কবিতা: জীবন-জানালা

একজন আবৃত্তিকর্মী হিসেবে এবং কবিতা ও গল্প লেখার সুবাদে ইদানীং প্রায়ই যে প্রশ্নটির মুখোমুখি হই তা হলো- কবিতা পড়ে কী হয়? সত্যিই কবিতা পড়ে কী হয়? বিশ্বায়নের এই ব্যস্ততাপূর্ণ জীবনে যেখানে দম ফেলার সময় নেই মানুষের, যেখানে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা আউটসোর্সিং, ইউটিউবিং, টিকটক  ইত্যাদির মাধ্যমে ক্যারিয়ার গঠন ও উপার্জন করা নিয়ে ব্যস্ত। এখন স্মার্টফোন ও এফএম রেডিওর কল্যাণে চব্বিশ ঘণ্টা যে কোনো ভাষার গান, সিনেমা ইত্যাদি উপভোগ করার সুযোগ আছে। এখন বিশ্বব্যাপী ভাষার শুদ্ধতা ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়েছে। এ সময়ে বাংলা কবিতার মতো উচ্চমানের সাহিত্যকর্ম কীভাবে টিকে থাকবে? বিশেষত কবিতা পড়ে, লিখে বা আবৃত্তি করে যেখানে অর্থ উপার্জনের তেমন সুযোগ নেই বললেই চলে, সেখানে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়াই তো স্বাভাবিক। এ সময়ের বাস্তবতা এই যেএকজন জনপ্রিয় কবি, একজন প্রকাশক কিংবা একজন খ্যাতিমান আবৃত্তিকারের চেয়ে একজন মোটিভেশনাল বক্তার, একজন ইউটিউবারের আয় ও উপযোগিতা বেশি। তার মানে বাংলা কবিতা কি তার উপযোগিতা হারিয়েছে? বাংলা কবিতার কি মানুষকে কিছুই দেওয়ার নেই? 

আমি ঐসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই গধঃযবি অৎহড়ষফ-এর দেওয়া কবিতার সংজ্ঞায়- ‘Poetry is the criticism of life’ অর্থাৎ কবিতার মধ্য দিয়ে আমি জীবনকে উপলব্ধি করতে শিখি, পর্যালোচনা করতে শিখি। জীবনের বিচিত্রতার প্রতি মানুষের আকর্ষণ ও কৌতূহল অপরিসীম। কোনো সুনির্দিষ্ট পথ নেই জীবন যাপনের। জীবন-অভিজ্ঞতা মানুষকে আনন্দ দান করে এবং আত্মবিশ্বাস জুগিয়ে তার যাপিত জীবনে চলার পথকে সহজ করে তোলে। মানব মন তাই সর্বদা খুঁজে বেড়িয়েছে জীবন-রহস্য। 

জীবন সম্পর্কে মানুষের ধারণা জন্মায় মূলত দুটি উপায়ে- প্রথমত প্রতিনিয়ত যাপিত জীবনের ব্যক্তিগত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে লব্ধ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে; এবং দ্বিতীয়ত অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বা জ্ঞানের মাধ্যমে। সৃষ্টিশীল মানুষেরা বিশেষ দৃষ্টিসম্পন্ন; তাদের দেখার চোখ আলাদা। সেই দৃষ্টিশক্তি দিয়ে লব্ধ জীবন-অভিজ্ঞতা তারা তাদের সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে আমাদের সামনে তুলে ধরেন  জীবনের নানান আঙ্গিক ও দর্শন কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস বা চিত্রকর্মের আদলে; আমরা ঋদ্ধ হই। বদ্ধ ঘরের চার দেয়ালের ভেতরে বসে বাইরের বিশাল প্রকৃতিটাকে পুরোপুরি দেখা ও উপলব্ধি করা যায় না। এজন্য পুরোপুরি বাইরে বেরিয়ে আসতে হয়, নয়তো নিদেনপক্ষে জানালাগুলো দিয়ে দৃষ্টি ফেলে বাইরের সেই বিশাল প্রকৃতির ক্ষুদ্রাংশগুলো অবলোকন করতে হয়। তাতে একঘেয়েমি কেটে গিয়ে চোখে ও মনে প্রশান্তি যেমন অনুভূত হয়, তেমনি বাইরের জগৎটা সম্পর্কে বেশ খানিকটা ধারণাও তৈরি হয়। একইভাবে বোধ জন্মাবার পূর্বেই সমাজ, পরিবার ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ জীবনযাপন সম্পর্কিত যে ভুল ধারণা, নির্দেশনা, কুসংস্কার ও কূপম-ুকতা দিয়ে নির্মিত ঘরের চারদেয়ালে আমাদের মস্তিষ্ককে বন্দি করে ফেলে, সেই ঘর থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে এসে জীবনের বিশালত্বকে অবলোকন, উপলব্ধি ও উপভোগ করা বেশিরভাগ মানুষের পক্ষেই একজীবনে সম্ভব হয়ে ওঠে না। আর ঠিক এই জায়গাটিতেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে সেসব সৃজনশীল মানুষের সৃষ্টিকর্মসমূহ আমাদের জন্য সেই জানালা হয়ে আসে- যার মধ্য দিয়ে দৃষ্টি ফেলে আমরা একই সঙ্গে পেতে পারি মানসিক প্রশান্তি ও জীবন-অভিজ্ঞতা।   

কবিতা হলো জীবনের বিশালত্বকে দেখবার জন্য তেমনি এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ জানালা। একেকটি কবিতা একেকটি জানালা হয়ে জীবনের একেকটি অংশ দেখিয়ে দেবে যেমন, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন কবিতা বৈচিত্র্যময় জীবনের ভিন্ন ভিন্ন অংশকে তুলে ধরবে আমাদের সামনে। তাই কবিতা আমার কাছে জীবন-জানালা। একেকজন কবির অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ শক্তি আর দর্শনে ঠাসা তাদের কবিতাগুলো। প্রত্যেকটি কবিতাই জীবনকে নতুনভাবে চেনায়, ভাবতে শেখায়, যাপন করতে শেখায়। আর ক্ষুদ্রায়ু এই আমাদের এ কারণেই কবিতা পড়া। কবিতা নামক জীবন-জানালা দিয়ে তথাকথিত সামাজিক-চোখে দেখা জীবনকে নতুন রূপে আবিষ্কার করা। জীবনোপলব্ধির আলোড়ন ঘটিয়ে আমাদের হৃদয়কে ধৌত করে পরিশুদ্ধির দিকে নিয়ে যায় বলেই আমরা কবিতা পড়ি। একই কবিতায় যখন কবি জীবনানন্দ দাশ জীবনকে বেদনাময় ভার হিসেবে ইঙ্গিত করে একবার বলেন ‘জাগিবার (জানিবার!) গাঢ় বেদনার/অবিরাম, অবিরাম ভার সহিবে না আর।’ আর এরপরই যখন বলেন ‘গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে/আরো একটি প্রভাতের ইশারায়, অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।’ তখন জীবনের দুটি বিপরীত রূপ সমান দৃঢ়তায় আন্দোলিত করে আমাদের, আমরা তুমুল বেদনায় ভেঙে না পড়ে জীবনের বহুমাত্রিকতাকে ধারণ করতে শিখে যাই। 

একইভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন বলেন, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চুনি উঠলো রাঙা হয়ে,’ কিংবা কাজী নজরুল ইসলাম যখন বলেন, ‘আমি ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদচিহ্ন,’ তখন নিজের ভেতরে আরেক আমির অস্তিত্ব খুঁজে পাই আমরা। আমিত্ব এসে ভর করে আমাদের ভেতরে, আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে ফুঁসে উঠি আমরা। আবার রবীন্দ্রনাথই বলে দেন, ‘ঠেলে দে আড়াল, ঘুচিয়ে আঁধার আপনারে ফেল দূরে, সহজে তখুনি জীবন তোমার অমৃতে উঠিবে পুরে’ অর্থাৎ আমিত্বকে ছুড়ে ফেলে দিতে বলছেন সমস্ত অন্ধকার থেকে বাঁচার জন্য। তখন আমরা শিখে যাই জীবনে আমিত্ব ও আত্মবিশ্বাস যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সর্বাবস্থায় নিজের পা দুটিকে মাটিতে রাখা, বিনয়ী থাকা।   

অপ্রাপ্তির প্রচ- হতাশায়ও আত্মসম্মান নিয়ে সচেতন থাকার মুক্তিমন্ত্র রবীন্দ্রনাথ  শোনান কবিতায়, ‘ভিক্ষা না নিবি, তখনি জানিবি ভরা আছে তোর ধন’ কিংবা দেশ-কাল-পাত্রের সীমানা অতিক্রম করে জড়নবৎঃ Browning-এর সফলতার বীজমন্ত্র কানে বাজে, “A minute's success pays the failure of years”. 

সামাজিক জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠলে অদ্ভুত বাঁশিওয়ালার মতো কবি আমাদের শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনেন স্বাধীনতার স্বরূপ ব্যাখ্যা করে, যেমন শামসুর রাহমান বলেন, “স্বাধীনতা তুমি রোদেলা দুপুরে/মধ্য পুকুরে, গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার” কিংবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার কবিতায় সমবেত প্রচেষ্টার উদাহরণ দিয়ে দলবদ্ধ থাকার দীক্ষা দিয়ে চোখ খুলে দেন এভাবে, “প্রত্যেক মৌমাছির আছে নিজস্ব খুপরি, কিন্তু যার যখন ইচ্ছে উড়ে যাবার স্বাধীনতা; ফুলের ভেতরে মধু সে জেনেছে, তবু সঙ্গসভ্যতার জন্য তার শ্রম।” এভাবেই যাপিত জীবনের রূপ প্রতিভাত হয়ে ওঠে আমাদের চোখে কবিতার জানালা দিয়ে। এখানেই কবিতা পড়ার সার্থকতা! কবিতা এভাবেই আমাদের দেখার চোখ সৃষ্টি করে দিয়ে অন্যদের থেকে আমাদেরকে পৃথক করে গড়ে তোলে। আমরা খণ্ড খণ্ড জীবন-অভিজ্ঞতা আর জীবন কল্পনায় ঠাসা কবিতার সম্মেলনে ঋদ্ধ হই। প্রত্যেকে নিজের জীবনসমুদ্রে হয়ে উঠি এক একজন কলম্বাস কিংবা ভাস্কো-দা-গামা!

এই কথাটিও প্রায়ই বলা হয়, “পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের এই অস্থির ব্যস্ত সময়ে কবিতা টিকে থাকবে কি?” আমি বলি- টিকে যদি কিছু থাকে তবে কবিতাই টিকে থাকবে। কেননা কবিতা গতিশীল, কালোত্তীর্ণ এবং সংকীর্ণতামুক্ত! ব্যস্ততা যত বাড়বে, কবিতার চাহিদা ততই বাড়বে! অনেকটা ক্রিকেটের ‘টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট’-এর মতো! টিকে না থাকবার আশংকা যদি সময়-স্বল্পতার কারণে হয় তবে বলব এই ব্যস্ততার যুগে উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধই বরং পড়বার সময় কেউ পাবে না; কিন্তু জ্যামের মধ্যে, বাড়িতে বসে মোবাইলে ঠিকই পড়ে ফেলবে কয়েকটা লাইনের সমন্বয়ে অবয়বপ্রাপ্ত একটি জীবন-জানালা কবিতা! কেননা মানুষ সুখে উদ্বেলিত, দুঃখে দীর্ণ! শত কষ্ট, যন্ত্রণা মন্থন করে জীবনকে এগিয়ে নিতে সে কবিতার কাছেই ফিরে আসবে! কবিতা জীবন-জানালা হয়ে তাদের দেখাবে যাপনের পথ, যেখানে রফিক আজাদ শোনাবেন “যদি ভালোবাসা পাই আবার শুধরে নেবো জীবনের ভুলগুলি, যদি ভালোবাসা পাই, ব্যাপক দীর্ঘ পথে বয়ে যাবো ঝোলাঝুলি!”

সুকান্ত অহিংসা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যত্নের সাথে লালন করবার দীক্ষা দেবার সাথে সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার সচেতনতার বার্তাও দিয়ে যাবেন এভাবে- “ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই/ জানি আমি ভাবী বনস্পতি/বৃষ্টি, মাটির রসে পাই আমি তার তো সম্মতি/সেদিন ছায়ায় এসো; হানো যদি কঠিন কুঠারে/তবু তোমায় আমি হাতছানি দেবো বারে বারে/ফল দেবো, ফুল দেবা/দেবো আমি পাখিরও কূজন/একই মাটিতে পুষ্ট তোমাদের আপনার জন!”

কবি আবুল হাসান সহিষ্ণুতা শেখাবেন এভাবে - “ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহো/ঝিনুক নীরবে সহে যাও/ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তা ফলাও।” পরশ্রীকাতরতাময় এই সময়ে শঙ্খ ঘোষ শোনাবেন -

“সব সময় কি ভালোই বলবে লোকে?/মন্দ কথাও শুনতে হবে কিছু।/তাই বলে কি ভেঙে পড়বে শোকে?/তাতেই এমন করবে মাথা নিচু?/এও প্রকৃতির জোয়ার-ভাটার মতো/যাওয়া-আসার ছন্দ মেনেই চলে- /রাত্রিবেলায় বিরাট ছিলো ক্ষত/ভোর ধুয়ে দেয় সবটা শিশিরজলে।”

হতাশার তিমিরে নিমজ্জিত হৃদয়কে নির্মলেন্দু গুণ শোনাবেন- “দুঃখ করো না, বাঁচো/ প্রাণ ভ’রে বাঁচো, বাঁচার আনন্দে বাঁচো/বাঁচো, বাঁচো এবং বাঁচো/তোমাকে বাঁচাতে পারে আনন্দ, তুমি তার হাত ধরো।” অথবা  তীব্র অভিমানে আত্মঘাতী হতে যাওয়া কোনো কিশোর অথবা কিশোরীকে জীবনের পথে আহ্বান করে তিনি বাঁচার প্রেরণা জোগাবেন এভাবে-

এই মূর্খ অবিবেকী পৃথিবীর সাথে/কেন হেন অভিমান?/এ পৃথিবী তোমাকে বোঝার মতো প্রাজ্ঞ হোক আগে,/তারপর তাকে শাস্তি দিয়ে তুমি চলে যেও চির-পৃথিবীতে/তার আগে নয়।/যদি মনে হয় ছল করে বাঁচা/তবে তা-ই হোক।/তবু তুমি এখন যেও না।/আবার কংশের জলে মুখ ধুয়ে/ফিরে এসো জীবন গঙ্গায়;/সঙ্গমে সংগ্রামে,/জীবনের অশেষ-বিস্ময়ে,/সুখে দুঃখে আনন্দে, বেদনায়।/ফিরে এসে রাজপথে আবার দাঁড়াও,/ভোরের হাওয়ায় বুক ভরে/প্রচ- নিঃশ্বাস টেনে বলো :/‘চমৎকার, কি দুর্দান্ত চমৎকার/এই মনুষ্য জীবন’!

এভাবেই জীবন-জানালায় ক্ষণিক চোখ রেখে মানুষ খুঁজে নেবে বাঁচার প্রেরণা, লড়ে যাবে জীবনের জটিল যুদ্ধ। কবিতা এভাবেই যুগে যুগে সুধারস জুগিয়েছে। সাহিত্যের শারদাকাশে বর্ণিল মেঘ হয়ে বৃষ্টিধারায় সিক্ত করেছে জীবনানলে দাউ দাউ জ্বলতে থাকা মানবমন। জয়তু কবি, জয়তু কবিতা!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //