জামায়াত প্রসঙ্গ: বিএনপিকে বামদের ‘না’

মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার-পরবর্তী সময়ে নির্বাচনে না যাওয়া দলগুলোকে নিয়ে সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরম গড়ে তোলায় নজর দিয়েছে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এজন্য ‘যুগপৎ ধারার’ কৌশল বাদ দিয়ে এক মঞ্চ থেকে আন্দোলন করারও চিন্তা করছে দলটি। আন্দোলনের এই মঞ্চে এক সময়ের কাছের মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে যুক্ত করতে চায় বিএনপি। এ নিয়ে উভয় দলের হাইকমান্ডের মধ্যে কয়েক দফা কথাবার্তাও হয়েছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, রাজপথের চলমান আন্দোলনকে জোরদার করার লক্ষ্যে সব দল ও মতকে নিয়ে ‘একসঙ্গে’ মাঠে নামতে যাচ্ছে বিএনপি। গঠন করা হচ্ছে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী সর্বদলীয় ঐক্য’। এতে যেমন দীর্ঘদিনের পুরনো মিত্র জামায়াতে ইসলামী থাকবে, তেমনি সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোকেও রাখা হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে ১৭ ডিসেম্বরের পরপরই এ পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ লাভ করতে পারে। যুগপৎ আন্দোলনের অন্য শরিকদের কাছেও এ বিষয়টি তুলেছে বিএনপি। তবে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে এক মঞ্চে আন্দোলন করতে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপির এক দফার আন্দোলনের অন্যতম শরিক দল গণতন্ত্র মঞ্চ। তবে জামায়াতকে নিয়ে যেসব সমমনা বাম দলের আপত্তি থাকবে, তাদের যুগপৎ আন্দোলনে শরিক রাখার কৌশলও রয়েছে দলটির। সরকার পতনের আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে সব দল, মত এবং পথকে এক ও অভিন্ন করে এক মঞ্চে আনতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

বিএনপির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তারা দীর্ঘ এক বছর ধরে যুগপৎ আন্দোলন করছেন। শুরুতেই বলা হয়েছিল, আন্দোলনের গতি-প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে জোট গঠন কিংবা এক মঞ্চের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখন সেই সময়টা এসেছে বলে তারা মনে করছেন।

দলটির নেতারা বলছেন, পরিস্থিতিই তাদের এক মঞ্চের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে অনেকে জামায়াতের বিষয়ে আপত্তি তুলতে পারেন। তবে আগে দেশ বাঁচাতে হবে। দেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে কে ডান, কে মধ্য আর কে বাম তা দেখার সময় নেই। ভোটাধিকার আর গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে যারাই আন্দোলন করছেন, তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই পর্যায়ে আন্দোলনকে সংগঠিত করার কৌশল নিয়েছে বিএনপি। আন্দোলনের প্রথম পর্যায়টি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ পর্যায়ে স্বাভাবিকভাবে কর্মসূচি পালন করতে না পারায় হরতাল-অবরোধেই থাকছে বিএনপি। তবে ফাঁকে ফাঁকে অন্য কর্মসূচি দেওয়া হবে। ১৮ ডিসেম্বর বা এর পর থেকে একেবারে নির্বাচনের দিন ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলনকে আরও কঠোর করার চিন্তা করছে বিএনপি।

উল্লেখ্য, জামায়াতে ইসলামীকে বাদ রেখেই গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো। প্রথম দিকে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে দুটি কর্মসূচি পালন করে জামায়াত। কিন্তু এসব কর্মসূচিতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত নেতাকর্মীদের বিএনপির নেতারা দেখতে না-যাওয়া ও নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি না দেওয়ার অভিযোগ এনে পরবর্তীকালে যুগপৎ কর্মসূচি পালনে বিরত থাকে জামায়াতে ইসলামী। তবে গত ১২ জুলাই এক দফার আন্দোলন ঘোষিত হওয়ার পর বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে জামায়াত। যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাবন্দি দলটির নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের শোক প্রকাশ দলটির কাছে আনে জামায়াতকে। একপর্যায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি কয়েক দফা কথাবার্তাও হয় তারেক রহমানের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি ও তার মিত্রদের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের অনুরূপ কর্মসূচি দেয় জামায়াত। এরপর থেকেই বিএনপির সঙ্গে একই কর্মসূচি পালন করে আসছে জামায়াত।

বিএনপির পক্ষে বাম দলগুলোর সঙ্গে আন্দোলন বিষয়ে লিয়াজোঁ করার দায়িত্ব ছিল স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর ওপর। গত মাসে ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে জামায়াত নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার পর ‘এ বক্তব্য যে দলের নয়’ ব্যাখ্যা দিয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠান বিএনপির সিনিয়র য্গ্মু মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এর পরই ইকবাল হাসান মাহমুদের পরিবর্তে লিয়াজোঁ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় ভারতে অবস্থানরত বিএনপির স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদকে।

বৃহত্তর আন্দোলনের ব্যাপারে জানতে চাইলে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই নির্বাচনে না যাওয়া সব দল এক জায়গায় মিলিত হব। সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমেই বর্তমান সরকারের পতন নিশ্চিত করা হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, তারা এখন যুগপৎ আন্দোলনের কৌশলে আছেন। তবে আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপে সবকিছু নির্ভর করবে পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর। তখন যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

গণতন্ত্র মঞ্চের একটি সূত্র জানায়, বৃহত্তর পরিসরে আন্দোলনের মঞ্চে জামায়াতকে রাখার বিষয়টি এরই মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চকে জানিয়েছে বিএনপি। বাম ঘরানার ৬টি দলকে নিয়ে গঠিত যুগপৎ আন্দোলনের প্রভাবশালী এই শরিক জোটের নেতারা বিএনপির এ প্রস্তাব নিয়ে এরই মধ্যে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তারা জামায়াতকে নিয়ে এক মঞ্চে আন্দোলন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা তাদের এই সিদ্ধান্তের কথা ইতোমধ্যে বিএনপিকে জানিয়ে দিয়েছেন।

মঞ্চের নেতা ও ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, ‘বিএনপি চলমান আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে জামায়াতে ইসলামীসহ নির্বাচন বয়কট করা সব বিরোধী দলকে এক প্ল্যাটফর্মে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ব্যাপারে বিশেষ করে জামায়াতকে নিয়ে আমাদের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। মঞ্চগতভাবে আলোচনা করে আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত জানাব।’

গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘আমরা সরকার পদত্যাগের এক দফার যুগপৎ ঘরানার আন্দোলন নিয়ে রাজপথে আছি। ভবিষ্যতে রাজপথই নির্ধারণ করে দেবে আরও বৃহত্তর ঐক্যের জন্য কাদেরকে নিয়ে একসঙ্গে আন্দোলন হবে কিংবা হবে না।’

প্রসঙ্গত হরতাল-অবরোধের ফাঁকে ফাঁকে বিএনপি জনসম্পৃক্ত কর্মসূচিও পালন করছে। এর মধ্যে বিএনপির কারাবন্দি নেতা-কর্মীদের স্বজনদের উদ্যোগে মানববন্ধন, শ্রমিক ও পেশাজীবী সমাবেশ করেছে দলটি। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবস ও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের জন্য কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এদিন রাজধানীতে বিজয় শোভাযাত্রা করবে বিএনপি। মঙ্গলবার রাতে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও বিজয় দিবসে শোভাযাত্রা করা হবে। দলীয় ফোরামে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বিএনপির একটি সূত্র জানায়, বিজয় শোভাযাত্রা সফলভাবে করতে পারলে আগামী ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে জেলা পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হতে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //