‘ভূতের খুনি’ দস্যুকবি তাব্বাতা শাররান

তাব্বাতা শাররান ছিলেন প্রাচীন আরবের দস্যু কবিদের একজন। প্রাচীন আরবে তাকে নিয়ে অনেকগুলো মিথ আছে। তার মধ্যে একটি- তিনি মরুভূমিতে ‘ভূত’ বা ‘পেত্নি’ খুন করে খ্যাতিমান হয়েছিলেন। কবির মূল নাম ছাবিত। তিনি তার পিতা জাবির ইবন সুফিয়ান আল-ফাহমি। কবি ছিলেন বনু ফাহাম গোত্রের। ৬০৭ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। তার অধিকাংশ যুদ্ধ হয়েছিল হুদাইল গোত্রের বনু সাহিলা ও কিনানা গোত্রের বনু নাফাতার সাথে। তিনি সুফিয়ান ইবন সাইদা আল-হুদালি নামে হুদায়েলের এক শিশুর হাতে নিহত হন। তাকে রখমান গুহায় সমাহিত করা হয়। এটি এখন সৌদি আরবের তায়েফের কাছে তালবাত গুহা নামে পরিচিত।

প্রাচীন আরবের দস্যু কবিদের কবিতা সাহিত্যের ইতিহাসে খুবই গুরুত্ববহ। শাররানের দাদার নাম  সুফিয়ান। সুফিয়ান হচ্ছে আদীর ছেলে। আদী হচ্ছে কা’বের ছেলে। আর কা’ব হচ্ছে হারবের ছেলে। হারব হচ্ছে তাইমের ছেলে। এভাবে তাদের বংশ আরবের প্রাচীন বংশের একটি ধারা আদনানে গিয়ে ঠেকেছে। আরব জাতির আদি উৎস আদনান ও কাহতানি বংশ। কবির মায়ের বংশধারা হচ্ছে- উমাইমা আল-ফাহমিয়া বনু আল-কাইন ইবন ফাহম ইবন আমর ইবন কায়েস আইলান ইবন মুদার। অর্থাৎ তার মা হচ্ছেন উমাইমা আল-ফাহমিয়া। তিনি বুন আল-কাইন কবিলার বাসিন্দা। তার বংশধারা যতটুকু জানা গেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে আরবের প্রাচিন গোত্র মুদার গোত্রেই তার পূর্বপুরুষের জন্ম। উমাইমার প্রথম স্বামী জাবিরের ছিল পাঁচ সন্তান। এর বড়জন হলেন তাব্বাতা শাররান।

ছাবিত কীভাবে তাব্বাতা শাররান
তাব্বাতা শাররান আসলে তার লকব বা উপাধি। এর অর্থ যে তার বগলের নিচে মন্দ কিছু বহন করে। বিখ্যাত গ্রন্থ কিতাব আল-আগানিতে তিনি কীভাবে এই নামটি অর্জন করেছিলেন তার অনেকগুলি বিবরণ রয়েছে। একটি বর্ণনা এরকম-একদিন কবি মরুভূমিতে একটি মেষ দেখতে পান। তিনি তা তুলে নিলেন আর সেটা তার বাহুর নিচে নিয়ে বহন করতে থাকেন। কিছুদূর যাওয়ার পর সেটি তার শরীরে পেশাব করে দিলো। তারপরও তিনি সেটা বহন করে যেতেই থাকলেন। তাবুর কাছাকাছি যেতে সেটি ভারী হয়ে ওঠে। ততক্ষণে, তিনি এটি ছুঁড়ে ফেলে দেন। তখন তিনি দেখেন যে আসলে এটি একটি ভূত ছিল। এটাকে এতদূর বহন করে নিয়ে এসেছেন।  তার গোষ্ঠী তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে তিনি কি বহন করে এনেছেন । তখন তিনি উত্তর দিলেন ‘গুল’ (ভূত)। এ থেকে গোত্র তার ডাক নাম দেয় তাব্বাতা শাররান। এই ডাক নাম নিয়ে আরেকটা কথা প্রচারিত। তার মা একবার তাকে বলে মরুতে যাও। আর তুমি থলে ভরে ট্রাফল (মাশরুম জাতীয় খাবার) নিয়ে আস। এখন ট্রাফলের মৌসুম। তাব্বাতা শাররান ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল আর সাপ দিয়ে তা পূর্ণ করল। তারপর ব্যাগটি তার বাহুর নীচে নিয়ে তাঁবুতে ফিরে এল। তিনি তার মায়ের সামনে ব্যাগটি ছুঁড়ে ফেললেন। এরপর মা এটি খুললেন। খুলে দেখেন সাপে থলে ভরা। ব্যাপারটি তিনি উপজাতির মহিলাদের কাছে বললে তারা ছাবিতের ডাক নাম দেয়-তাব্বাতা শাররান বলে। এছাড়াও কথিত আছে যে তার মা তাকে এই নাম দিয়েছিলেন। কারণ তিনি সাধারণত অভিযানকারী দলের সাথে ভ্রমণ করার সময় তার তরবারি তার বাহুর নীচে বহন করতেন। আধুনিক পণ্ডিতরা বিশ্বাস করেন এই নামটি কবির কষ্টের অনিবার্য প্রবণতাকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে করা। 

ভূত খুনের মিথ
কবিকে নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তারমধ্যে একটি আগের মতই। তবে এটা ভূত বহন নয়, ভূত মারার গল্প। একদা কবি বনু হুদাইল অঞ্চলে রাতে সফরে বের হন।  সেসময় একটি ভূত তার পিছু নেয়। কবি তার সাথে যুদ্ধ করে তাকে হত্যা করেন। খোলা মরুভূমিতে রাত কাটিয়ে সকালে তিনি তাকে তার বাহুর নীচে বহন করে তার বন্ধুদের দেখান।  আর এই ভূতের মাথা ছিল বেড়ালের মাথার মতো। জিহ্বা ছিল বিভক্ত। নিতম্ব কুকুরের সদৃশ। অন্য মিথ-একবার মরুভূমিতে রাতে এক পেত্নীর সাথে দেখা করে তার সাথে  যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন।  কিন্তু পেত্নিটি চিৎকার করে তার ভয়ানক চেহারা প্রকাশ করে। যা কবিকে তার মাথা কেটে ফেলতে প্ররোচিত করে। 

শাররান কাব্যনৈপুণ্য
তিনি উপজাতীয় যুদ্ধ, মরুজীবনের কষ্ট ও ভূত নিয়ে কবিতা লিখেছেন। প্রাচিন কাব্যসংকলন মুফাদ্দালিয়াত (৮ম শতাব্দী) ও হামাসাহ (নবম শতাব্দী) উভয়টিতে তার কবিতা সন্নিবেশিত ছিল। তাব্বাতা শাররানের কবিতার  দিওয়ান বা সংকলনে ২৩৮টি শ্লোক রয়েছে। তারমধ্যে ৩২টি কাসিদা। আর বাদ বাকি খণ্ড কবিতা। এগুলো সবই  সুলুক বা দস্যু কবিদের আদর্শে রচিত। এসব রচনায় তার  তীব্র ব্যক্তিত্ব ও উপজাতীয় মূল্যবোধের প্রত্যাখ্যান প্রকাশ পেয়েছে।

তার কাব্যের ধারা দু’ভাগে বিভক্ত। একটা হচ্ছে- ক্বাসিদা কাফিয়া। এটি প্রাচিন কাব্যসংকলন মুফাদ্দালিয়াতের সূচনামূলক কবিতা। ইতালীয় প্রাচ্যবিদ ফ্রান্সেসকো গ্যাব্রিয়েলি মনে করেন কাফিয়া একটি একক কবিতা নাও হতে পারে। তার ধারণা এটি অনেকের লেখার সন্নিবেশ। আরেক ধরণের কবিতা তিনি লিখেছেন যার নাম ক্বাসিদা লামিয়া। জার্মান মহাকবি গ্যোটে তার কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি তাব্বাতা শাররানের কবিতাও অনুবাদ করেছেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //