জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং ‘অংশীজন’ সমাচার

এম আর খায়রুল উমাম

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২০, ০৪:৪৮ পিএম | আপডেট: ০৬ আগস্ট ২০২০, ০৪:৫৭ পিএম

৩০ জুন জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই দিনে সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা চূড়ান্ত রূপ পায়। আগামী এক বছর দেশ কীভাবে পরিচালিত হবে, জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, তার ছবি জনগণের সামনে রাখা হয়। তাই সংসদে জাতীয় বাজেট পাস হয়। প্রতি বছরের মতো এবারও ১১ জুন সংসদে প্রদত্ত ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন হয়েছে। জাতীয় বাজেট সাধারণ জনগণের জন্য কতটা আগ্রহ সৃষ্টি করে জানি না। তবে কিছু মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা রাখায়, তাদের মধ্যে প্রচণ্ড আগ্রহ দেখা যায়। দ্বিতীয় যে কারণে ৩০ জুন গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো অর্থবছরের শেষ দিন। সারাবছর যাই হোক না কেন অর্থবছরের শেষ দিনটায় কিছু মানুষ দানবীয় শক্তি অর্জন করে। বছরের ১১ মাসে যে গতিতে কাজ করে থাকে, তার অন্তত ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি গতিতে কাজ সম্পন্ন করে থাকে। এটাও বিশ্বে রোল মডেল হওয়ার মতো বিষয়।

যে কোনো অর্থ বছরের জাতীয় বাজেট সরকারি দলের সমর্থকদের কাছে জনকল্যাণকামী। সরকার জনগণের কল্যাণ বিবেচনায় এক বছরের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দিয়েছে- জ্ঞান হওয়া থেকেই শুনে আসছি বাজেট পেশকারী দল জনকল্যাণের কথা বলে থাকে; কিন্তু আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না এই ‘জন’টা কারা? দেশের অনক্ষর-অনাহারি মানুষ, মাটি-তেল-কালি মাখা শ্রমিক-কৃষক, প্রতিদিন সকালে মানুষের হাটে শ্রম বিক্রি করতে আসা মানুষ, ৫০০ টাকার সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থাকা মানুষ, হেয় জ্ঞানে কর্মচারী বলা মানুষ ইত্যাদি কারা ‘জন’ হিসেবে জাতীয় বাজেটে খ্যাত। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়, সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। করোনাভাইরাস আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে- দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যের অবস্থা! সরকার সাধারণ জনগণের জন্য কত সুন্দর স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করে রেখেছে, তা স্পষ্ট হয়েছে এ সময়ে।

জাতীয় বাজেট জনকল্যাণের জন্য হলেও সাধারণ মানুষ দেখে বাজেটের খসড়া পেশ হলেই বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। বাজেটের খসড়া প্রস্তুত করার সময় সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়ে থাকে যে, অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়েছে। অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় নয়, তাদের জন্য কী কী সুবিধা প্রয়োজন, তার শলাপরামর্শই হয়ে থাকে। খসড়া বাজেটের পর বাজার সমীক্ষা করলে যে কোনো মানুষের সামনে তা পরিষ্কার হয়ে যায়। এই অংশীজনদের সিন্ডিকেট বাজার যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, তাতে জনকল্যাণ রাষ্ট্রের স্বরূপ প্রকাশ হয়ে পড়ে। এতে সাধারণ জনগণের কী হয়, তা জানতে কেউ চেষ্টা করে বলে মনে হয় না। দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্ষমতাবানরা যদি সামান্য নজর দিত, তা হলে সাধারণ জনগণের এমন বেহাল দশা হতো কিনা সন্দেহ। 

বর্তমান অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বার্ষিক উন্নয়নের ৫৭ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। সারাবছর ধরে প্রতি মাসে গড় ৫ শতাংশ কাজ সম্ভব হলেও জুন মাসে প্রায় ৪০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করা হয়। কি অসম্ভব গতি এই মাসে আমরা অর্জন করি, তা সাধারণ জনগণের বোধগম্যের বাইরে। একটু ভালো করে খোঁজ নিলে দেখা যাবে ৩০ জুন এসব কাজের সিংহভাগই শেষ করা হয়। তাই ৩০ জুন কবে কখন শেষ হবে তা বলা মুশকিল। সাধারণ জনগণ এর কারণ জানে না। স্বাধীনতার আগে শুনতাম বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে না পারলে, তা ফেরত চলে গেলে আর পাওয়া যাবে না। তাই ৩০ জুন অসম্ভব গতিতে উন্নয়ন কাজ শেষ করতে হতো; কিন্তু এখন তো আর অর্থ ফেরত যাবার কোনো কারণ নেই। তাহলে যুক্তিহীন গতিতে উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করতে হয় কেন?

দেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের সঙ্গে ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা ব্যক্তিরা সম্পৃক্ত। এসব ব্যক্তিদের সরকারের ওপর একটা অধিকার আছে। সেই অধিকারের জোর থেকে ৩০ জুন ব্যবহার হয়ে থাকে। দেশের প্রকল্প পরিচালকদের একটা মহৎ গুণ তারা কোনো প্রকল্প নির্ধারিত বরাদ্দ ও সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারেন না। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বরাদ্দ বৃদ্ধি ঘটেই চলে। ছোট-বড় বলে কোনো কথা নেই। পদ্মা সেতুর জন্য যা হবে সেই একই কাজ হবে ভৈরব নদ সংস্কারে। ১০ হাজার কোটি টাকার প্রাক্কলিত পদ্মা সেতু ৩০ হাজার কোটি টাকায় শেষ হবে কিনা সাধারণ মানুষ জানে না। শামুকের গতিতে এগিয়ে চলা ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের সড়ক কবে এবং কত টাকায় শেষ হবে তাও জানে না। সাধারণ জনগণের এত জানার কিছু নেই। তারা শুধু উন্নয়ন দেখেই শরীর মন ঠাণ্ডা রাখবে। তবে এসব প্রকল্পের অগ্রগতি দেখা গেলেও অনেক আলোর মুখ না দেখা প্রকল্প চলমান আছে। অনেক প্রকল্পের সঙ্গে ৩০ জুন বাদ হয়ে যায়। এ কারণে ৩০ জুন সম্মিলিত প্রক্রিয়ায় লম্বা করা হয়। জাতীয় সংসদে ৩০ জুন নিয়ে আলোচনা হয়েছে; কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। তাই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা চলমান থাকুক এবং ভাগ্যবান হিসেবে যারা সেকেন্ড হোম গড়ার অর্থ সংগ্রহে সক্ষম হয়েছেন বা হবেন তাদের জন্য সাধারণ জনগণের পক্ষে শুভ কামনা থাকে। 

জাতীয় বাজেটে জনকল্যাণের অগ্রাধিকার খাতসমূহ আজ পর্যন্ত চূড়ান্ত হলো না। ড. কুদরত-ই-খুদা কমিশন শুরুতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিলেন তার ধারাবাহিকতায় সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সবাই দাবি করলেও আজও তা উপেক্ষিত রয়ে গিয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন করতে হলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই- তা জানার পরও তার প্রতিফলন দেখা যায় না। কভিড-১৯ এর চলমান স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে সহসা মুক্তি পাওয়া যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন না। এই ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য স্বাস্থ্য খাতকে যেভাবে সাজানোর প্রয়োজন ছিল, তাও উপেক্ষিত রয়ে গেল। স্বাধীন দেশের জনগণের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা গেল না বিদেশপ্রীতির কারণে। ক্ষমতাবানদের সন্তানরা বিদেশে লেখাপড়া করে থাকে। নয়তো দেশের বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ পেয়ে থাকে এবং সামান্য সর্দি-জ্বর হলেই বিদেশে চিকিৎসাসেবা নিতে চলে যায়। দেশে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হলে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে থাকেন। সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার প্রতি ন্যূনতম বিশ্বাস থাকলে তবেই তো উন্নত করার উদ্যোগ দেখা যাওয়ার কথা। তাই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এই খাত উপেক্ষিত ছিল, আছে এবং থাকবে।

জাতীয় বাজেটে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় পেয়েছে এক হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা, বিপরীতে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় পেয়েছে ৫৭৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ দেশে সংস্কৃতিবান মানুষ পাওয়ার চাইতে ধার্মিক মানুষ পেতে ৩ গুণ অর্থ ব্যয় করা হবে। এখানেও সাধারণ মানুষের চাওয়া অগ্রাধিকার পায়নি। জাতির সংস্কৃতিবান মানুষের প্রয়োজনীয়তা কতটা তা প্রতিটি পদক্ষেপে প্রমাণিত হলেও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে উপেক্ষিত রাখা হয়েছে। জাতীয় বাজেটে জনকল্যাণ উপেক্ষিত হওয়ার তালিকা ছোট না। বিশেষজ্ঞদের জন্য তা রেখে দিলাম। 

জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ৩০ জুনকে পরিবর্তন করা প্রয়োজন। অর্থবছরের শুরুটা যদি সাধারণ বছরের সঙ্গে করা হয় তাহলে সমস্যা কোথায়? আমাদের সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবার-শনিবার হওয়ায় বিশ্ব বাণিজ্যে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তাকে আমরা গুরুত্ব দেইনি। সে কারণে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে ৩০ জুনকে পরিবর্তন করে ৩০ ডিসেম্বর করা হলে কোনো সমস্যা হবে না। বরং যেসব সমস্যার কথা বলে ৩০ জুন দেশব্যাপী লুটের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়, তা থেকে দেশ ও জাতি মুক্তি পেতে পারে।


লেখক

সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh