ভোটে অনাস্থা থেকেই গেল

মিরপুর ১ নম্বরের বিএডিসি উচ্চ বিদ্যালয়ের বাইরে দেখা যায় শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ ভেতরে পুরো কেন্দ্র ফাঁকা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সকাল পৌনে ৯টায় একজন ভোটারের দেখা মিলল। তিনি কেন্দ্রে প্রবেশ করেই ইভিএম মেশিনে আঙুলের ছাপ দিলেন। আর বয়োবৃদ্ধ ওই ভোটারকে এক পোলিং এজেন্ট নিয়ে গেলেন গোপন বুথে। ভোট দেয়ার পর গোপন বুথে প্রবেশের কারণ জিজ্ঞেস করলে পোলিং এজেন্ট বলেন, ‘বেশির ভাগ ভোটার ইভিএম বোঝেন না। তাদের শিখিয়ে দিতে হচ্ছে।’

গত ১ ফেব্রুয়ারি শেষ হওয়া ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বেশকিছু কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ কেন্দ্রেই মিরপুরের বিএডিসি উচ্চ বিদ্যালয়ের মতো অবস্থা। সব কেন্দ্রেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট দেখা গেছে। এর বাইরে নৌকার ব্যাজধারী আরো তিন-চারজন করে অবস্থান করতে দেখা যায়। তাদের দুয়েকজন কাপড় ঘেরা গোপন কক্ষের আশপাশে তৎপর ছিলেন।

অধিকাংশ কেন্দ্রেই বিএনপির এজেন্ট দেখা যায়নি। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা নির্বাচনি সামগ্রী নিয়ে বসেছিলেন বুথে। অনেক সময় পর একজন ভোটার আসছেন, ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছেন। আবার একজন আসছেন অনেক পরে। গভীর রাতে ফল ঘোষণার পর দেখা যায়, দক্ষিণে ভোট পড়েছে ২৯ শতাংশ এবং উত্তরে ২৫.৩০ শতাংশ। ঢাকা সিটি করপোরেশেন নির্বাচনে সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনায় এখন ভোটের প্রতি মানুষের অনাস্থা কেন? আয়োজন যাদের জন্য, তারাই এলো না। এর কী কারণ হতে পারে? গত কয়েক বছরেও ভোটারের আস্থা ফেরানো যায়নি কেন?

সিটি নির্বাচনে যে হারে ভোট পড়েছে, তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেও। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আওয়ামী লীগের যে জনসমর্থন সে বিবেচনায় আরো বেশি ভোট আশা করেছিলেন তারা। আওয়ামী লীগের সব নেতাই বলছেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হয়েছে। কেউ কেউ বলেছে, এ রকম শান্তিপূর্ণ নির্বাচন একশ বছরেও হয়নি। অন্যদিকে বিএনপির কণ্ঠে সেই একই সুর। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। বিএনপির পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। এতে নির্বাচনে ভোটদাতাদের অংশগ্রহণও কম।

ভোট শেষ হওয়ার পরপরই উত্তর সিটির আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘একটি দেশ কিন্তু উন্নতির দিকে যাচ্ছে। উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পরিণত হতে যাচ্ছে তার প্রমাণ ভোটারের উপস্থিতি। কারণ, বিদেশে ভোটারের উপস্থিতি অনেক কম থাকে।’

নবনির্বাচিত মেয়রের এমন মন্তব্যের পর আমরা উন্নত দেশগুলোর ভোটের হার অনুসন্ধান করেছি। সেখানে দেখা গেছে, কানাডায় গত বছরের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে ৬৫.৯৫ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। ২০১৭ সালে জাপানে সবশেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে সময় ৫৩.৬৮ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিলেন।

শিল্পোন্নত সাত দেশে অনুষ্ঠিত সবশেষ সাধারণ নির্বাচনগুলোর মধ্যে জাপানে ভোটার উপস্থিতি সবচেয়ে কম ছিল। ফ্রান্সে ২০১৭ সালে ৭৪.৫৬ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছেন। জার্মানিতে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৭৬.১৫ শতাংশ, ইতালিতে ২০১৮ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ৭৩.০৫ শতাংশ, ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে ৬৭.৩০ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৮৬.৮০ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।

শুধু উন্নত দেশ নয়, বাংলাদেশের ইতিহাসেও সাধারণ মানুষের কাছে নির্বাচন হচ্ছে উৎসবের মতো। বিশ্লেষকরা বলছেন, এক সময় বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ভোট দিতে যেতেন।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে, স্বাধীনতার পর প্রথম দুই দশকে জাতীয় নির্বাচনগুলোতে ভোটার উপস্থিতির হার ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশের মধ্যে ছিল। নব্বই-পরবর্তী সময়ে সেই হার ৭৪ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ৮৭ শতাংশ পর্যন্তও উঠেছিল। বাংলাদেশে সাধারণ জনগণের কাছে ভোট উৎসব হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছিল। কিন্তু ইদানিং সেই উৎসব যেন বিষাদে পরিণত হয়েছে!

২০১৪ সালের নির্বাচন, যা বিরোধী দল বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট বর্জন করেছিল এবং সব দলের অংশগ্রহণে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচন- এই দুটি নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন ওঠে। বিরোধী দলগুলো গত কয়েক বছরের স্থানীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া এবং ফল নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে। আর এসব কারণে আস্তে আস্তে মানুষ ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হয়েছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে, ‘ইয়ং পোলাপাইন দেরিতে ঘুম থেকে উঠে, পরে আসবে!’, সেই পরের আর পর হয়নি। ‘গ্রামের লোকরা দুপুরে খেয়ে আসবে’- বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা, তারা আসেননি। এসবই শুধু কথার কথা, কাজের নয়। যার ফলে ‘পোলাপাইন দেরিতে উঠে’ এসব নিয়ে ট্রল হয়েছে। সামাজিকমাধ্যম এমন ট্রলে ভর্তি।

প্রশ্ন থাকে- শুধু বিরোধী দলের সমর্থকরাই নন, সরকার-সমর্থক ভোটাররাও ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকছেন কেন? নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলো বলছে, ঢাকা সিটি নির্বাচনে এতো কম ভোটারের উপস্থিতি আর কখনো দেখা যায়নি। তাহলে দিনে দিনে ভোটের প্রতি মানুষের এত অনীহা বাড়ছে কেন?

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটারের নগণ্য উপস্থিতির পেছনে আস্থার সংকট বড় একটি কারণ। তা ছাড়া ভোটারের মধ্যে নানা রকম শঙ্কাও বিরাজ করছিল। এমন ভোট আমরা চাইনি- সিইসির এ বক্তব্যের মধ্যেই প্রশ্নমুক্ত ভোটের যে জনপ্রত্যাশা ছিল, এর উত্তর নিহিত রয়েছে। ইভিএম পদ্ধতি বোঝানোর নামে ভোটকক্ষে, অর্থাৎ বুথে আওয়ামী লীগ কর্মীর উপস্থিতির যে খবর শোনা গেছে, তাও অনাকাঙ্ক্ষিত-অনভিপ্রেত, একই সঙ্গে প্রশ্নবোধকও।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা অবশ্য নির্বাচনে কম ভোটারের উপস্থিতির জন্য রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীদের দায়ী করেছেন। তবে ঢাকা সিটি নির্বাচনে ভোটের হার দেখে সরকারি দলও যখন ভাবনায়, তখন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বললেন, ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অস্বাভাবিক কম ভোট পড়া আমার কাছে স্বাভাবিক বলেই মনে হয়।

ভোটকেন্দ্রে বিরোধী পক্ষের দৃশ্যমান অনুপস্থিতি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার ও নির্বাচন ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। ভোটের প্রতি জনগণের নিরাসক্তি গণতন্ত্রের জন্যও হুমকি বলে মনে করছেন মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যত কী? এই প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন। নির্বাচনবিমুখতা গণতন্ত্রহীনতার নামান্তর। এই নির্বাচনে ভোটের প্রতি জনগণের অনীহা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, জাতি কি ক্রমান্বয়ে গণতন্ত্রহীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?’

মাহবুব তালুকদারের শঙ্কা, বিভিন্ন সময়ে অসাংবিধানিক শাসনের কবলে পড়া বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা ব্যর্থ হলে ফের সংকট আসতে পারে। ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বাভাবিক পথ যদি রুদ্ধ হয়ে যায়, সেই অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই পরিস্থিতিকে ‘ক্রান্তিলগ্ন’ আখ্যায়িত করে সব রাজনৈতিক দলকে আলোচনার টেবিলে বসার পরামর্শ দেন তিনি। তা না হলে অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে পা বাড়াবে বাংলাদেশ- এই সতর্কবার্তাও আসে তার কাছ থেকে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ভোটাররা মনে করছেন, তাদের ভোটে কোনো পরিবর্তন ঘটে না; যা হওয়ার তাই হবে। এসব কারণে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।’

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘মূলত তিন কারণে ভোটার উপস্থিতি কম। প্রথমত, ভোটাররা মনে করেছেন, যে মার্কায়ই আমি ভোট দেই না কেন, এটি জমা বা গণনা হবে নির্দিষ্ট একটি মার্কায়। ফলে ভোট দেয়া না দেয়া একই কথা। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার পর শান্তিতে নির্বিঘ্নে কোনো ধরনের হেনস্তা ছাড়া ফিরে আসতে পারা যাবে কি না, সেটি নিশ্চিত নয়। এ ক্ষেত্রে হুমকিও ভয় কাজ করেছে তৃতীয়ত, ইলেট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে বিএনপি যে প্রচারণা চালিয়েছে, তাতে এই সিস্টেমের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়েছে। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, ভোটের প্রতি মানুষের আস্থা নেই।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //