ইন্দো-প্যাসিফিকে মার্কিন নৌশক্তির সীমাবদ্ধতা

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২০, ০৮:৫৩ এএম

কভিড-১৯ মহামারির মাঝে ইন্দো-প্যাসিফিকে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি মোতায়েনের প্রতিযোগিতার খবর প্রতিনিয়তই পত্রিকাতে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। পূর্ব এশিয়ার উপকূলে সামরিক শক্তি প্রদর্শনের সবচেয়ে দৃশ্যমান অস্ত্র হিসেবে দেখা যাচ্ছে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে। 

মার্কিন যুদ্ধজাহাজে করোনাভাইরাস সংক্রমণের মাঝে চীনারা এপ্রিলে প্রায় এক মাসের জন্য তাদের একমাত্র বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘লিয়াওনিং’কে সমুদ্রে প্রেরণ করে। ৩০ এপ্রিল জাহাজটি পূর্ব চীন সাগরে ‘ট্রেনিং’ মিশন শেষ করে চিংদাও বন্দরে ফিরে আসে। 

পূর্বের সমুদ্রে মার্কিন যুদ্ধজাহাজের প্রায় ‘অনুপস্থিতি’র মাঝে চীনাদের এই ‘শক্তি প্রদর্শন’ মার্কিন শক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

৪ মে জাপানের ইয়োকোসুকা বন্দর ছেড়ে যায় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘রোনাল্ড রিগ্যান’। যুক্তরাষ্ট্রের ১১টি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মাঝে রিগ্যানকেই রাখা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের বাইরে। গত ২৭ মার্চ পূর্ব এশিয়ার উপকূলে মোতায়েনকৃত যুদ্ধজাহাজ ‘থিওডোর রুজভেল্ট’ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পর রোনাল্ড রিগ্যানে সংক্রমণ ধরা পরে। প্রায় দুই মাস মার্কিন প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপনিবেশ গুয়ামের নৌঘাঁটিতে বসে থাকার পর থিওডোর রুজভেল্ট ১৯ মে সমুদ্রে যাত্রা শুরু করে। অপরদিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের আরেক যুদ্ধজাহাজ ‘নিমিতজ’ দুই বছরের মেইনটেন্যান্স শেষ করে ৮ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগো থেকে যাত্রা করে। জটিল প্রযুক্তির কারণে এ ধরনের জাহাজকে মেইনটেন্যান্স থেকে অপারেশনে আনতে অনেক সময় লাগে। এর উপর আবার রুজভেল্টে করোনা সংক্রমণের কারণে অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে ক্রুদের টেস্ট করা ও কোয়ারেন্টিনে রাখার কারণে সমুদ্রে যেতে আরো দেরি হয়। 

নিমিতজের সমুদ্রে যাবার চারদিনের মাথায় ১২ জুন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন নৌবাহিনী একসঙ্গে তিনটি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে। ২১ জুন ‘নিমিতজ’ ও ‘রুজভেল্ট’ যুদ্ধজাহাজের গ্রুপ একত্রে মহড়া দেয়া শুরু করে। ২৮ জুন থেকে ‘নিমিতজ’ মহড়া দেয়া শুরু করে ‘রিগ্যান’-এর সঙ্গে। 

নিমিতজের ‘ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ-১১’ এর কমান্ডার রিয়ার এডমিরাল জেমস ক্লার্ক এক বিবৃতিতে ঘোষণা দেন, বিশ্বে একমাত্র মার্কিন নৌবাহিনীই এরকম শক্তি একত্রিত করার সক্ষমতা রাখে। 

৬ জুলাই মার্কিন মিডিয়া সিএনএন এক প্রতিবেদনে জানায়, দুটি মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ একত্রে দক্ষিণ চীন সাগরে মহড়া দেয়া শুরু করেছে। জাহাজ দুটি হলো জাপান থেকে আসা রিগ্যান এবং প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব প্রান্ত সান ডিয়েগো থেকে আসা নিমিতজ। 

আরো বলা হয়, ২০১৪ সালের পর থেকে প্রথমবারের মতো দুটি জাহাজ একত্রে মহড়া দেয়ার ঘটনা ঘটল। ১৭ জুলাই তারা আবারো ঘোষণা দেয়, জাহাজ দুটি একই মাসে দ্বিতীয়বারের মতো একত্রে মহড়া দেয়া শুরু করেছে। তবে প্রশান্ত মহাসাগরে তৃতীয় বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘থিওডোর রুজভেল্ট’ মিডিয়ার আলোচনার বাইরে থাকে। কারণ এরই মাঝে চুপিসারে ৯ জুলাই জাহাজটি দেশে ফেরত যায়। ইউএসএনআই নিউজ জানায়, গত জানুয়ারিতে জাহাজটি সান ডিয়েগো ছেড়ে গিয়েছিল। মার্চ মাসে ভিয়েতনামে ভ্রমণ করার পরপরই জাহাজটিতে কভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা পরে। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১২শ’ সংক্রমণ ধরা পড়ে। এই খবর বের হবার পর জাহাজের কমান্ডার ক্যাপ্টেন ব্রেট ক্রোজিয়ারকে চাকরিচ্যুত করা হয়। 

২০ জুলাই ঘোষণা দেয়া হয়, ‘নিমিতজ’ যুদ্ধজাহাজ দক্ষিণ চীন সাগর থেকে বঙ্গোপসাগরে এসে হাজির হয়েছে। ভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে ভারত মহাসাগরে প্রায় পাঁচ মাস ভেসে থাকার পর যুদ্ধজাহাজ ‘আইজেনহাওয়ার’ দেশে ফেরার পর থেকে ভারত মহাসাগরে কোনো মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ নেই। নিমিতজকে দিয়ে এই শূন্যস্থান পূরণ করানো হচ্ছে। অর্থাৎ জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে প্রায় একমাস ধরে প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর দাপিয়ে বেড়ানোর পালা শেষ হয়েছে। এর পরিবর্তে রিগ্যানের সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরে আরেকটি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে বেশ কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। কি

টসাপ সান এক প্রতিবেদনে জানায়, বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘কার্ল ভিনসন’ ওয়াশিংটন রাজ্যের ব্রেমারটনে দেড় বছরের মেইনটেন্যান্স শেষ করে অগাস্টের শুরুতে সান ডিয়েগোতে ফেরত আসার কথা রয়েছে। এরপর এর সমুদ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হবে। ‘জন সি স্টেনিস’, ‘জর্জ ওয়াশিংটন’ এবং ‘জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ’ লম্বা সময়ের জন্য ড্রাই ডকে রয়েছে। নতুন জাহাজ ‘জেরাল্ড আর ফোর্ড’-এর নতুন প্রযুক্তির টেস্টিং এখনো শেষ হয়নি; তাই এখনই পুরোপুরি সার্ভিসে আসছে না। ১০ মাসের মিশন শেষ করে জানুয়ারিতে সান ডিয়েগোতে ফেরত যাওয়া ‘আব্রাহাম লিঙ্কন’ খুব শিগগিরই আবার সাগরে যাচ্ছে না। ৭ মাসের মিশন শেষ করে জুনের মাঝামাঝি নরফোক নৌঘাঁটিতে ফিরেছে ‘হ্যারি এস ট্রুম্যান’। টানা ১৬১ দিন কোনো বন্দরে না ভিড়ে রেকর্ড করা ‘আইজেনহাওয়ার’-এর নাবিকরা ভূমিতে পা ফেলার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল। 

এপিকে এই জাহাজ রক্ষার দায়িত্বে থাকা মার্কিন ক্রুজার ‘সান জেসিন্টো’র ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড ক্রসম্যান বলেন, কিছু নাবিক তার কাছে জানতে চেয়েছেন, কোন জাহাজটা আগে বন্দরে নোঙর করবে। 

বিশাল সমরশক্তি থাকার পরও মানব বাস্তবতাগুলো থেকে মার্কিনীরা বের হতে পারেনি। ১ লাখ টনের দৈত্যাকৃতির মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজগুলো যতটাই শক্তিশালী হোক না কেন, তা সমুদ্রে কতটা সময় কাটাতে পারবে, তা নির্ভর করছে নাবিকদের সক্ষমতার ওপর। আর অতি জটিল ও উচ্চমূল্যের এই প্রযুক্তিকে চালু রাখতে ব্যাপক খরচ ছাড়াও নৌবহরের একটা বড় অংশকে মেইনটেন্যান্সের মাঝে থাকতে হচ্ছে। ক’দিন আগেই উভচর এসল্ট শিপ ‘বনহোমি রিচার্ড’ আগুন লাগে এবং ২০১৭ সালে দুটি ডেস্ট্রয়ারের দুর্ঘটনার পর দুই বছর সার্ভিসের বাইরে থাকার ঘটনা নৌবাহিনীর অপারেশনাল দক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। 

এপ্রিল মাসে দক্ষিণ চীন সাগরে ‘এফ-৩৫’ স্টিলথ ফাইটার বহনে সক্ষম এরকমই একটা এসল্ট শিপ ‘আমেরিকা’ মার্কিন উপস্থিতিকে জিইয়ে রেখেছিল। চীনারা তাদের অপেক্ষাকৃত স্বল্পক্ষমতার নৌবহরকে মার্কিনিদের সক্ষমতার ফাঁকফোঁকড়ের মাঝে ব্যবহার করে মার্কিন নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। আর এতে তারা বেশ সাফল্যও পেয়েছে। 

বিশ্বব্যাপী মার্কিনিদের বন্ধু ও প্রতিযোগী সবাই যুক্তরাষ্ট্রের এই সীমাবদ্ধতাগুলোকে অবলোকন করছে; যা কিনা তাদের নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অনুপ্রাণিত করছে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh