শামসুর রাহমানের কবিতার-দেশ

স্বতন্ত্রভাবে, ‘বাংলাদেশের কবিতা’ কথাটি বলার পরপরই যাদের নাম সর্বাগ্রে আসে, তাদের মধ্যে প্রধানতম শামসুর রাহমান। সে যে-ই, যে সমস্ত দোষেই, শামসুর রাহমানকে অভিযুক্ত করুন না কেন, বাংলাদেশের কবিতার হিসেব-নিকেশটা শামসুর রাহমান ভিন্ন পুর্ণ করা সম্ভব নয়। তো শামসুর রাহমান এই কাজটা কীভাবে করেছিলেন, যে তাঁকে মনে রাখতে হচ্ছে এবং হবে? হ্যাঁ, তাঁর বিশেষ কবিতা-যাত্রাই তাঁকে বাংলাদেশের কবিতা-জগতে বিশেষ করে রেখেছে। এই মনে রাখা, কিংবা না রাখার হিসেব-নিকেশটাও এই বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত থাকবে।

শামসুর রাহমানের শুরুটা যেভাবে হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তিনি আর কেবল ‘শুরুর’ মধ্যে আবদ্ধ থাকেন নাই। এইটা একজন ভালো লেখকের বড়ো গুণ। কারণ একই জায়গায়, কিংবা একই বৃত্তাবদ্ধ আদর্শের ভিতরে প্রোথিত হয়ে সাহিত্য কিছুটা করা চলে; কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কাজের হিসেবটা ঠিকঠাক চলে না। একই বৃত্তে স্থির থাকার ফলে সাহিত্যিক একটা ‘আটকা জলাধারের’ মতো পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যান। এই পরিস্থিতি যে কোনো প্রতিভাবান লেখককেও শেষ করে দিতে সক্ষম। শামসুর রাহমান সেই খুনটা হন নাই। শেষ হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। এর প্রধান কারণ, সমাজ-সত্যের বিষয়টা শামসুর রাহমান একেবারেই বাতিল করে দেন নাই।

কিন্তু সমাজ-সত্যের হিসেবে তো ‘আধুনিক’ কবিতা একটু ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সেই ‘আধুনিক’ কবিতা লেখার প্রচেষ্টাই সবচেয়ে বেশি পরলক্ষিত হয় শামসুর রাহমানের কবিতায়, প্রথমদিকে। তো এই ‘আধুনিক’ কবিতা হওয়ার জন্য এতো চেষ্টা কেন ছিল এই অঞ্চলের লোকজনের? একটা সাংস্কৃতিক রাজনীতি এই কবিতা-আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। অর্থাৎ ত্রিশের দশকে পূর্ব-বাংলায় তো তেমন কোনো ‘আধুনিক’ কবি পাওয়া যাচ্ছে না। বরঞ্চ এই ‘আধুনিক’ কবিতার বিপরীতে জসীম উদ্দীন কিংবা বন্দে আলী মিয়ার মতো কবিরা তাঁদের ভূগোল-সম্পৃক্ত কবিতা রচনা করছেন। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে এসে নতুন দেশ-প্রাপ্তির পরপরই বোধহয় নতুন ধারার কবিতা লেখার ব্যাপারে এই অঞ্চলের কবিরা বিশেষভাবে সতর্ক হয়েই সক্রিয় হচ্ছেন।

এই সক্রিয়তার হিসেবের ভিতরেই শামসুর রাহমানের কবিতার-দেশের যাত্রা শুরু। নতুন দেশ আর নতুন কবিতার যাত্রা একই সময়ে শুরু হচ্ছে। কিন্তু সেই শুরুটাও আবার দুইভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে। একটা অংশ নতুন দেশ-গঠনের প্রকল্পের সাংস্কৃতিক হিসেবের মধ্যেই কবিতা রচনা করছেন; আর  একটা অংশ ‘পূর্বোক্ত ধারার’ সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে ত্রিশের বাংলা কবিতার হিসেবকে বিবেচনা করেই নতুন করে কবিতা রচনায় হাত দিয়েছেন। শামসুর রাহমান নতুন দেশের সাংষ্কৃতিক-প্রকল্পের হিসেবে দ্বিতীয় ধারার মধ্যে থেকেছেন; এবং তাঁর কবিতার-দেশ নির্মাণে সক্রিয় থেকেছেন।

কিন্তু যেই রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশের ফলে নতুন রাষ্ট্র-নির্মাণ সম্ভব হলো, সেই প্রক্রিয়া কি একেবারেই শামসুর রাহমানের মাথায় ছিল না? নাকি তিনি তা খারিজ করে দিয়েছিলেন? এই ব্যাপারে নানান প্রমাণ রয়েছে যে, শামসুর রাহমানের নতুন রাষ্ট্রের প্রতি আগ্রহ ছিল। এই আগ্রহ সেই সময় প্রায় সকলের ভিতরেই ছিল। এটাই স্বাভাবিক। কারণ সময়টাই ছিল এমন। নতুন রাষ্ট্রের হিসেবটা সেই সময় জরুরি হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সাংস্কৃতিক হিসেবটা ছিল ভিন্ন। ‘আধুনিকায়ন’ থেকে পিছিয়ে পড়ার হিসেবটা যেন এই সময় মিটিয়ে নেওয়ার সময় এসেছিল। আর সেই সুযোগ হাতছাড়া করেননি শামসুর রাহমানও। ফলে সেই প্রভাবে তিনি তাঁর প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে কাব্যগ্রন্থের ‘কাব্যতত্ত’¡ কবিতায় স্পষ্ট করেছেন, ‘লোকে বলে বিজ্ঞজন সহ¯্রচক্ষু, অথচ প্রিয়তমা,/কী আশ্চর্য, কিছুতেই তাঁরা দেখতে পান না/আমার কবিতায় অর্পিত তোমার চুলের ছায়া,/নিঃশ্বাসের সুগন্ধি তাপ, আর আমার হৃৎস্পন্দন।’ আবার বিধ্বস্ত নীলিমা কাব্যের ‘কোথাও পারি না যেতে’ কবিতায় বলছেন, ‘বন্ধুর কামিজ কোর্তা অকাতরে নিজের বলেই/ হামেশা চালিয়ে দিচ্ছি, আমি খাঁটি নবীন যুবক।’

উপরুক্ত দুটো কবিতার মতো প্রথমদিককার কবিতা মূলত শামসুর রাহমান বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত নন্দনতত্ত্বের প্রতিষ্ঠার জন্য লিখেছিলেন। তাঁর ত্রিশের কবিতা ও কবিপ্রীতি এই বিষয়কেই স্পষ্ট করে। কিন্তু সময়ের বদল-প্রক্রিয়া সেই অবস্থায় তো স্থির থাকতে দেয়নি। বদলে গেছে। বিশেষ করে ষাটের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তাঁর কবিতাকে পুরোই বদলে দিয়েছে তা বলা যাবে না, কিন্তু সাময়িকভাবে পরিবর্তন করেছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক উন্মাদনার বিষয়টা শামসুর রাহমান বাতিল করে একই নন্দনতত্ত্বে কেবলই শিল্পের জন্য উকিলগিরি করেননি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁকে ভাবিয়েছে। তাই সেই প্রভাব কাজে লাগিয়ে শামসুর রাহমান কবিতা লিখেছেন। ষাটের বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন তাঁকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। এবং সেই বিষয়সমূহ তিনি কবিতায় ব্যবহার করেছেন। নির্মাণ করেছেন তাঁর কাব্য-বিষয় এবং কাব্য-ভাষা।

কিন্তু এই বিষয়টা যে একেবারেই বয়ান সর্বস্ব কিংবা স্লোগানসর্বস্ব হয়েছে, ব্যাপারটা তা নয়। কেবলই রাজনৈতিক উন্মদনায় বুঁদ হয়েই এই ধারার কবিতা যে শামসুর রাহমান লিখেছেন, ব্যাপারটা এমনও নয়। যথাযথ কাব্যমূল্যের হিসেবটাও তিনি ঠিকঠাক করেছেন। আগেই এই বিষয়ে বলে নেওয়া জরুরি যে, কথাসাহিত্যের বয়ান-প্রকল্প থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কবিতার বয়ান-প্রকল্প। বিষয়টার সাথে পাঠকের পাঠ-অভিজ্ঞতার হিসেবটাও জরুরি বিষয়। অর্থাৎ কবিতা-পাঠের পরপরই যেই অভিজ্ঞতা একজন কবিতা-পাঠক পেয়ে থাকেন তার থেকে ভিন্ন অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে কথাসাহিত্যের পাঠক যান।

অর্থাৎ বোঝাপড়ার ব্যাপারটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তাই কবিতার বয়ান-প্রকল্পের বেলায় যদি তা কথাসাহিত্যের সাথে মিলে যায় তো সেইখানেই কবিতা হওয়া, কিংবা না হওয়ার প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু এই বিষয়টা থেকে উৎরে গেছেন শামসুর রাহমান। ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/ জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/উড়ছে হাওয়ায়, নীলিমায়।’- যখন শামসুর রাহমান নিজবাসভূমে কাব্যগ্রন্থের ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায় এইরকম কাব্যি করেন, তখনই কিন্তু তিনি কেবল ‘সাময়িক উত্তেজনায় বলে যাওয়ার’ বিষয়টা এড়িয়ে প্রকৃত কবিতা তৈরি করেন। আবার ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতাতেও এই বিষয়টাই স্পষ্ট হয়। উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ কাব্যগ্রন্থেও এই সময়-সমাজ-রাজনীতি বিশেষভাবে সম্পৃক্ত থেকেছে; কিন্তু কবিতার হিসেবটা সম্পূর্ণ করে।

কিন্তু প্রথমদিককার ‘আধুনিক’ নন্দনতত্ত্বের প্রতি তাঁর দুর্বলতা একেবারেই মুছে যায়নি। সময়-সমাজ-রাজনীতির প্রভাবে যেমন কবিতা তিনি লিখেছেন, তারই ফাঁকে ফাঁকে তিনি তাঁর প্রথম কবিজীবনের নন্দনতত্ত্বের প্রভাবেও তিনি কবিতা লিখেছেন। অর্থাৎ আশির দশকে তিনি যেমন উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ কাব্যগ্রন্থ রচনা করছেন সময়-সমাজ-রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, তেমনি একই দশকে তিনি ‘আধুনিক’ নন্দনতত্ত্বে অনুসারী হয়ে লিখছেন টেবিলে আপেলগুলো হেসে ওঠের মতো কাব্যগ্রন্থ। এই প্রক্রিয়ায়ই শামসুর রাহমানের কবিতার-দেশ তৈরি হয়েছে। যে কবিতার দেশে সক্রিয় বিষয় হিসেবে নিজের দেশ আর ভূগোল যেমন সম্পৃক্ত থেকেছে, তেমনি করে ‘আধুনিক’ সাহিত্য-নন্দনতত্ত্বও সক্রিয় থেকেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //