রাজনৈতিক অস্থিরতায় ঘনীভূত হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট

নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকায় বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের কর্মসূচি ঘিরে অস্থিরতার পদধ্বনি যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

এমনিতেই দেশ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকার নানাভাবে তা মোকাবিলার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক দলগুলো সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে এ সংকট থেকে উত্তরণ তো ঘটবেই না বরং তা আরও ঘনীভূত হতে পারে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

টানা দু-বছর ধরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সংকটের আঁচ বাংলাদেশেও লেগেছে। শুধু আঁচ নয়, বলতে গেলে সংকটের উত্তাপ কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহ্যের সীমাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। জ্বালানি সংকট বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। টান পড়েছে রিজার্ভে, ডলারের দরের ঘোড়া ছুটছে নিয়ন্ত্রণহীন।

সরকারকে ঋণের জন্য আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কাছে যেতে হয়েছে। বাড়ছে বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি। মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস। সংসার চালাতে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন কেউ কেউ, যাদের সঞ্চয় নেই নীরব কষ্টে দিন কাটছে তাদের।

সংকট কেটে সবকিছু স্বাভাবিকতায় ফেরার আশায় বুক বেঁধে আছে সবাই। রাজনৈতিক অস্থিরতা কারও কাম্য নয়। কিন্তু আগামী নির্বাচনকে ঘিরে দেশের প্রধান দু-দল যেন ক্রমেই মুখোমুখি অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। ঐক্যের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। রোডম্যাপ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। একই বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ কিংবা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। 

নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে আস্থাহীনতা আছে বিএনপির মধ্যে। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে তারা নির্বাচনে যেতে চাইছে না। দাবি আদায়ে ইতোমধ্যে নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। মাঠে নিজেদেরও জানান দিতে চাইছে ক্ষমতাসীনরা। রাজনৈতিক সংঘাতে স্বাভাবিক কর্মপরিবেশ ও যোগাযোগ ব্যাহত হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই দেশ ও জনগণের বৃহৎ স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতার পথে হাঁটার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা।

১০ ডিসেম্বর ঘিরে অস্থিরতা ও শঙ্কা

গত ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে বিভাগীয় সম্মেলন করার মাধ্যমে দুই মাসব্যাপী কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, ময়মনসিংহ, রংপুর, ফরিদপুর, সিলেট ও কুমিল্লায় সমাবেশ করেছে দলটি। এ কর্মসূচি আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণসমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হবে।

মূলত এখন বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ ঘিরে সরগরম রাজনীতির মাঠ। সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ও এখন এটি। এ সমাবেশের স্থান নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে এখন বাকযুদ্ধ চলছে। দীর্ঘদিনের স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

এর আগে বিএনপির বিভাগীয় শহরগুলোতে সমাবেশগুলো করার সময় প্রায় প্রত্যেকটি স্থানেই পরিবহন মালিকরা ধর্মঘট ডেকেছে। বিএনপির দাবি, সরকারের ইশারায় যানবাহন বন্ধ রাখা হয়েছে। কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ও পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।

বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে গত ১৫ নভেম্বর বিএনপি পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন করে। কিন্তু সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী বলছেন, বিএনপিকে নয়াপল্টনে নয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে হবে। বিএনপি এখনো নয়াপল্টনে সমাবেশ করার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে। 

১০ ডিসেম্বরের সমাবেশে সর্বোচ্চ লোক সমাগম ঘটাতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। ইতোমধ্যে তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেনছেন, ‘১০ ডিসেম্বর আমাদের কর্মীরা, আমাদের নেতারা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সতর্ক পাহারায় থাকবে।’ 

বিএনপি সমাবেশের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে দাবি করে মন্ত্রীরা বলছেন, তাদের এ অপচেষ্টা প্রতিহত করা হবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কুমিল্লার গণসমাবেশে বলেছেন, ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশ নয়াপল্টনেই হবে। সব ফয়সালা রাজপথে হবে। 

‘আগামী ১০ ডিসেম্বরের পরে দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়’ মূলত রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এক আলোচনা সভায় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানের এমন বক্তব্যের পর ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বেশকিছু দিন ধরে বলে আসছেন ‘খেলা হবে।’ 

তাই সবকিছু বিবেচনায় ঢাকার সমাবেশকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। বিএনপিও বড় ধরনের জমায়েত করে শক্তির জানান দেওয়ার চেষ্টা করবে। তবে অনেকে মনে করেন বিএনপি এ মুহূর্তে সরকারের সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করে নয়াপল্টনে হয়তো সমাবেশ করবে না। নয়াপল্টনের দাবি মূলত সরকারকে চাপে রাখার কৌশল। তবে বিএনপি যেন বড় ধরনের লোক জমায়েত না করতে পারে অন্যান্য বিভাগীয় শহরের মতো ঢাকায়ও ক্ষমতাসীন দলের সেই চেষ্টা থাকবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ঘনীভূত হতে পারে চলমান সংকট

করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে টালমাটাল সারা বিশ্বের অর্থনীতি। প্রতিটি দেশেই বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। এর ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশেও। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ।

এ সংকট শিগগিরই কাটবে বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক নানা বিশ্লেষণ বলছে, আগামী বছরটিও (২০২৩) আসছে বড় সংকট নিয়ে। এমনকি খাদ্য সংকটের প্রেক্ষাপটে দুর্ভিক্ষের কথাও আসছে ঘুরেফিরে। 

সংকট উত্তরণে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে ও নিচ্ছে সরকার। এ পরিস্থিতিতে নতুন করে শঙ্কা বাড়াচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা।

রাজনৈতিক সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে দেশের অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়তে পারে। তাই দেশের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও সহনশীল হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

অস্থিরতা সংকট বাড়াবে এটা রাজনৈতিক নেতারাও স্বীকার করেন। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণ কঠিন হবে কিনা, জানতে চাইলে গত ৯ নভেম্বর সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কঠিন তো হবেই। সামনে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি হতে পারে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজপথে নয়, আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের উদ্যোগ নিতে হবে। 

জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। অফিস সময়ে আনা হয়েছে পরিবর্তন। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বাতিল করা হয়েছে। ডলার সংকটে বিলাসী পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। অতি প্রয়োজনীয় ছাড়া সব পণ্যের এলসি না খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বেশকিছু উন্নয়ন প্রকল্পে স্থগিত করা হয়েছে অর্থ বরাদ্দ। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ।

কিন্তু রাজনীতির অঙ্গনে স্থিতিশীলতা না থাকলে, এসব পদক্ষেপ কতটা কাজে দেবে তা দেখার বিষয়। বরং রাজনৈতিক সংঘাত বাড়লে উৎপাদন আরও কমে যেতে পারে। 

দেশে অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপের আশঙ্কা প্রকাশ করে তা থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সমঝোতার ওপর জোর দিতে বলেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। গত ২ নভেম্বর ‘সুজন’ আয়োজিত ‘কেবল অর্থনৈতিক সংস্কার নয়, সংকট সমাধানে প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কার’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এ কথা বলেন। নাগরিক সংগঠনটি জানিয়েছে, দেশ চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে যাচ্ছে। এর থেকে বের হওয়া কঠিন হবে। এই দুঃসময়ে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। 

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। রাজনৈতিক সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশে কোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা সম্ভব না।

ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন, বৈশ্বিক অস্থিরতায় তারা এমনিতেই চাপে আছেন। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে উৎপাদন দিন দিন নেমে যাচ্ছে। ঠিকমতো শিপমেন্ট করতে না পারার কারণে ক্রেতারা অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছে। তাদের চাহিদাও দিন দিন কমেছে। এই সংকটের মধ্যে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা যুক্ত হয় তাহলে আমাদের মহা সংকটে পড়তে হবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ক্ষমতা নিয়ে দু-দলের সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়েছে। তারা কেউ মানুষের কথা ভাবছে না। এক দল ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছে, আরেক দল ক্ষমতায় যেতে চাইছে।’

তিনি বলেন, ‘কষ্টে থাকা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকট ও যুদ্ধে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। রয়েছে বিদ্যুৎ সংকট, ডলার সংকট, কর্মসংস্থানের সংকট। সব সংকট যখন সাধারণ মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে, তখন দুই রাজনৈতিক দল ক্ষমতার কাড়াকাড়িতে ব্যস্ত।

আর তাতে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন। রাজনৈতিক দলের বাইরে থাকা নাগরিক সমাজকে ভূমিকা নিতে হবে। এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কিছুতেই দেখতে চাই না।’

এ বিষয়ে ‘সুজন’-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংকট নিরসনে সরকারের নানা উদ্যোগ রাজনৈতিক অস্থিরতায় কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। দেশের এই ক্রান্তিকালে প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক সংঘাত আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। কারণ উলটো তারা রাজপথ দখলে হুমকি-পালটা হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //