থ অনেক গভীরের বিষয়। সে তুলনায় এগুলো অগুরুত্বপূর্ণ, এ থেকেই এই নীতি। তাই চীনের ছাড় দেয়া একেকটা নতুন এলাকার কারণে ওই চার বছরে প্রায় প্রতি বছর একটা নতুন করে এলএসি আঁকা হয়েছিল। তাই ভারতের দিক থেকে ১৯৯৬ সালে এলএসিটা সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছিল। মানে বেশি এলাকা ভারতের পক্ষে এসেছিল।

কিন্তু দুর্যোগ নেমে আসে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট। সেই দুর্যোগের দিন অমিত শাহ কাশ্মীরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের স্ট্যাটাস ভারতের সংবিধানের সেই ৩৭০ ধারা পার্লামেন্টে বাতিল ঘোষণা করেছিলেন। এতে কাশ্মীর সরাসরি ভারতের দখলকৃত ও অধীনস্ত এলাকা বলে দাবির স্বীকৃতির শুরু হয়; কিন্তু এত দূর থাকলেও বোধহয় চীনের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা এত বাড়ত না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অমিত শাহ এরপর সংসদে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বসেন- পুরা কাশ্মীর ভারতের অধীকৃত আর দুই কাশ্মীরের এলাকা- পাকিস্তান আর চীন অধিকৃত আকসাই চীন ও ভারত দখল করবে। এই ঘোষণাই ছিল- সব কিছুর টার্নিং পয়েন্ট।

এতে নেহেরুর কাশ্মীর-ভাবনা আর মোদির কাশ্মীর ভাবনার ভিন্নতা তৈরি হয়ে যায়। আর তা হলো যে- নেহেরু মেনে নিয়েছিলেন কাশ্মীরকে ওর রাজার কাছে দেয়াটাই হবে বৈধ অধিকারীর কাছে দিয়ে দেয়া? নাকি কাশ্মীরের জনগণ এর প্রকৃত অধিকারী, তাই কাশ্মীরের জনগণের রেফারেন্ডমে তা নির্ধারিত হতে হবে- এ বিতর্কিত বিষয়টির কারণে নেহেরু কাশ্মীরকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা দিয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। আর ওই স্ট্যাটাস সম্পর্কিত ধারা হলো সংবিধানের ৩৭০ ধারা। এর বিপরীতে মোদি স্রেফ হিন্দুত্বের দল ক্ষমতায় এই গায়ের জোরে কোনো আইনি ভিত্তির ধার না ধরে বললেন কাশ্মীর ভারতের। আর কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে দিয়েছিলেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বহুবার ৩৭০ ধারায় হাত না দিতে রায় দিয়েছিল; কিন্তু মোদি এর ভয়াবহ দিকটা নিয়ে ভাবেননি। আর তা হলো ১৯৬২ সালের পরে অন্তত ১৯৯৩-৯৬ সাল ধরে চীনের সঙ্গে লাদাখ সীমান্ত নিয়ে যা আনুষ্ঠানিক আলোচনা ও ভূমি ছাড় দেয়ার বিষয় ছিল, তা মোদি-অমিত শাহ আর স্বীকার করেননি- এটাই তারা ঘোষণা দিয়ে ফেলেছিলেন। অর্থাৎ লাদাখ নিয়ে যা কিছু আলোচনা ও ঐকমত্য এতদিন চীনের সঙ্গে হয়েছিল তা আর ভারত মানে না- এই বিপজ্জনক অর্থ মোদি-অমিত শাহ দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তাই এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মতে, কোনো দুই রাষ্ট্রের সঙ্গে যা একবার আলোচনায় সাব্যস্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যায় তা খুবই সেনসেটিভ। কোনো একটা রাষ্ট্র এ নিয়ে পরে ‘একক’-ইচ্ছায় বলতে পারে না যে, আমি তা মানি না। এটাই অশিষ্ট রাষ্ট্রের লক্ষণ। আবার এর মানে এমন না যে, চুক্তি হওয়ার পরে আর কোনো পক্ষ বাতিল করতে পারবে না। অবশ্যই পারবে; কিন্তু তা পদ্ধতি মোতাবেক করতে হবে। যেমন কেউ বাতিল করতে চায় সেটা অন্যকে জানাবে, এরপর এ নিয়ে আলোচনার তারিখ নির্ধারণ করে চুক্তির বিধি মোতাবেক প্রস্তাব ও আলোচনা করে উভয়ের সম্মতিতে নতুন সিদ্ধান্ত নেবে।

এই রীতি সরাসরি ভঙ্গ করেছে মোদি-অমিত শাহ। আর সে কারণেই গত মে মাস থেকে চীন যা করেছে তা হলো- তারা ১৯৫৯ সালের এলএসি মোতাবেক সব জায়গা (যা ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নয়া এলএসিতে ভারতকে দিয়ে দিয়েছিল) তা আবার ভারতের হাত থেকে ফিরে দখল করে নিয়েছে। চীন বলতে চায় যে, রেজিম দু’রাষ্ট্রের মধ্যকার আপোষ-আলোচনাকে একা অস্বীকার করে বসে, কাজেই ওসব আলোচনায় দেয়া ভূমি আর ভারতেরও নয়। আর মোদি চীনের অবস্থান জানার পর নিজ জনগণের সঙ্গে চাতুরি করেন। তিনি কেবল বলেছেন ভারতের কোন ভূমি চীন দখল নেয়নি; কিন্তু কোন সালের হিসাবে ভারত ভূমি দখল করেছিল- ১৯৫৯ নাকি ১৯৯৬ সালে? তা পরিষ্কার করেনি। এভাবে বুঝিয়েছেন ১৯৯৬ সাল; কিন্তু আসলে মেনে নিয়েছেন ১৯৫৯ সাল।

কিন্তু চীনের দিক থেকে এর পরে কী? চীন কীভাবে সীমান্ত ঝগড়ার পরিণতি টানতে চায়, ভারতকে হারাতে চায়? এ পর্যন্ত এ নিয়ে চীনা বড় ইঙ্গিত হলো ‘মিলিটারি লস’, যা শেষে ভারতের অর্থনৈতিক-সামরিক ক্ষতি ও অসহায়ত্তকে বৃদ্ধি করবে।

শ্যাম শরণ, ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব, আর এর চেয়েও বড় পরিচয় হলো তিনি ২০০৬ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বিশেষ দূত ছিলেন। তিনি এখন এমন কিছু ঘরের সত্য কথা তুলে ধরেছেন, যেটা হতে পারে মোদি-অমিতের ব্যাকডোর পরামর্শে, নয়তো এটা কংগ্রেসের উৎসাহে। তিনি বলেন, আসন্ন শীতকালে লাদাখের ভারতীয় সেনা ফিরিয়ে আনতে হবে, কারণ তাদের উষ্ণ রাখবার অর্থনৈতিক খরচ বইবার সামর্থ ভারতীয় অর্থনীতির নেই।

এর মানে এখন যদি চীন আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত লাদাখ ধরে রাখতে পারে, তবে সেটাই হবে ভারতের ওপর শেষ আঘাত? নাকি এর আগেও চীন ভারতের ওপর ছোট স্কেলে কোন সামরিক পদক্ষেপে যাবে, কথিত মিলিটারি লস নিশ্চিত করতে?

তাই চীন-ভারতের সীমান্ত বিরোধ কীভাবে শেষ হয়, তা দেখতে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।


লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh