ফারাক্কা লংমার্চের ঐতিহাসিক গুরুত্ব

বি ডি রহমতুল্লাহ

প্রকাশ: ২৬ মে ২০২০, ১০:৫৬ পিএম | আপডেট: ২৭ মে ২০২০, ১২:২৯ পিএম

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৭৬ সালের ১৬ মের ফারাক্কা লংমার্চের রাজনৈতিক গুরুত্ব আজও হারিয়ে যায়নি। এ দিবসের প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এদেশের মেহনতী জনগণের এক বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টির নতুন আহ্বান এবং নতুন উদ্দামতার ডাক শুনতে পাওয়া যায়। 

মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চ শুধু জলপ্রাপ্তির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হওয়া অবৈধ ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে ছিল না, এ ঐতিহাসিক লংমার্চ ছিল এদেশের বিরুদ্ধে ভারতের সব ধরনের অন্যায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে- নতুন করে বাঁচার এবং মুক্তির লড়াই শুরু করার এক নব আহ্বান।

ভারত সরকার এ অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশকে ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে সব ধরনের আন্তর্জাতিক আইন-কানুন লঙ্ঘন করে বাংলাদেশে প্রবাহমান আন্তর্জাতিক নদীসমূহের গতিপথ বন্ধ করে দিয়েছে। পানি প্রত্যাহার, বাঁধ নির্মাণ, প্রাকৃতিক পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন করে এ দেশের নদী-খাল-বিল হাওর নিশ্চিহ্ন করে অর্থনীতিকে ধ্বংস করার এক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

উজানে পানি আগ্রাসনের কারণে যে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটছে এবং বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে, তা আমাদের সবারই জানা দরকার। আমরা জানি শত শত বছর ধরে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং এদের উপনদীগুলো চীন, নেপাল, ভুটান ও ভারত থেকে পানি বয়ে নিয়ে এসে বাংলাদেশের পানির প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাচ্ছে। আন্তর্জাতিক নদী কনভেনশন ও নীতিমালা লঙ্ঘন করে ভারত উজানে একতরফাভাবে পানি সরিয়ে নেওয়ার ফলে বাংলাদেশের নদীর প্রবাহ মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ফলে নলকূপে পানি উঠছে না। সমুদ্রের লোনা পানি দেশের অভ্যন্তরীণ নদী, উপনদীগুলোতে প্রবেশ করছে। ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে অনেক এলাকায় মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে; কিন্তু এটা স্বতসিদ্ধ যে, বাংলাদেশ বাঁচবে যদি নদী-জল বাঁচে।

প্রধানত নিম্নলিখিত দুটি কারণে বাংলাদেশের পানির প্রয়োজন-

এক. জোয়ারে পানি দিনে দুইবার বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে। প্রবাহ বেশি থাকলে নদীর পানি সমুদ্রের লোনা পানিকে প্রবেশে বাধা দেয় এবং সে কারণে সমুদ্রের লোনা পানি ভেতরে ঢুকতে পারে না; কিন্তু নদীর পানি কমে গেলে সমুদ্রের লোনা পানিকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে সমুদ্রের লোনা পানি আরো বেশি উজানে ঢুকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কৃষিজমি, নিম্নাঞ্চল ও জলাভূমিকে প্লাবিত করে লবণাক্ততার ভরে দেবে।

দুই. বাংলাদেশে কূপের মাধ্যমে আমরা খাবার পানি, চাষের জন্য সেচের পানি এবং নানা কাজে ব্যবহারের জন্য পাতালের পানি ব্যবহার করে থাকি। এ কারণে এ পানি গড়ে প্রতি বছর ৫ মিটার করে নিচে নেমে যায়। আবার প্রতি বছর বৃষ্টিপাতের ফলে গড়ে ১ মিটার করে পানি যুক্ত (চার্জ) হয় এবং বর্ষাকালে বন্যার কারণে নিম্নাঞ্চল ও জলাভূমি প্লাবিত হওয়ায় ৪ মিটার পানি যুক্ত হয়। ফলে পরের বছর আমরা নলকূপের মাধ্যমে পাতাল থেকে পানি তুলে ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু মূল পানির প্রবাহ কমে গেলে কৃষিজমি, নিম্নাঞ্চল ও জলাভূমি প্লাবিত হবে না, বিধায় ভূ-গর্ভের ঘাটতি পানি রিচার্জ হবে না। পাতাল পানির স্তর নলকূপের চেয়ে ৮ মিটারের বেশি নিচে নেমে গেলে নলকূপে পানি উঠবে না এবং এতে সেচের পানি, খাবারের পানি দূষ্প্রাপ্য হয়ে উঠবে।

ভারত ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে উজানে ড্যাম ও ব্যারেজ তৈরি করে বাংলাদেশের পানি তাদের মরু অঞ্চল যেমন- হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাট, দক্ষিণাত্যসহ  বিভিন্ন অঞ্চলে সরিয়ে নিচ্ছে। কাজেই বাংলাদেশে পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে গেছে এবং প্রাপ্ত পানি নদীর তলানি হিসেবে থাকছে। এ কারণে অনুপ্রবেশকারী সমুদ্রের লোনা পানিকে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এতে নিচু জমিকে স্বাভাবিক প্লাবনের মাধ্যমে রিচার্জ করে পাতাল পানির চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। ফলে লবণাক্ততা ও মিঠা পানি প্রবাহের অভাবে বাংলাদেশে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ বিনাশ হয়ে যাচ্ছে। ভারত সরকারের এসব তৎপরতার কারণে জীবন ও জীবিকা বিপর্র্যস্ত হয়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কঠিন সমস্যার মধ্যে নিপতিত হবে। প্রসঙ্গত, এটা উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বর্তমান সাহারা মরুভূমি একসময় রোম সাম্রাজ্যের শস্য ভাণ্ডার ছিল। কিন্তু লবণাক্ততার কারণে সেই শস্য ভাণ্ডার এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে- যা পানি, গাছপালা, পশু-পাখি, বন-জঙ্গল, মনুষ্য বসবাসহীন এক বিরান ধূলিময় উৎপাদনহীন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।

এই সেদিনও বাংলাদেশ পরিচিত ছিল নদীমাতৃক, শস্য-শ্যামলা প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা সবুজ প্রান্তরের একটি দেশ হিসেবে। যেখানে যাতায়াত কিংবা মালামাল পরিবহনে নৌকা ব্যবহৃত হতো, যা ছিল সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ। আজ উজানে পানি অন্যায়ভাবে সরিয়ে নেয়ার ফলে মরুকরণ হওয়ার পথে। ১৯৭১ সালে মোট নৌপথ যেখানে ছিল ২৪,০০০ কিলোমিটার, যা দিয়ে দেশের শতকরা ৩২% যাত্রী ও শতকরা ৪০% মালামাল পরিবহন করা যেতো আর ২০১২ সালে সেখানে নৌপথ কমিয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৫০০ কিলোমিটর। আর যাত্রী চলাচল কমিয়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৩% ও মালামাল পরিবহন শতকরা ১০%। 

ভারত যা করছে তা বাংলাদেশের সঙ্গে তার নিজের চুক্তি ভঙ্গ করেই করছে। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তির ৬ নং ধারায় বর্ণিত ছিল- ‘উভয় পক্ষই সম্মত হচ্ছে যে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী অববাহিকা উন্নয়ন, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ সম্পর্কিত বিষয়ে যৌথ সমীক্ষা ও কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।’ ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানি প্রবাহ কমে গেলে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এই ৫ বছর মেয়াদি বাংলাদেশকে সর্বনিম্ন পানি পাওয়ার গ্যারান্টি ক্লজ ও মতবিরোধ হলে আরবিট্রেশনের ব্যবস্থা রেখে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৮২ সালে চুক্তি শেষ হওয়ার পরই ভারত গঙ্গার পানি ও নেপাল থেকে আসা গঙ্গার উপনদীর পানি আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে সরাতে শুরু করলে বাংলাদেশ জাতিসংঘে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। তখন ভারত বাধ্য হয়ে ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি করে; কিন্তু মানছে কই? তিস্তা নদীর ভাটিতে নিজ ভূখণ্ডে বাংলাদেশ ১৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯৯৩ সালে তিস্তা ব্যারেজ চালু করে। এর জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য-উপাত্ত ভারতকে সরবরাহ করা হয়; কিন্তু ভারত সরকার বাংলাদেশকে না জানিয়ে তিস্তার উজান থেকে বাঁধ দিয়ে সব পানি অবৈধভাবে সরিয়ে নিচ্ছে। এতে তিস্তা সেচ প্রকল্পসহ এ ব্যারেজের ভাটির জমিগুলো মরুময় হয়ে উঠেছে। ভারত এ জন্য একটি রাজ্য সরকারের আপত্তির কথা বলছে। অথচ ভারতের সংবিধানের ২৫৩নং ধারাতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার অন্য যে কোনো প্রদেশের সরকারের সঙ্গে চুক্তি করার বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, কোনো প্রদেশের আপত্তি আমলে নেয়ার কথা নয়। অথচ উল্টোটাই হচ্ছে।

আমরা দেখলাম আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ-মিয়ানমার, বাংলাদেশ-ভারতের সমুদ্রসীমার সংকট সমাধান হয়েছে। একইভাবে জাতিসংঘের মাধ্যমে উজানে পানিসম্পদ ব্যবহারের বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকারের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর নেই। 

তিস্তা নদীসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানিবণ্টন চুক্তি ভারত নানা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে। কাজেই এটা গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তির ও আন্তর্জাতিক নদী ব্যবহার সংক্রান্ত নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভারত এটা কিছুতেই করতে পারে না। হয়তো আমাদের নির্লিপ্ততা ভারতকে এই অন্যায় করতে সাহস জুুগিয়েছে। 

ফারাক্কা বাঁধ তেমনি একটি পরিকল্পনার অংশ, যা ভারতের গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা নামক স্থানে স্থাপন করা হয়েছে। গঙ্গা নদী থেকে যে জল বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে প্রবাহিত হয়ে আরো শাখা-প্রশাখায় ছড়িয়ে এদেশের জমিকে আরো উর্বর করত, ভূপৃষ্ঠের পানির স্তর ঠিক রেখে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশকে জিইয়ে রাখতো, এ সমস্ত কর্মযজ্ঞকে স্তব্ধ করে দিয়ে আমাদের দেশকে মরুভূমি বানানোর এক দেশ বিনাশী প্রকল্প চলমান রয়েছে। 

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী দেশকে বাঁচাতে হাজার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে লংমার্চের মাধ্যমে এ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি ১৯৭৬ সালের ১৬ মের ফারাক্কা লংমার্চে অংশগ্রহণের জন্য সর্বস্তরের জনগণকে রাজশাহীতে জড়ো হতে আহ্বান করেছিলেন। মজলুম জননেতার এ আহ্বানে হাজারো মানুষ সেদিন সমবেত হয়েছিল। মওলানা সেদিন রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানের জনসভায় ভারতকে ফারাক্কা বাঁধ দিতে  বারণ করেন এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশকে প্রাপ্য ন্যায্য পানির হিস্যা দিতে আহ্বান করেন। ওই সভাতে তিনি এ প্রকৃতি বিনাশী ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলারও দাবি করেন। মজলুম জননেতা কর্মসূচি অনুযায়ী সভা শেষে হাজার হাজার লোক নিয়ে ১০০ কিলোমিটার লংমার্চ করে ফারাক্কা বরাবর ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশের কানসাটে পৌঁছান এবং লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

মজলুম জননেতার এ লংমার্চ আমাদের রাজনীতিকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল, যা তার মৃত্যুর পরে যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে ধরে রাখতে পারিনি।


বি ডি রহমতুল্লাহ, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh