খন্দকার মনিরুজ্জামান
প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২০, ০১:১৫ পিএম
৩রা ডিসেম্বরের রোদ ঝলমলে এক সকাল। প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দর। বিমানবন্দরজুড়ে সাজসাজ রব। দায়িত্বরত কর্মকর্তারা একটু বেশি তৎপর সেদিন। কেননা রাষ্ট্রীয় সফরে আসছেন জার্মানির ভাইস চ্যান্সেলর। বহুদিনের পর দুই দেশের সম্পর্কের দূরত্ব কমবে। এমন সময়েই এয়ারপোর্টে এসে হাজির হলো একটি ট্যাক্সি। তা থেকে নামল ২৮ বছরের এক যুবক।
গায়ে নীল জ্যাকেট, পিঠে ব্যাকপ্যাক। সুন্দর নায়কোচিত শিশুসুলভ চেহারা। ভাড়া মিটিয়ে তিনি গেট দিয়ে ইমিগ্রেশনের দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখানে থামতে হলো- তাকে চেক করা হলো; কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। অথচ মোজার ভেতর আর প্যান্টের ভেতরের অংশে লুকোনো রয়েছে পিস্তলের ভিন্ন ভিন্ন খোলা অংশ।
রানওয়েতে তখন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারওয়েজের একটা বোয়িং ৭২০ বিমান অপেক্ষা করছে আকাশে উড়বার। নীল জ্যাকেট পরা সেই যুবক গিয়ে উঠে বসলেন পিআইএ-৭১১ নামের ওই বিমানে। যাত্রীরা তখন উঠে বসেছেন, সংখ্যাটা ত্রিশের মতো হবে। পাইলট শেষবার সব কিছু দেখে শুনে নিচ্ছেন। ঘড়িতে তখন ১১টা বাজে। ভোরের মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে দিচ্ছে তখন নতুন দিনের সংবাদ।
অর্লি এয়ারপোর্টের রেডিও তারবার্তায় একটা মেসেজ পৌঁছুল, বসে থাকা অপারেটর তা দেখে নিয়ে বুঝল পিআইএ-৭১১ বিমান থেকে এসেছে। লেখা রয়েছে- ‘এই বিমানটা আমি ছিনতাই করেছি, আমার কথা না শুনলে পুরো বিমান উড়িয়ে দেবো আমি। আমার ব্যাগে বোমা আছে!’ অপারেটর ভেবেছিল কেউ মজা করছে। কিন্তু নাহ! মেসেজটি নীল জ্যাকেট পরা সেই যুবক পাঠিয়েছিল যার নাম জ্যাঁ ক্যুয়ে, পুরো নাম জ্যাঁ ইউজিন পল ক্যুয়ে।
অপারেটর মেসেজটা ফরোয়ার্ড করে পাঠালেন তার উপরস্থ অফিসারের কাছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রেড এলার্ট জারি করা হলো অর্লি এয়ারপোর্টে। পুলিশের গাড়ি আর দমকল কর্মীদের গাড়ির সাইরেন শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল! নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ছিনতাইকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করছিল- জানতে চাইছিল তার দাবি। ওপাশ থেকে জ্যাঁ ক্যুয়ের জবাব এলো, দক্ষিণ এশিয়ার পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী মানুষদের জন্য বিশ টন ওষুধ বিমানে তুলে দিতে হবে, তাহলেই কেবল মুক্তি পাবে বিমানের নিরীহ যাত্রীরা। সেই সময় এদেশে চলছে যুদ্ধ।
ডিসেম্বর বিজয়ের কিছুদিন আগেকার এই ঘটনা। উত্তাল একাত্তর যাকে বলে, স্বাধীনতার যুদ্ধে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রক্তাক্ত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ছে বীর বাঙালি যোদ্ধারা, কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে ভারতের মাটিতে, সেই অস্থির সময়ে ইউরোপের কেন্দ্রস্থলে জ্যাঁ ক্যুয়ে নামের ২৮ বছর বয়সের এই তরুণ পাকিস্তানি একটি বিমান ছিনতাই করে বসে কেবল আমাদের যুদ্ধে মানবিক সাহায্যের জন্য। জ্যাঁ ক্যুয়ের জন্ম ১৯৪২ সালের ৫ জানুয়ারি।
ক্যুয়ে আলজেরিয়াতে জন্মালেও তার পুরো পরিবার বাস করতো ফ্রান্সে। বাবা ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা। ক্যুয়ে আর তার এক ভাইও সেখানে চাকরি করতেন; কিন্তু ক্যুয়ের এসব পছন্দ হয়নি। স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়েন। স্বাধীন জীবনে অভ্যস্ত তরুণ ক্যুয়ের ভালো লাগত ঘুরে বেড়াতে। পাখির মতো ডানা মেলে পৃথিবীকে দেখতে।
ক্যুয়ে তার চাকরি ছাড়ার প্রথম দিকে কট্টরপন্থী দল ওএসএসর সঙ্গে। তারা মূলত ফ্রান্স বিরোধী ছিল এবং ভালোবাসতো আলজেরিয়াকে। এমন সময় ক্যুয়ে জানতে পারালেন ফরাসি দার্শনিক আঁদ্রে মার্লো সম্পর্কে, তার হাতে এলো মার্লোর কিছু বই।
তিনি শিখলেন, সাম্যবাদ কাকে বলে, উদারপন্থী নীতিটা খুবই মনে ধরল তার। এতদিন ধরে কট্টরপন্থী মনোভাব পোষণ করে আসা ক্যুয়ে হুট করেই উদারপন্থী হয়ে উঠলেন মার্লোর লেখা বই আর কলাম পড়ে। মার্লোকে তিনি ঈশ্বরের মতো ভক্তি করতেন। তারপর সেই জ্যাঁ ক্যুয়ে যখন ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার লড়াইয়ের কথা শুনলেন তার মন আনন্দে নেচে উঠল, অচেনা অজানা একদল কালো মানুষের জন্য করে বসল বিমান ছিনতাই।
জ্যাঁ ক্যুয়ের এই ঘটনা দেশে টিভিতে দেখাতে লাগলো। মুক্তিপণ অনুযায়ী সব ব্যবস্থা করা হলো- কিন্তু কৌশলী নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে আটকাবার পাঁয়তারা করেছিল। ফলে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। এক দল কমান্ডো পাঠানো হয়েছিল তার দাবি অনুযায়ী ওষুধ পাঠানোর জন্য। তারপর জ্যাঁ ক্যুয়ে ধরা পড়ে কমান্ডোদের হাতে; কিন্তু তার দাবি মতো ওষুধ পৌঁছে দেন সরকার।
‘অঁদ্রে দ্য মলতে’ নামের একটি সাহায্যকারী সংস্থার মাধ্যমে সেই খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধ অবশেষে বাংলাদেশে পৌঁছায়। বিমান ছিনতাইয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত জ্যাঁ ক্যুয়েকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড হয়। তবে তিনি ১৯৭৩ সালেই জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তার হয়ে মামলায় লড়েছিলেন ঝানু সব আইনজীবী, তার আদর্শিক গুরু আঁদ্রে মার্লো স্বয়ং আদালতে হাজির হয়েছিলেন তার পক্ষে সাক্ষী দিতে!
এদেশের যুদ্ধদিনের বন্ধু জ্যাঁ ক্যুয়ে কখনো বাংলাদেশে আসেননি। যে দেশটার জন্য তিনি জীবন বাজি রেখে এমন আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেই দেশটা দেখতে কেমন, সেখানকার মানুষগুলো কেমন সেটা জানা হয়নি তার কখনো।