খালিদ ইফতেখার
প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২০, ০১:০৯ পিএম | আপডেট: ০৭ আগস্ট ২০২০, ০১:১৩ পিএম
বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রমথ চৌধুরীর ১৫২ তম জন্মদিন আজ। বাংলা সাহিত্যে তিনি বীরবল নামেই সমধিক পরিচিত। পরবর্তীতে তিনি বিখ্যাত ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কৃতিত্বের সাথে পালন করেন।
বাংলা সাহিত্যকে তিনি নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন সমালোচক। বর্তমানে সমালোচনার নামে যদিও অনেকে নিন্দা করে, ব্যক্তিকে খাটো করে, তার সৃষ্ট কর্মকে তুলোধুনো করে ব্যক্তি আক্রোশে। প্রমথ চৌধুরী ছিলেন তার উল্টো স্রোতের যাত্রী। ব্যক্তি আক্রোশ তাঁর সমালোচনায় ছিলো না বললেই চলে। তিনি সাহিত্যের গঠনমূলক সমালোচনা করতেন। যা এখনো তাঁকে প্রথম শ্রেণির সমালোচকের আসনে সমাসীন রেখেছে।
প্রমথ চৌধুরী ১৮৬৮ সালের ৭ আগস্ট যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার হরিপুরে। স্থানীয় জমিদার বংশে তাঁর জন্ম, তাঁর পিতার নাম দুর্গাদাস চৌধুরী। তাঁর মায়ের নাম সুকুমারী দেবী যিনি বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজো বোন ছিলেন।
প্রমথ চৌধুরী কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে বি.এ. পাস, ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে এম.এ পাশ করেন। তাঁর শিক্ষা জীবন ছিলো অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড গমন করেন এবং তিনি সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথেই ব্যারিস্টারি পাশ করেন।
কর্মজীবনে কিছুকাল তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপনা ছাড়াও সরকারের উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রমথ চৌধুরী কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে বি.এ. পাস, ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে এম.এ পাশ করেন। তাঁর শিক্ষা জীবন ছিলো অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড গমন করেন এবং তিনি সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথেই ব্যারিস্টারি পাশ করেন।
সাহিত্যিক ছদ্মনাম হিসেবে তিনি “বীরবল” নামটি ব্যবহার করতেন। রবীন্দ্রনাথের ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরা দেবীর সাথে প্রণয়াবদ্ধ হন।
বাংলা সাহিত্যের এই বিখ্যাত দিকপাল, মননশীল, যুক্তিবাদী, সৃষ্টিশীল ভাষাবিদ, কবি, সুপ্রাবন্ধিক, গল্পকার ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে শান্তিনিকেতনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রমথ চৌধুরীর মতে, সাহিত্যের উপাদান হচ্ছে মানবজীবন ও প্রকৃতি। মানব জীবনের সাথে যার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ নেই তা সাহিত্য নয়। তবে সাহিত্য মানব জীবনের বস্তুগত রূপ নয়, আবার প্রকৃতির হুবহু অনুকরণও নয়। মানবজীবন ও প্রকৃতি থেকে গ্রহণ বর্জনের মাধ্যমে উপযুক্ত উপাদান নির্বাচন করে শিল্পী মনের রূপ-রস, সুখ-দুখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা মিলিয়েই সৃষ্টি হয় প্রকৃত সাহিত্য। আমরা তাঁর রচনার প্রত্যেক পরতে পরতে দেখতে পাই মানবজীবন ও প্রকৃতির উপাদানের নির্যাসের পরিপূর্ণ অবয়বের চিত্র। মূলত সাহিত্যের দুটি দিক রয়েছে। যথা-বিষয় ও সৌন্দর্য। প্রমথ চৌধুরী সাহিত্যে বিষয় ও সৌন্দর্যকে সমমূল্যে বিচার করেছেন।
দর্শন, রাষ্ট্রনীতি, ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি নানা বিষয়ে তিনি যেসব প্রবন্ধ লিখেছেন সেগুলোর সর্বত্রই তাঁর রচনায় তীক্ষ্ণ মৌলিকতার চিহ্ন রয়েছে। বিষয়ের অভ্যন্তরে বিতর্কের ভঙ্গিতে প্রবেশ করে তার প্রাণকেন্দ্রটিকে আলোকপাত করতে প্রমথ চৌধুরীর জুড়ি নেই। সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও তিনি সেইভাবে খ্যাত। তাঁকে এক কথায় সৃষ্টিশীল এবং রূপবাদী আখ্যা দেয়া যেতে পারে।
নিঃসন্দেহে তাঁর লেখার ধাঁচ বাংলা সাহিত্যের জন্য মাইলফলক। তিনি ছিলেন মননশীল ও প্রচণ্ড যুক্তিবাদী। “মার্জিত রুচি, পরিষ্কৃত বুদ্ধি, সংযত ভাষা ও বিনীত ব্যবহার মানুষকে চিরকাল মুগ্ধ করে এসেছে এবং সম্ভব চিরকাল করবে।” তিনি বলেছেন- “জ্ঞানের প্রদীপ যেখানেই জ্বালো না কেন, তাহার আলোক চারিদিক ছড়াইয়া পড়িবে।”
মনোজগতে বাতি জ্বালানোর জন্যে সাহিত্যচর্চার বিশেষ প্রয়োজন। স্বদেশপ্রীতি সম্পর্কে তাঁর অভিমত- আমরা স্বদেশে যাতে বিদেশি না হই, সে বিষয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে। তিনি মানসিক যৌবনকেই সমাজে প্রতিষ্ঠার প্রয়াসী। কাব্যসাধনা যে কখনো ‘জোর-করা ভাব, আর ধার-করা ভাষা’য় হয় না সে বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন। পাবনার বিখ্যাত চৌধুরী বংশের সন্তান প্রমথ চৌধুরী কেবল কুলে-মানে অভিজাত ছিলেন তা নয়, মনের দিক থেকে ছিলেন উদার।
পারিবারিক সূত্রে রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী-জামাতা এবং বয়োকনিষ্ঠ্য হয়েও গদ্য রচনারীতিতে তাঁকে প্রভাবিত করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী। তার গল্প, সনেট, বাংলা সাহিত্যে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি, কিন্তু প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ এবং ভাষাভঙ্গি আর ভাবনার ধারা পরবর্তী একটি গোষ্ঠীর উপর বিশেষ ক্রিয়াশীল হয়েছে। তাই রবীন্দ্র যুগের লেখক হয়েও বাংলা গদ্যের একটা স্বতন্ত্র ধারা প্রতিষ্ঠার দাবিদার হিসেবে প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ খ্যাত। বাংলায় কথ্যরীতি তাঁরই হাতে সাহিত্যিক স্বীকৃতি লাভ করে। রবীন্দ্রনাথের জোর সমর্থন এবং ব্যক্তিগত চেষ্টায় সে রীতি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বস্তুত, প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪)পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই এই দুজনের প্রচেষ্টাতে এই কথ্যরীতির পূর্ণতম প্রাণপ্রতিষ্ঠা ঘটে।
প্রমথ চৌধুরী বাংলাভাষীকে বোঝাতে পেরেছিলেন, “ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।” উল্টোটা চেষ্টা করতে গেলেই মুখে শুধু কালি পড়ে।” ‘সবুজপত্র’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে প্রমথ চৌধুরী বাংলা গদ্যে নবরীতি প্রবর্তন করেন এবং তাঁর প্রবন্ধাবলীতে প্রমাণ করেন যে, চলিতভাষায় লঘুগুরু সকল প্রকার ভাবভাবনার প্রকাশ সম্ভব। নাগরিক বৈদগ্ধ, মননের তীক্ষ্ণতা, চমক, রোমান্টিক ভাবালুতার বিরুদ্ধতা, বুদ্ধির অতিচর্চা এবং কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গ, কিঞ্চিৎ রঙ্গ-ব্যঙ্গের হাসি প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধের ভাষায় বিধৃত। উইট এপিগ্রামের সুপ্রচুর ব্যবহারে তাঁর প্রবন্ধ-পাঠক সদা-উচ্চকিত।
প্রমথ চৌধুরী একটি উপন্যাসও লেখেন নি। বৃহদাকৃতি রচনার প্রতি তাঁর কিছুমাত্র আকর্ষণ ছিলো না, মেজাজ ছিলো তাঁর ছোট লেখার অনুকূল। বাংলা সাহিত্যে বিদগ্ধ, যুক্তিনিষ্ঠ সুপ্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী বাংলায় ফারসি ছোটগল্পের আঙ্গিকরীতিকে তিনিই প্রথম পরিচিত করিয়েছিলেন। রূপসিদ্ধতা, ও আঙ্গিক গঠনের দুর্লভ নিপুণতার পরিচয় ও ভাষায় মননশীলতা, বাকচাতুর্যের চমৎকারিত্ব এবং বুদ্ধির অসিচালনা তাঁকে দিয়েছে এক বিশিষ্ট ‘স্টাইল’ ফরাসি সংজ্ঞায় যা প্রমথ চৌধুরী স্বয়ং।
জীবন ঘনিষ্ঠ লেখাই তাঁকে কালের ম্রিয়মাণ রেখায় মূর্ত করে রেখেছে। ধ্রুব সত্য হলো মানবজীবনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক না থাকলে ব্যক্তি ভালো মানের সাহিত্য রচনা করতে পারে না। যে জীবনের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ হতে সাহিত্য সৃষ্টি হয় তা দৈনিক জীবন নয়। কথায় চিড়ে না ভিজলেও যে কথার দ্বারা মন ভেজে তা অনস্বীকার্য। যে কথায় মন ভেজে সে কথা দিয়েই রচিত হয় সাহিত্য। কাক-কোকিল যে ভাষায় মানুষের ঘুম ভাঙায়, মানুষকে জাগিয়ে তোলে, সাহিত্যে সে জাগরণের ভাষা থাকা দরকার। আর এসব সকল দিক দিয়েই যেন তার রচনা ছিলো সমৃদ্ধ।
বাংলা সাহিত্যে ‘রম্য’ সাহিত্যের প্রচার, প্রসার, বাকবৈদগ্ধতা ও সুনিপুণ বিন্যাসে, চুটকির নতুনত্বে প্রমথ চৌধুরীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
তিনি বাংলা সাহিত্যে ইতালীয় সনেটের প্রবর্তক হিসেবে খ্যাত। বাংলা সাহিত্যে নিজস্ব ধারায় সনেট রচনা করেছেন। তাঁর রচনাসম্ভার নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
কাব্যগ্রন্থ: সনেট পঞ্চাশৎ (১৯১৯),পদচারণ (১৯২০)।
গল্পগ্রন্থ: চার ইয়ারি কথা (১৯১৬), আহুতি (১৯১৯) ঘোষালের ত্রিকথা, (১৯৩৭), নীল লোহিত (১৯৩৯), অনুকথা সপ্তক (১৯৩৯) সেকালের গল্প (১৯৩৯), ট্রাজেডির সূত্রপাত (১৯৪০), গল্পসংগ্রহ (১৯৪১), নীল লোহিতের আদি প্রেম (১৯৪৪) দুই বা এক (১৯৪০)।
প্রবন্ধগ্রন্থ: তেল-নুন-লাকড়ি (১৯০৬), নানাকথা (১৯১১), বীরবলের হালখাতা (১৯১৭), আমাদের শিক্ষা (১৯২০), দুই ইয়ারির কথা (১৯২১), বীরবলের টিপ্পনী (১৯২৪), রায়তের কথা (১৯২৬), নানাচর্চা (১৯৩২), ঘরে বাইরে (১৯৩৬), প্রাচীন হিন্দুস্থান (১৯৪০), বঙ্গ সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় (১৯৪০), প্রবন্ধ সংগ্রহ (১ম ও ২য় খণ্ড) (১৯৫২-১৯৫৩)
সবুজপত্র ও প্রমথ চৌধুরী
(ক) সবুজ পত্র (১৯১৪) বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত এ-পত্রিকা বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। (সুকুমার : ২০১) পরিচ্ছন্ন ও উন্নত রুচির সাহিত্যসৃষ্টি, তারুণ্য ও যৌবনের জয়গান এবং চলিতরীতির সচেতন ও সার্থক প্রচলন ছিলো এ-পত্রিকার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সমকালীন ও পূর্ববর্তী অন্যান্য পত্র-পত্রিকা থেকে এটি ছিলো ‘সম্পূর্ণ আলাদা।’ (সুকুমার : ২৫২) পুরনো ধ্যান-ধারণা, রক্ষণশীল ও গতানুগতিক চিন্তা-চেতনার পরিবর্তে যুগধর্মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নতুন বিষয় ধারণ এবং আন্তর্জাতিক সারস্বত সমাজে প্রচারিত ও প্রচলিত বিভিন্ন সাহিত্যিক-দার্শনিক তথ্য-তত্ত্বের আলোচনা এ-পত্রিকাকে দান করেছিল অভিনবত্ব।
সম্পাদকের নিবেদন অংশে প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, একটা নবযুগ তার আনুষঙ্গিক নানারূপ আশা বিভীষিকা সঙ্গে নিয়ে আমাদের দুয়োরে এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে কিভাবে আমরা ঘরে তুলে নিই আদরে না অবহেলায়, আনন্দে না আশঙ্কায়, তার উপর আমাদের জাতীয় ভবিষ্যৎ অনেকটা নির্ভর করছে। আমাদের মত যারা এই নবযুগের উদ্যোগতা তাদের পক্ষে এ সময়ে নীরব থাকা অসম্ভব। (প্রমথ : ১৩২৭, ১)
নতুন যুগের দাবি মেটানোর পাশাপাশি এ-পত্রিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল নতুন লেখকগোষ্ঠী। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এদের প্রধান পুরোহিত। প্রমথ চৌধুরীর বহু লেখা এ-পত্রিকায় স্থান পায়। তিনি চলিত গদ্যরীতির সার্থক রূপায়ণ যেমন ঘটান, তেমনি ‘বীরবলী ঢং’ (অরুণ : ১৯৬৬, ৭৬) নামক বাগ্বৈদগ্ধ্যপূর্ণ গদ্যশৈলী প্রবর্তন করেন। এক কথায় সবুজ পত্রকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি জীবনে নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হয়। মুক্তচিন্তা, গণতন্ত্র, যুক্তি এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রকাশ (সিরাজুল : ২০০৩, ৩৬) ছিলো এ-পত্রিকার মূলমন্ত্র।
বাংলা সাময়িকপত্রিকার ইতিহাসে সবুজ পত্রের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য নানা দিক থেকে। পত্রিকার প্রচলিত রীতি অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। …নব্যতন্ত্রী সাহিত্যের গতিপথ নির্দেশই ছিলো এর মূল উদ্দেশ্য। আভিজাত্য ও কৌলিন্য এর চালচলন ও রুচিতে ফুটে উঠেছে। এর দৃষ্টিভঙ্গিতে আধুনিকতার ছাপ সুস্পষ্ট। গত প্রথম মহাযুদ্ধ ও তার প্রাক্কালে যে নবীন চিন্তাধারা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভূমিকে নূতন ফসলের সম্ভাবনায় উর্বর করে তুলেছিল, সবুজ পত্র সেই আধুনিক চিন্তাধারার বাণীবাহক। (রথীন্দ্রনাথ : ২৮)
(খ) সবুজ পত্র নামের মধ্যেই এর স্বরূপ নিহিত ছিলো। এর নামকরণ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরী সরস ও যুক্তিগ্রাহ্য অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতির স্নিগ্ধতার সঙ্গে সবুজ পত্রের অন্তর্নিহিত সম্পর্ক ছিলো। সবুজ প্রকৃতি বঙ্গদেশকে দিয়েছে অপূর্ব মহিমা। সবুজের সমারোহ এ-দেশকে আদ্যোপান্ত ছেয়ে রেখেছে। বাংলার বাইরেও ঘটেছে সবুজের বিস্তার। উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত কেবল সবুজ আর সবুজ। বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ফুল-ফলের বর্ণিল উপস্থিতি দৃশ্যমান হলেও বাংলার স্থায়ী রূপ সবুজ প্রকৃতির মধ্যেই প্রকাশিত হয়। বর্ণরাজ্যেও সবুজই সেরা। নিজগুণেই সবুজ বর্ণরাজ্যের কেন্দ্রস্থল অধিকার করেছে। বেগুনি, লাল, নীল, পীত সবই যেন সবুজের সরস প্রাণের উৎসবে শ্রীহীন।
প্রকৃতিরাজ্যে সবুজের এই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমথ চৌধুরীর দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে এভাবে
সবুজ হচ্ছে এই বর্ণমালার মধ্যমণি। এবং নিজগুণেই সে বর্ণরাজ্যের কেন্দ্রস্থল অধিকার করে থাকে। বেগুনি কিশলয়ের রঙ, জীবনের পূর্বরাগের রঙ; লাল রক্তের রঙ, জীবনের পূর্ণরাগের রঙ; নীল আকাশের রঙ, অনন্তের রঙ; পীত শুষ্ক পত্রের রঙ, মৃত্যুর রঙ। কিন্তু সবুজ হচ্ছে নবীন পত্রের রঙ, রসের ও প্রাণের যুগপৎ লক্ষণ ও ব্যক্তি। তার দক্ষিণে নীল আর বামে পীত, তার পূর্বসীমায় বেগুনি আর পশ্চিমসীমায় লাল। অন্ত ও অনন্তের মধ্যে, পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে, স্মৃতি ও আশার মধ্যে মধ্যস্থতা করাই হচ্ছে সবুজের অর্থাৎ সরস প্রাণের স্বধর্ম।
সবুজ পত্র ছিলো খাঁটি সাহিত্য পত্রিকা। সাহিত্যের স্বরূপ এবং আদর্শ ও উদ্দেশ্য-সম্পর্কিত নানা মত এতে স্থান পেয়েছে। সাহিত্যচর্চার আদর্শ ও উদ্দেশ্য-সম্পর্কিত যেসব প্রবন্ধ সবুজ পত্রে স্থান পেয়েছে, সেগুলো হলো- প্রমথ চৌধুরীর ‘সাহিত্যে খেলা’, ‘সাহিত্য-সম্মিলন’, ‘বর্তমান বঙ্গ-সাহিত্য’, ‘ফরাসি সাহিত্যের বর্ণপরিচয়’, ‘সাহিত্যের ভাষা’, ‘সাহিত্যের সার্থকতা’, ‘সাহিত্য বনাম পলিটিক্স’; বীরেশ্বর মজুমদারের ‘জাতীয় জীবনে সাহিত্যের উপযোগিতা’, মহীতোষ কুমার রায় চৌধুরীর ‘সাহিত্যে আভিজাত্য’, রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের ‘সাহিত্যে বাস্তবতা’, সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর ‘গীতি-কবিতা’, নলিনীকান্ত গুপ্তের ‘সমকালীন সাহিত্য’, শিশিরকুমার সেনের ‘সাহিত্য-বিচার’ প্রভৃতি।
সবুজ পত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘আনন্দ-তত্ত্ব’ এঁরা মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা মনে করতেন সাহিত্যের লক্ষ্য পাঠকের মনকে জড়তামুক্ত করা এবং উদ্দেশ্য মানুষের মনকে জাগানো। ৩৪ প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেয়া, কারো মনোরঞ্জন করা নয়।’ সাহিত্যকে স্বদেশ কিংবা স্বকালের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমগ্র বিশ্বচরাচরে ছড়িয়ে দেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন তিনি। ‘জাতির কোনো একটি অভাব পূরণ করা সাহিত্যের কাজ নয়। কারণ, এতে করে মনের ভেতর সংকীর্ণতার সৃষ্টি হয়ে সাহিত্যের অবাধ স্ফূর্তিকে ব্যাহত করে।’ সবুজ পত্রের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে এর সারথিদের সাহিত্য-সম্পর্কিত চিন্তা-চেতনা।
সবুজ পত্রের সমসাময়িক যুগ ছিল ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ। একদিকে প্রথম মহাযুদ্ধের দামামা, অন্যদিকে ইউরোপীয় চিন্তা-চেতনার প্রভাবে বাঙালির সমাজ ও জীবনে লাগে নানাবিধ পরিবর্তন ও রূপান্তরের ছোঁয়া। গণতন্ত্র, যুক্তিবাদ এবং প্রগতিশীলতার স্পর্শে রাষ্ট্র ও সমাজে শুরু হয় নবজাগরণ। এমন যুগ-পরিবেশকে স্বাগত জানিয়েই সবুজ পত্রের আত্মপ্রকাশ। হাসান আজিজুল হক বলেছেন, ‘গতি চাই, খোলস ঝেড়ে ফেলতে চাই, পুরনোকে বিদায় করতে চাই, নতুনের আবাহন চাই। এই হলো সবুজ পত্র প্রকাশের পটভূমি।’ (আজিজুল : ২০১৪, ১৪৮) অর্থাৎ-বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তা দ্বারা যুগের পরিবর্তনকে স্বাগত জানানো এবং সাহিত্যের মাধ্যমে অসত্য, হিংসা-দ্বেষ এবং ইতরতার বিনাশ সাধনই ছিল সবুজ পত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
প্রমথ চৌধুরী নিজেই বলেছেন, ‘একদিকে ডিমোক্র্যাসি গড়ে তোলবার সাহায্য করা যেমন আমাদের পক্ষে কর্তব্য আর একদিকে এই মিছে কথা, এই দ্বেষহিংসা এই বৈশ্যবুদ্ধি এই ইতরতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করাও আমাদের পক্ষে তেমনি কর্তব্য এবং সে অস্ত্র হচ্ছে সাহিত্য।’ (প্রমথ : ১৩২৭, ৪) সবুজ পত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর যুগের বিদ্রোহী সন্তান। (রথীন্দ্রনাথ : ১৯৬৯, ২৭) একদল চিন্তাশীল, আধুনিকতা-মনস্ক তেজোদীপ্ত মানুষকে সংঘবদ্ধ করে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য এ-পত্রিকা কাজ করেছে।
সবুজ পত্র আকস্মিকভাবে প্রকাশিত হয় নি। এর পেছনে ছিলো গভীর ও সুদূপ্রসারী চিন্তা-চেতনা। এর জন্ম ও বেড়ে ওঠা জাতির জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো এবং এই বিশিষ্ট কারণেই সমসাময়িক এবং পরাগত কালের বহু পত্রিকার ইতিহাসে এর একটি সুনির্দিষ্ট ও স্বতন্ত্র স্থান আছে। (বারিদবরণ : ১৯৯৯) রথীন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন, ‘সবুজ পত্রের সবচেয়ে বড় কাজ ছিলো সাহিত্যের ভাষা আন্দোলনে সারথ্য করা। সাধু ভাষা ও চলিত ভাষার মধ্যে দীর্ঘ বিরোধের মীমাংসা সবুজ পত্রের মাধ্যমেই সম্ভব হয়। …পত্রিকার প্রচলিত রীতি এতে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। বক্তব্য ও বলার অভিনব স্টাইল দুই-ই সবুজপত্রের বৈশিষ্ট্য।’ (রথীন্দ্রনাথ : ২৮)
প্রমথ চৌধুরী সবুজ পত্রের মাধ্যমে বাংলা চলিত গদ্যরীতির আন্দোলনে সৈনাপত্য গ্রহণ করেছিলেন; স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সৈনাপত্য মেনে নিয়েছিলেন। সবুজ পত্রই সর্বপ্রথম চলিত গদ্যের সার্থক রূপায়ণে আন্দোলন শুরু করে। তবে এও সত্য যে, সবুজ পত্রের আগে মুখের ভাষা এবং বিভিন্ন নাটক, চিঠিপত্র, গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাসে চলিত গদ্য ব্যবহৃত হয়েছে। আরো নির্দিষ্ট করে বলা যায়, উনিশ শতকের চিঠিপত্রে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের কোনো কোনো রচনায়, বিদ্যাসাগরের গ্রন্থে, আলালী-হুতোমী গদ্যে, শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রবন্ধে, বসন্তক এবং সন্দেশ-এর মতো হাস্যরসের পত্রিকায়, যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হাসিখুশিতে এবং লোকেন্দ্রনাথ পালিতের গল্পে চলিত গদ্য ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে চলিত গদ্যের ব্যবহার ছিলো বিচ্ছিন্ন চিন্তার ফসল, সচেতন প্রয়াস এতে ছিলো না বললেই চলে। প্রাসঙ্গিকভাবে আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮) ও হুতোম প্যাঁচার নকশা (১৮৬২)-র কথা বলা যায়। এতে মৌখিক, আঞ্চলিক ও উপভাষার বাক্য ও শব্দাবলী অনেকাংশে ব্যবহৃত হলেও সাধুভাষার প্রয়োগই এখানে মুখ্য। সাহিত্য তথা লেখ্য ভাষায় সর্বাত্মক ও সচেতনভাবে চলিত গদ্য ব্যবহারের আন্দোলন সবুজ পত্রের মাধ্যমেই প্রথম সূচিত হয়। এ-প্রসঙ্গে পবিত্র সরকারের মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
(গ) চলিত গদ্যরীতিকে সাহিত্যে ব্যাপকভাবে প্রচলনের জন্য সবুজ পত্র গোষ্ঠীর লেখকগণ, বিশেষ করে প্রমথ চৌধুরী গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। সবুজ পত্র প্রকাশের পূর্বেই ভারতী পত্রিকায় এ-নিয়ে তিনি ‘কথার কথা’ (জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা, ১৩০৯), ‘বঙ্গভাষা বনাম বাবু-ভাষা ওরফে সাধুভাষা’ (পৌষ সংখ্যা, ১৩১৯), ‘সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা’ (চৈত্র সংখ্যা, ১৩১৯)-নামে তাঁর তিনটি প্রবন্ধ লেখেন। সবুজ পত্রের বিভিন্ন সংখ্যায় চলিত ভাষা প্রচলনের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করে লেখেন-‘অভিভাষণ’ (ফাল্গুন সংখ্যা, ১৩২১), ‘ভাষার কথা’ (আষাঢ় সংখ্যা, ১৩২২), ‘লিখিবার ভাষা (বঙ্কিমচন্দ্রের মতে)’ (বৈশাখ সংখ্যা, ১৩২৪), ‘বাঙ্গালা-ভাষার কুলের খবর’ (শ্রাবণ সংখ্যা, ১৩২৪), ‘বাংলার ভবিষ্যৎ’ (অগ্রহায়ণ সংখ্যা, ১৩২৪), ‘বাঙলা কি পড়ব?’ (কার্তিক সংক্যা, ১৩২৫), ‘টীকা ও টিপ্পনি’ (ভাদ্র সংখ্যা, ১৩২৭), ‘আমাদের ভাষা-সংকট’ (জৈষ্ঠ-আষাঢ় সংখ্যা, ১৩২৯) এই আটটি লেখা।
প্রমথ চৌধুরী সাধু গদ্যরীতিকে মনে করতেন মৃত ও প্রাণহীন। এও মনে করতেন যে, সাধুরীতির শব্দরাজি সংস্কৃত ভাষা থেকে ধার করা, ফলে তা ‘গুরুগম্ভীর, দীর্ঘকায় ও চলৎশক্তি রহিত।’ ‘বঙ্গভাষা বনাম বাবু-বাংলা ওরফে সাধুভাষা’ প্রবন্ধে তিনি নানা যুক্তির মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, সাধুভাষার তুলনায় মুখের ভাষা জীবন্ত, প্রাণবন্ত ও বিচিত্র ভাবপ্রকাশের উপযোগী। মানুষের আবেগ, অনুভূতি মুখের ভাষায় যতটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয়, সাধুভাষায় ততটা হয় ন। প্রমথ চৌধুরী চেয়েছেন লেখার ভাষা ও মুখের ভাষার মধ্যেকার ব্যবধান দূর করতে। তিনি বিশ্বাস করতেন : ‘ভাষা মানুষের মুখ হতে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ হতে মানুষের মুখে নয়।’ মুখের ভাষা ও লেখার ভাষার ব্যবধান যতই কমবে ততই সাহিত্যের কল্যাণ সাধিত হবে। এ-প্রত্যয় থেকেই লিখেছেন : ‘যতদূর পারা যায়, যে ভাষায় কথা কই সেই ভাষায় লিখতে পারলেই লেখা প্রাণ পায়। আমাদের প্রধান চেষ্টার বিষয় হওয়া উচিত কথায় ও লেখায় ঐক্য রক্ষা করা, ঐক্য নষ্ট করা নয়।’
শতবর্ষ পরে সবুজ পত্র পুনঃপাঠ ও পুনর্মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলা যায়, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি জীবনে এ-পত্রিকার প্রভাব ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। বাঙালির আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা, মননশীলতা এবং উন্নত রুচি গঠনে সবুজ পত্রের অবদান অনস্বীকার্য। কী ভাষাশৈলী, কী বিষয়রূপ, কী শিল্পরুচি-সবদিক থেকেই বাংলা সাহিত্যে সবুজ পত্রের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব কিছু-না-কিছু প্রভাব রয়েছেই। যুগ, সময়, পরিবেশ এবং ব্যক্তি বিশেষে সে-প্রভাব ভিন্নরূপ হলেও কোনোভাবেই তা দুর্লক্ষ্য নয়। কেবল শতবর্ষ নয়, আরো দীর্ঘ সময় এ-পত্রিকার প্রভাব বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যে অক্ষুণ্ণ থাকবে। বাঙালির ব্যক্তিজীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তায় সঞ্চারিত হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী তথা সবুজ পত্রের সারথিদের চিন্তা-চেতনা ও মননশীল ভাবধারার তড়িৎ-প্রবাহ।
সাহিত্য মানবজীবনের প্রধান সহায়, কারণ তার কাজ হচ্ছে মানুষের মনকে ক্রমান্বয় নিদ্রার অধিকার হতে ছিনিয়ে নিয়ে জাগরুক করে তোলা। আমাদের বাংলা সাহিত্যের ভোরের পাখিরা যদি আমাদের প্রতিষ্ঠিত সবুজ পত্রমণ্ডিত সাহিত্যের নবশাখার উপর এসে অবতীর্ণ হন তা হলে আমরা বাঙালি জাতির সবচেয়ে যে বড়ো অভাব, তা কতকটা দূর করতে পারব। সে অভাব হচ্ছে আমাদের মনের ও চরিত্রের অভাব যে কতটা, তারই জ্ঞান। …সাহিত্য জাতির খোরপোশের ব্যবস্থা করে দিতে পারে না, কিন্তু তাকে আত্মহত্যা থেকে রক্ষা করতে পারে।
মার্জিত নাগরিক রুচি, প্রখর বুদ্ধির দীপ্তি, অপূর্ব বাকচাতুর্য ও স্মিত রসিকতায় তাঁর গদ্য রচনা সমৃদ্ধ। বাংলা গদ্যের চলিত রীতিকে তিনিই প্রথম সাহিত্যসৃজনে প্রয়োগ করেন। তাঁর প্রথম চলিত রীতির গদ্য রচনা "হালখাতা" ১৯০২ সালে "ভারতী" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা "সবুজ-পত্র" (বৈশাখ ১৩২১- শ্রাবণ- ভাদ্র ১৩৩৪) সম্পাদনা করে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন।
আমরা অনেক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের জন্ম-মৃত্যুকাল স্মরণ রাখি না; তাঁদেরকে বিশেষ বিশেষ দিনে স্মরণও করি না। বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য নাম প্রমথ চৌধুরী। কালোত্তীর্ণ এই মহান সাহিত্যিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে যে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন- প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত চেতনায় বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক যুগের সূচনার মাধ্যমে যেভাবে গদ্যসাহিত্যকে করেছেন প্রাঞ্জল, সাবলীল ও সর্বজনগ্রাহী, তা সত্যিই অতুলনীয়। তিনি রবীন্দ্র যুগে আবির্ভূত হলেও তাঁর সাহিত্য আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষার প্রবর্তক ও বিদ্রূপাত্মক প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয়।
তাঁর জন্মের ১৫২তম বছরে আমার আনত শ্রদ্ধা।
তথ্য কৃতজ্ঞতা:
১) ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী, ‘প্রমথ চৌধুরী’, বাংলাপিডিয়া, খ- ১০, সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত (ঢাকা : বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৩)
(২)রঘুনাথ ভট্টাচার্য, সবুজ পত্র গোষ্ঠীর সাহিত্য-ভাবনা (ঢাকা : দশদিক, ২০০৪)
(৩) গোলাম মুরশিদ, ‘নিবেদন’, কালান্তরে বাংলা গদ্য (কলাকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৩৯৯
(৪)রথীন্দ্রনাথ রায়, বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী (কলিকাতা : জিজ্ঞাসা, ১৯৬৯ )
(৫)রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বলাকা (কলকাতা : বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, নতুন সংস্করণ, আশ্বিন, ১৩৯৫)
(৬)রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বলাকা (কলকাতা : বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, নতুন সংস্করণ, আশ্বিন, ১৩৯৫)