ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২০, ১০:২১ এএম | আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২০, ১০:২২ এএম
চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মহামারি আকারে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। শীতপ্রধান দেশে এর প্রকোপ ভয়াবহ। তবে অনেকেই আশা করছেন যে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে করোনাভাইরাসের বিস্তার কমে যাবে। মৌসুমি রোগের প্রাদুর্ভাবে এমনটা হলেও, মহামারির ক্ষেত্রে অনেক সময় সেটি দেখা যায় না।
ইতিপূর্বে দেখা গেছে মৌসুম বা ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক সংক্রমণ রোগের প্রকোপ কমে যায়। অনেক ইনফ্লুয়েঞ্জা শীতের মৌসুমে দেখা দেয়, গরম শুরু হলে যেগুলো চলে যায়। আবার টাইফয়েডের মতো অনেক রোগের প্রকোপ বাড়ে গ্রীষ্মকালে।
সুতরাং অনেক মানুষের জিজ্ঞাসা, কভিড-১৯ বা নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটবে কী না।
চীনে যখন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে তখন শীত চলছিলো। তখন অনেকেই আশা করছিলেন যে, গ্রীষ্মকাল শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনাভাইরাসের প্রকোপও কমে যাবে।
কিন্তু এখন অনেক বিশেষজ্ঞ এ ধরনের মতামতের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী জানাচ্ছেন। তাদের এ ধরনের সতর্কবাণীর পেছনে যুক্তিও রয়েছে।
কোভিড-১৯ একেবারেই নতুন ধরনের একটি ভাইরাস যেটি সম্পর্কে খুব কম তথ্য-উপাত্ত রয়েছে। এটা ঋতুর সঙ্গে কতোটা বদলাতে পারে, শুধুমাত্র তাপমাত্রা নয়, মানুষের আচরণ, তাদের মেলামেশা, একটি স্থানে কতো মানুষ অবস্থান করছে, এরকম আরো কিছু বিষয়ের ওপর ভাইরাসে বিস্তার নির্ভর করে।
২০০৩ সালে ছড়িয়ে পড়া সার্স ভাইরাস খুব তাড়াতাড়ি ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছিলো, ফলে আবহাওয়ার পরিবর্তন সেটার ওপর কতোটা প্রভাব ফেলে, সেই তথ্য জানা সম্ভব হয়নি।
তবে আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে কোভিড-১৯ পরিবর্তিত হয় কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মানব শরীরে সংক্রমিত হওয়া অন্য ভাইরাসগুলোর মধ্যে বেশ কিছু সূত্র রয়েছে।
অনেকে আশা করছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমবে। ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরার সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজেস এর পক্ষে কেট টেম্পলটনের চালানো একটি গবেষণায় দেখা গেছে ফুসফুসে সংক্রমিত হয়, এমন তিনটি করোনাভাইরাস বিশেষভাবে শীতকালেই সংক্রমিত হয়েছে। এসব ভাইরাসের ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যেই বিস্তার দেখা গেছে। আরেকটি ভাইরাসের ক্ষেত্রে কিছুটা বিক্ষিপ্ত প্রবণতা দেখা গেছে।
করোনার ক্ষেত্রে আগে ধারণা করা হচ্ছিলো এটাও হয়তো ঋতুভিত্তিক একটি ভাইরাস। যেভাবে নতুন ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে, তাতে এটা ঠান্ডা এবং শুষ্ক আবহাওয়া পছন্দ করে বলেই ধারণা করা যায়। যদিও উষ্ণ কয়েকটি দেশেও এর বিস্তার দেখা গেছে।
বিভিন্ন আবহাওয়ার বিশ্বের ৫০০ স্থান নিয়ে অপ্রকাশিত একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, করোনার বিস্তারের ক্ষেত্রে ভাইরাস ও তাপমাত্রা, বায়ুপ্রবাহ এবং আর্দ্রতার সম্পর্ক রয়েছে। আরেকটি অপ্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ তাপমাত্রা এই রোগের বিস্তার কমাতে পারে।
তবে শুধুমাত্র তাপমাত্রা এই রোগের বিস্তারের ওপর প্রভাব ফেলে না। আরেকটি অপ্রকাশিত গবেষণায় পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে যে, নাতিশীতোষ্ণ উষ্ণ এবং ঠান্ডা জলবায়ু করোনাভাইরাসের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্বের ক্রান্তীয় অংশ এতে কম আক্রান্ত হতে পারে।
কিন্তু এসব গবেষণার ক্ষেত্রে কয়েক ঋতু পর্যবেক্ষণ করে বাস্তব তথ্যের বদলে কম্পিউটার মডেলিংয়ের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে গবেষকদের।
সমস্যা হলো, অনেক ক্ষেত্রে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া রোগগুলো অন্যান্য ঋতুভিত্তিক রোগের মতো আচরণ করে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এর আগে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাওয়া মহামারি স্প্যানিশ ফ্লু গ্রীষ্মকালে সবচেয়ে বেশি বিস্তার হয়েছিলো।
করোনাভাইরাসের ওপর আবহাওয়ার প্রভাব আছে কিনা, তা জানতে এখন বেশ কয়েকটি গবেষণা চলছে। ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট অব স্টকহোমের ইনফেকশাস ডিজিজ কন্ট্রোলের অধ্যাপক জ্যান আলবার্ট বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ভাইরাসটির ওপর তার প্রভাব পড়ে কিনা। আমরা নিশ্চিতভাবে সেটা জানি না, কিন্তু আমাদের মনে হচ্ছে যে, এটা হতে পারে।’
করোনাভাইরাস এমন একটি গোত্রের সদস্য যাদের বলা হয় ‘এনভেলপড ভাইরাস’। এর মানে হলো, এই ভাইরাসের চারপাশে প্রোটিনের তৈরি একটা তৈলাক্ত আস্তরণ থাকে, যাকে বলা হয় লিপিড বাইলেয়ার। এ ধরনের অন্য ভাইরাসগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, এ রকম আবরণ থাকায় শরীরের বাইরে, মুক্ত পরিবেশে থাকা থাকা অবস্থায় উষ্ণ বা উচ্চ তাপমাত্রার আবহাওয়ায় ভাইরাস দুর্বল হয়ে যায়।
অন্যদিকে ঠান্ডা আবহাওয়ায় সেটি আরো টেকসই হয়ে ওঠে। রান্না করা মাংস ঠান্ডা করা হলে যেমন চর্বির একটা আস্তর তৈরি হয়, অনেকটা তেমন। এ কারণেই তাপমাত্রা যতো বাড়ে, মুক্ত পরিবেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার ততো কমতে থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সার্স-কোভ-২ ভাইরাস প্লাস্টিকের মতো শক্ত আবরণের ওপর ২১-২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এবং ৪০ শতাংশ আর্দ্রতায় ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। অন্যান্য তাপমাত্রায় কোভিড-১৯ ঠিক কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে এবং কী ধরনের আচরণ করে, তা নিয়ে এখনো পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।
তবে অন্যান্য করোনাভাইরাসের ওপর চালানো পরীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, কম তাপমাত্রায়, অর্থাৎ চার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় মুক্ত পরিবেশে এগুলো ২৮ দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। কম্পিউটার মডেলিংয়ে দেখা গেছে, চরম তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় কোভিড-১৯ কম টিকে থাকতে পারে
২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের ওপর চালানো একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, ঠান্ডা, শুষ্ক তাপমাত্রায় এটি ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে। যেমন শক্ত আবরণের ওপর ২২ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওই ভাইরাস পাঁচ দিন পর্যন্ত টিকে থাকতে দেখা গেছে।
তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা যতো বেড়েছে, মুক্ত পরিবেশে ভাইরাসের আয়ুষ্কাল ততো কমেছে। স্পেনের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল সায়েন্স ইন মাদ্রিদের গবেষক মিগুয়েল আরাজো বলছেন, ‘মানব শরীরের বাইরে ভাইরাসের ক্ষেত্রে জলবায়ু একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যতক্ষণ ভাইরাস মুক্ত আবহাওয়ায় টিকে থাকতে পারবে, ততক্ষণ সেটা অন্যদের সংক্রমিত করতে পারবে এবং মহামারি হয়ে উঠতে পারবে।’
তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের বিশ্বব্যাপী বিস্তার পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রধানত ঠান্ডা এবং শুষ্ক আবহাওয়ায় সেটির বিস্তার বেশি হয়েছে।’
তার বিশ্বাস, তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার সঙ্গে যদি আগের ভাইরাসগুলোর মতো কোভিড-১৯ একই আচরণ করে, তাহলে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের আবহাওয়ার সঙ্গে তাল রেখে তার বিস্তারের পার্থক্য হবে। তবে এ ক্ষেত্রে মানুষের আচরণও অনেক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।
এই গবেষক বলেন, ‘তবে সবক্ষেত্রে একই রকম দেখা যাবে না। কারণ একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে এই ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে। ফলে যেসব স্থানে বেশি মানুষ থাকবে, তারা যতো বেশি মেলামেশা করবে, সেখানে সংক্রমণের হারও বেশি হবে।’
যদিও ঠান্ডা আবহাওয়ার দেশগুলোয় ভাইরাসের বিস্তার বেশি দেখা গেছে, কিন্তু গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতেও ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। তবে এশিয়ায় ভাইরাসের বিস্তার নিয়ে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের গবেষণায় দেখা গেছে, যতোটা ভাবা হয়েছিলো, ভাইরাসের ওপর আবহাওয়ার প্রভাব তার চেয়ে কম।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাপমাত্রা ছাড়াও আরো অনেক কিছুর ওপর কোভিড-১৯ এর বিস্তার নির্ভর করে। ফলে মানুষের আচরণের ওপর ভাইরাসের বিস্তারের বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করছে।
তারা বলছেন, চীনের জিলিন ও হেইলংজিয়াঙ্গ এর মতো ঠান্ডা এলাকায় যেমন ভাইরাসের বিস্তার দেখা গেছে, তেমনি গুয়াংজি এবং সিঙ্গাপুরের মতো গ্রীষ্মপ্রধান এলাকাতেও সেরকম বিস্তার দেখা গেছে। সুতরাং বসন্ত বা গ্রীষ্মের মতো আবহাওয়া এই কোভিড-১৯ রোগ সংক্রমণ ঠেকাতে ততোটা কার্যকরী নয়।
ফলে তারা জনস্বাস্থ্য সতর্কতার বিষয়গুলো কার্যকরের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
কারণ হিসেবে বলছেন, ভাইরাসটি পরিবেশে কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে, শুধু তার ওপর ভাইরাসের বিস্তার নির্ভর করে না। মানুষের আচরণের ওপর ভাইরাসের বিস্তারের বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করছে।
সূত্র: বিবিসি