গাজা বিষয়ে আরব জনগণের পদাবলি

সাধারণ আরবরা গাজা বিষয়ে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া জানান তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই বললে চলে। সেই বিবেচনায় আরব গণমাধ্যম আল জাজিরায় পরিবেশিত ব্যতিক্রমী এই কবিতাগুলো তরজমার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। এতে প্রকাশ পেয়েছে নিস্পৃহ আরব শাসকদের বিপরীতে আরব জনগণের ইচ্ছা-চিন্তাধারা। লেখাগুলোতে গাজার নির্যাতিত মানুষের পক্ষে উচ্চারিত হয়েছে প্রতিবাদ। 

প্রাক ইসলামী যুগ থেকে শুরু করে এখন অবধি আরবরা কবিতার প্রেমিক হিসেবে প্রতিপন্ন। তারা তাদের ভালোবাসা, আশা-নিরাশা, প্রতিবাদ সুখ দুঃখ প্রকাশ করেন কবিতায়। ইসলাম-পূর্ব বা ইসলামের সমকালে, ইসলাম-পরবর্তীকালে আরবের রক্তের সঙ্গে মিশে থেকেছে কবিতা। এখানে যে চারটি কবিতা তরজমা করা হয়েছে তার প্রথমটির লেখক থাকেন আমেরিকাতে। পেশায় ছাত্র। দ্বিতীয় কবিতাটি ইয়েমেনি একজন চাকরিজীবীর। তৃতীয় কবিতাটি একজন জর্ডানি লেখকের। আর চতুর্থ কবিতাটি কুয়েতের বাসিন্দা, তিনিও একজন চাকুরে। অনেকগুলো কবিতা থেকে এগুলো বেছে নেওয়া হয়েছে। মূল আরবি থেকে তরজমা: মহিউদ্দীন মোহাম্মদ

গাজা মরবে না
তারিক আবদুল কিসওয়ানি 

এই অবরোধ সত্ত্বেও গাজা কখনোই মরবে না
গাজা কখনোই মরবে না- একে রক্ষা করবেন আকসা’র প্রভু।
এই অবরোধ সত্ত্বেও গাজা কখনোই মরবে না-

গাজা মরবে না, ঘরের প্রভু একে রক্ষা করবেন
গাজা কখনোই মরবে না- যদিও খারাপ লোকেরা ঘৃণা করে একে
কোনো সিদ্ধান্ত না নিলেও গাজা কক্ষনো মরবে না
গাজা মরবে না কখনোই, গ্রাস করবে না তুফান
গাজা মরবে না কখনোই...আন্ধার গিলে খাবে না তাকে,
অন্ধকার নামলেও, যন্ত্রণা সত্ত্বেও না,
গাজা মরবে না, শান্তির জন্য লড়াই সত্ত্বেও।

 কথার পিঠে পিঠে কথা হবে অনেক,
তবু আমরা তোমাকে পাহাড়ের উপরে তুলে ধরব।
এই অবরোধ সত্ত্বেও গাজা মরবে না-
গাজা মরবে না- প্রভু একে রক্ষা করবেন
এই অবরোধ সত্ত্বেও গাজা মরবে না...
গাজা মরবে না...গাজা মরবে না...গাজা মরবে না
আকসার মালিকের অনুমতি নিয়ে- আমরা গাজায় ফিরে যাব,
যদি তিনি বখাটেদের ঘৃণা করেন...আমরা গাজায় ফিরে যাব,
আমরা গাজায় ফিরে যাব...আমরা ফিরব গাজায়।


দুঃখের জেরুজালেম
মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ বাবাদ 

ওহে, জেরুজালেম! তুমি যতবারই আঘাত করো, তুমি অবশ্যই অশ্রুজলে ডুবে যাবে।
এটি একটি সাধারণ জিনিস যা তোমাকে অত্যাচার আর অপব্যবহারের অনুভূতি দেয়। কেন তুমি অবাক হচ্ছো?

তোমাকে আমাদের সামনে জবাই করে কবর দেওয়া হবে, আর তারার মতো রাজকন্যা আমার, তুমি বিলীন হতে পার।
জিহাদকে জবাই করা হয়েছে আর এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। আমি কি জেগে উঠব?
জনতা পরাজিত হবে, আর কায়েমি আজ্ঞাবহ দাসদের জন্য তাদের জিনিসগুলো থেকে যাবে।

আরবদের অহংকার তাদের শাসকরা ছিনিয়ে নিয়েছে, তাই তাদেরটা ছিনিয়ে নেওয়া স্বাভাবিক।
আর অন্যায়, এটা বড় অন্যায়, যখন আমি দেখি জালেম, বনমানুষ, খুদে আগ্রাসীদের বংশধর।

তারা তোমার মাটির ওপর পদচারণা উপভোগ করে, যে মাটি শ্রেষ্ঠ দূতদের পা স্পর্শ করেছে।
নিরর্থক আমি কল্পনা ও বীর্য দিয়ে রক্ষা করি, আর তারা আমার ক্রোধে যা করেছে তার দেনা শুধি বা নিন্দিত হই।
খোদার কসম, আমার হাতে কোনো অস্ত্র নেই, আমার আছে শুধু দোয়া আর আর্তনাদ।
আমার উপভাষায় অশ্রু, কালি, কাগজ, দুঃখের কলম ছাড়া আর কিছু নেই।

হে জেরুজালেম! তুমি মুক্ত হবে না, যতক্ষণ না ইতিহাসের চিহ্ন আমাদের স্বাধীনতা এনে দেয়; হয়তো তুমি মুক্তি পাবে।

তিনি খালিদ ইবনে ওয়ালিদকে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছিলেন আর তিনি আমাদের নেতা, বিশ্বাসীদের সেনাপতি হয়েছিলেন।
আর আমাদের মধ্যে কে সেই খালিদ, পূর্বসূরিদের ধারায় টিকে থাকতে পারে?

ইসলামের প্রাণশক্তি থাকলে আমরা তা অবমূল্যায়ন করতাম না নিশ্চয়ই।
কিন্তু আমাদের মধ্যে যেটা ইসলাম সে তো কুনিয়াত!
আমরা ইসলাম কবুল করে প্রকৃত স্বীকৃতি দিইনি। 


দেখছি ও শুনছি, কথা বলা বারণ
ফয়সাল মুহাম্মদ আল-বালায়ি

গাজায় অন্ধকার নেমে এসেছে আর শেষ হয়েছে রাত,
শোকাতুরদের কান্নায় পরিস্ফুটিত শোকের পরিবেশ।
হান্না আরবদের ভাই, হান্না আদনানের ভাই।
আমাদের ইতিহাস বন্ধ্যা,
আকাশের উপরেরটা,
আমরা দেখি আর শুনি, কথা বলা বারণ।

গাজা অবরোধের মধ্যেও বেঁচে আছে,
সে উচ্চস্বরে চিৎকার করছে যাতে আমরা তার সাথে সাক্ষাৎ করি।
‘আরব’ নামটি কয়েকটি অক্ষরযোগে গঠিত একটি সুপরিচিত শব্দ।

হে গাজা, ভয় নেই, তোমার কণ্ঠে শ্রবণযোগ্য প্রতিধ্বনি,
আমরা দেখছি ও শুনছি, তবে কথা বলা বারণ।

গাজার মাটিতে বিষাদ ও ক্ষত বাড়ছে,
চারদিকে আগুন জ্বলছে,
তবে আরবরা স্বাধীন, তারা ঘরের রক্ষক
সংকল্প আর সংকল্প করে তারা বিষয়টির নিন্দা করছে
আমরা দেখছি ও শুনছি, কিন্তু কথা বলা বারণ।


হ্যাঁ, আমি আরব নই
সাল সাবিল আদিল হুসেন

তুমি উঁচুতে আওয়াজ তোলো, চিৎকার করো
তুমি বিপন্ন হয়েছ
আর সমস্ত আরব নীরবে তাকিয়ে আছে
আরবের বিবেক মারা গেছে
তুমি কিসের জন্য অপেক্ষা করছ, ফিলিস্তিন?

গণহত্যা, রক্ত আর হাহাকার
কামান আর লাশ...
এবং বছরের পর বছর ধরে শিশুদের কান্না ঝরানো হয়।
তাদের কাছ থেকে হাসি ও নিষ্কলুষতা চুরি করা হয়েছে
আর কত না ধন্য চোরেরা!

গণহত্যার ছবি ও তাদের কান্না আমাদের নাড়া দেয় না,
যে ছবিগুলো গাছ ও পাথরকে কাঁদিয়েছে।
সময় এসেছে আমাদের হৃদয় নরম করার,
আমরা ডাকছি; কিন্তু কেউ শুনছে না,
আর কত দিন আমরা মরে পড়ে থাকব?

লাশগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, রাস্তার কোণে পুতুল সদৃশ সাজানো

আমরা আমাদের পায়ের ওপর পা রাখছি আর আমরা পাত্তা দিচ্ছি না,
আমাদের রক্তাক্ত পদধ্বনি তোমার জমিন-আকাশকে কলঙ্কিত করেছে।

যে কোনো মৃত্যুতে নারী ও বয়স্করা শোক প্রকাশ করেছেন

গুলি আর কামানের শব্দআমার ঘুমানোর সময় গান হয়ে উঠছে...
আমাদের নেতারা প্রতি রাতে এ গাননা শুনে ঘুমাতে পারেন না।

তারা আমাদের হাত তাদের হাতে রাখে...আর আমরা এটা ঘৃণা করি
তারা আমাদের মর্যাদায় আঘাত হেনেছে,
আমাদের অজ্ঞতা ও মূর্খতাকে ব্যঙ্গ করছে।

তারা আমাদের মাটি, আমাদের স্বপ্ন আর আমাদের আসমানকে ধর্ষণ করেছে,
আমাদের নেতারা তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে
আমাদের মর্যাদার জন্য করেছে সন্ধি নাকি ষড়যন্ত্র?

শান্তি আলোচনার টেবিলে অপরাধ ও হত্যাকাণ্ড।
তাদের চোখ দিয়ে শান্তি কী করে জানবে?
তোমার সাথে কোনো মিলন নেই, কোনো শান্তিচুক্তি নেই,
তাহলে মৃত্যুদ- হয়েছে শান্তির?

ধন্য তোমার হাত, যারা আমাদের উজ্জ্বল ইতিহাসের পথ দেখিয়েছে,
ধন্য তুমি যারা তোমার সন্তানদের রক্তে তোমার হাত রাঙিয়েছে,
ধন্য তোমরা যারা স্লোগান তুলেছিলে, ‘হে জাতি যাদের অজ্ঞতাকে অন্য জাতি উপহাস করেছে।’

আর এর শিকার ছিলাম আমরা
শিকার হয়েছে ফিলিস্তিন
শিকার হয়েছে গাজা।

তখন আমরা তোমার করুণায় থাকব
আমরা তোমার প্রহসন, ষড়যন্ত্র ও বোকামির শিকার হব
আমরা তোমার পাপ ও অপরাধ হিসেবে গণ্য।

আমাকে ক্ষমা করো গাজা
এখন পর্যন্ত আমি আরব নই
আমি আরব বলে গর্ব করব না।

আমাদের নেতারা তাদের পায়ের তলায় আরব মর্যাদাকে বিচূর্ণ করেছে।

এসো আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষে কাঁদি,
এসো আমরা উদযাপন আর অপমানের পেয়ালায় আঘাত করি...আর আমাদের শুকিয়ে যাক স্বপ্ন
এসো আমরা আমাদের অপরাধ উদযাপন করি...খুন ও খুনি
আমাদের জন্য লজ্জা..

লজ্জিত এমন একটি জাতির জন্য যারা নিজেদেরকে ধুলোয় কবর দিয়েছে
তার শত্রুদের হাতে চুপচাপ মরতে থাকুক,
আর ঘণ্টা বাজাও,
মোমবাতি নিভিয়ে দাও-
আরবের বিবেক মারা গেছে,
তাই তারা অধঃপতিত হয়েছে আর অশ্রুপাত করছে...

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //