প্রাচীন চীনা দর্শন

লাওৎ সু প্রণীত : তাও তে চিং

তাও তে চিং- প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো চৈনিক গ্রন্থ, যার লেখক মনে করা হয়, লাওৎ সুকে। যদিও লাওৎ সু নামের কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র আদৌ ছিল কি-না, সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের ভেতর মতভেদ আছে। এমনকি অনেকে মনে করেন এটি হয়তো একাধিক ব্যক্তির বিভিন্ন সময়ের রচনা সংকলন। তারপরও এটি সাধারণত লাওৎ সুর নামেই পরিচিত।
তাও তে চিং হচ্ছে চীনা দর্শন ও চীনা ধর্মের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। এর ওপর ভিত্তি করেই তাও মতবাদের উৎপত্তি, যা কিনা প্রাচীন চৈনিক সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। প্রাচীন চৈনিক স্থাপত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, ক্যালিওগ্রাফি এমনকি ধর্ম বিশ্বাস ও আচার-আচরণের ওপর তাও তে চিং-এর প্রভাব অপরিসীম। কালের বিচারে এটি গৌতম বৌদ্ধ বা বৌদ্ধদর্শনের সমসাময়িক। তাও তে চিং-এর কনফুসিয়াসের ধর্ম দর্শনের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়। তাও তে চিং কীভাবে লেখা হলো এই নিয়ে একটি চমৎকার গল্প আছে। সেটা শোনা যাক-
এরকম বলা হয় যে, লাওৎ সু ছিলেন তৎকালীন সম্রাটের সরকারি আর্কাইভের কর্মকর্তা। অতি বৃদ্ধ বয়সে তৎকালীন রাষ্ট্র ব্যবস্থার নানা অসংগতি দেখে তিনি নগর ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন; কিন্তু নগরী থেকে বের হবার পথে দ্বার-প্রহরী তাকে নগর ছেড়ে যেতে দিতে অস্বীকার করে। প্রহরীটি দাবি করে যে, লাওৎ সু যদি তার চিন্তা বা উপলব্ধিসমূহ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখে রেখে যান, তাহলে তিনি নগর ত্যাগের অনুমতি পেতে পারেন। এ প্রস্তাবে লাওৎ সু সম্মতি প্রকাশ করেন এবং ওইখানেই তিনি যা লিখে রেখে যান, প্রহরীটির অনুরোধে; তাই পরবর্তীকালে তাও তে চিং নামে পরিচিত। বলা হয়, চীনের পশ্চিম সীমান্তে এই ঘটনাটি ঘটে। অতঃপর দ্বার-রক্ষককে এই পাণ্ডুলিপিটি দিয়ে তিনি হিমালয়ের দিকে চলে যান, এবং তাকে আর কোথাও দেখা যায়নি। তাও তে চিং সম্ভবত পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়া প্রধান চৈনিক গ্রন্থ। চীনা ভাষা থেকে বাংলায় এর প্রথম অনুবাদ হয়েছিল শান্তিনিকেতনের চীনা ভবনে গত শতকের ৬-এর দশকে। তবে আমরা চৈনিক ভাষা না জানায় কয়েকটি ইংরেজি সংস্করণ থেকে বাংলা ভাষান্তরের কাজটি সম্পন্ন করেছি। ইংরেজি সংস্করণের একটির সঙ্গে আরেকটির বৈসাদৃশ্য রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো, যে সময় এই গ্রন্থ লেখা হয়েছিল, তখন চৈনিক ভাষা খুব সুসংবদ্ধ ছিল না। ফলে পরবর্তীকালে এর অনুবাদ করতে গিয়ে আনুবাদকরা বিভিন্ন অর্থ তৈরি করেছেন। তবে আমরা তাও তে চিং অনুবাদ করার সময় বিভিন্ন ইংরেজি সংস্করণ ব্যবহার করার পাশাপাশি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছি বাংলার বাউল দর্শনের ওপর। অনেক ক্ষেত্রেই তাও তে চিং-এর বক্তব্য বাংলায় সহজিয়া দর্শনের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। ফলত বাংলায় ভাষান্তরের সময় বাঙালি পাঠকদের কথা বিবেচনায় রেখে বাংলা লোকায়ত দর্শনের সঙ্গে সুর মেলানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
তাও তে চিং ৮১টি পর্বে বিভক্ত। এগুলোকে কবিতা বলা হলেও ভুল বলা হবে না। ৮১টি তাও কবিতার ভেতর থেকে প্রথম ১২টি এখানে অন্তর্ভুক্ত হলো।

১.
যে ‘তাও’ বলা যায়
সেটা আসলে ‘তাও’ নয়।
যে নাম দেওয়া যায়
সেই নাম ধ্রুব নয়।

অনামের সম্ভাবনাই স্থির সত্য
নাম হলো সমস্ত বিক্ষিপ্ত বস্তুর
সাময়িক ভিত্তি মাত্র।

কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হও, তুমি রহস্য অনুধাবন করবে।
কামনা-বাসনায় বন্দি হলে তুমি কেবল বিভিন্ন উপসর্গ দেখবে।

যদিও রহস্য ও উপসর্গসমূহ
একই উৎসজাত- সেটা হলো আঁধার।

আঁধারের মধ্যে আঁধার
যাবতীয় বোঝাপড়ার প্রবেশপথ।

২.
যখন মানুষ কিছু কিছু বিষয় সুন্দর মনে করে
অন্যগুলো কুৎসিত হয়ে যায়।
যখন মানুষ কিছু কিছু বিষয় ভালো মনে করে
অন্যগুলি খারাপ হয়ে যায়।

অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব একে অপরকে সৃষ্টি করে।
সহজ ও কঠিন একে অপরকে সহায়তা করে।
হ্রস্ব ও দীর্ঘ পরস্পরের আকার দেয়।
নিচু আর উঁচু একে অপরকে নির্ভর করে।
অনুসারী ও অগ্রগামী পরস্পরকে অনুসরণ করে।

সুতরাং সাধু-গুরু কাজ করে কিছু না করে
এবং শেখায় কিছু না বলে।
যখন যা সামনে আসে- সে আসতে দেয়
যখন যা চলে যায়, সে যেতে দেয়।
তার অধিকার করার কিছু নেই
তার প্রত্যাশা করার কিছু নেই- তারপরও সে কাজ করে।

যখন তার কাজ শেষ, সে সেটা ভুলে যায়।
এ কারণে সেটা চিরস্থায়ী হয়।

৩.
তোমরা যদি মহৎ ব্যক্তিকে অধিক গুরুত্ব দাও বা অতি উপরে তোলো,
জনগণ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে।
যদি তোমরা সম্পত্তিকে অতি মূল্যবান করে তোলো,
জনগণ চুরি করতে শুরু করে।

সাধু-গুরু পথ দেখায়
মানুষের মন শূন্য করে।
এভাবে তিনি তাদের আকাঙ্ক্ষা নির্বাপণ করে
তাদের অন্তস্থল পূর্ণ করেন,
তাদের একাগ্রতা দৃঢ় করেন।

যেসব মানুষ মনে করে তারা জানে- তারা কী চায়?
সাধু-গুরু তাদের সাহায্য করে
সব কিছু হারাতে,
যা কিছু তাদের আকাঙ্ক্ষা এবং
যা কিছু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে তাদের মনে।

কিছু না করার চর্চা কর,
সব কিছু স্বস্থানে চলে আসবে।

৪.
‘তাও’ হচ্ছে কুয়ার মতো
যতই নাও শেষ হবে না কখনো।
‘তাও’ অসীম
অশেষ সম্ভাবনায় পূর্ণ।
‘তাও’ অদৃশ্যমান কিন্তু সর্বদা উপস্থিত
আমি জানি না কে এর জন্ম দিয়েছে?

এটা সৃষ্টিকর্তার চেয়ে পুরনো।

৫.
‘তাও’ কোনো পক্ষে যায় না।
এটা সুর এবং অসুর- উভয়ের জন্মদাতা।
সাধু কোনো পক্ষে যায় না।
তার দুয়ার সকলের জন্য উন্মুক্ত।

‘তাও’ হলো আদি ও অন্তহীন
এটা শূন্য- যদিও অসীম সম্ভাবনায় পূর্ণ।
তুমি যত নেবে সে তত দেবে
তুমি যত এটা নিয়ে কথা বলবে তত কম বুঝবে।
সুস্থির হও এবং মূল বিষয়ে মনোযোগ দাও।

৬.
‘তাও’ হচ্ছে মহান জননী
শূন্য তবে সীমাহীন
অসংখ্য ভূম-লের জন্মদাত্রী।

এটা তোমাদের মাঝে সব সময় উপস্থিত।
তোমরা এটাকে যে কোনো ভাবে কাজে লাগাতে পার
যেমন তোমরা চাও।

৭.
‘তাও’ চিরস্বাধীন, চিরজীবী, অসীমে অসীম।
 কেন তাও চিরজীবী?
এর কোনো জন্ম নাই;
তাই এটা মৃত্যুঞ্জয়ী।
 কেন ‘তাও’ চিরস্বাধীন?
এর নিজস্ব কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই।
তাই সবার মধ্যে এটা বিরাজমান।

সাধু-গুরু পেছনে থাকে;
তাই সে অগ্রগামী।
 সে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন;
তাই সে তাদের একজন।
 যেহেতু সে নিজে মুক্ত,
 সে যথাযথ পরিপূর্ণ।

৮.
‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ বিষয়টা জলস্বরূপ,
এটা বিনা চেষ্টায় সবার প্রাণ সঞ্চারণে ভূমিকা রাখে,
এটা স্বাচ্ছন্দ্যে নিচু ভূমিতে অবস্থান করে
ঠিক যেন ‘তাও’-এর মতো।

সাধারণ জীবনযাপন কর
চিন্তায় সহজ-সরল হও।
দ্বন্দ্ব-সংঘাতে উদার আর সৎ হও।
পরিচালনায় অধিকার মুক্ত হও।
কর্মে উপভোগ্য কিছু কর।
সংসার জীবনে সম্পূর্ণত উপস্থিত থাক।

যখন তুমি তোমাতেই সুখী হবে
এবং পারস্পরিক তুলনা অথবা প্রতিযোগিতা বন্ধ করবে,
সবাই তোমাকে শ্রদ্ধা করবে।

৯.
পাত্র পূর্ণ করতে থাকলে
একসময় উপচে পড়ে।
ছুরি-চাকু ধার দিতে থাকলে
একসময় বেঁকে যায়।

অর্থ-কড়ি- নিরাপত্তার পেছনে ছুটলে
 তোমার হৃদয়-মন কখনই তৃপ্ত হবে না।
অন্য লোকের অনুমোদন নিয়ে ব্যস্ত থাকলে
তুমি তাদের কারাবন্দিতে পরিণত হবে।

তুমি তোমার কাজ কর, তারপর সরে আসো।
এটাই শান্তির একমাত্র পথ।

১০.
তুমি কি তোমার মনকে এলোমেলো ভাবনা থেকে মুক্ত করতে এবং মূল কেন্দ্রে একীভূত করতে পার?
তুমি কি তোমার দেহ কাঠামো নমনীয় করতে পার
নবজাতকের মতো?
তুমি কি তোমার অন্তর্দৃষ্টি সেই পর্যন্ত স্বচ্ছ ও স্পষ্ট করতে পার
যখন একটি আলো ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না?
তুমি কি মানুষকে আপন করে নিতে পার এবং
তাদের, তোমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বা স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে
পথ দেখাতে পার?
তুমি কি তোমার ‘উদগ্র বাসনা’র সঙ্গে
একটি পরিণত সমঝোতায় আসতে পার?
তুমি কি নিজস্ব চিন্তাকাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে
সবকিছু অনুধাবন করতে পার?

অধিকার বোধ ও প্রত্যাশার ঊর্ধ্বে থেকে
জন্ম দেওয়া ও পরিচর্যা করা এবং কোনোরকম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে পথ দেখানো-
এটাই সর্বোৎকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য।

১১.
চাকা তৈরি করতে আমরা কিছু স্পোক একসঙ্গে ব্যবহার করি,
কিন্তু চাকার ভেতরের শূন্যস্থানই বাহনকে গতিশীল করে।

কাদামাটি দিয়ে একটা পাত্র তৈরি হয়,
কিন্তু এরে ভতরের শূন্যস্থানই পাত্রটিকে
উপযোগী করে তোলে।

ইট-কাঠ-পাথর দিয়ে আমরা ঘর বানাই,
কিন্তু এর ভেতরের শূন্যস্থানই একে
বসবাসযোগ্য করে তোলে।

অস্তিত্ব নিয়ে আমরা কাজ করি,
কিন্তু যেটা আমাদের প্রকৃত কাজে লাগে- সেটা হলো অনস্তিত্ব।


১২.
যত বর্ণ, তত অন্ধ।
যত শব্দ, তত বধির।
যত স্বাদ, তত বিবস।
যত চিন্তা তত দুর্বলতা।
যত আকাঙ্ক্ষা, তত দীনতা।

সাধু-গুরু সবকিছুই দেখা যায়,
কিন্তু আস্থা রাখে তাঁর অন্তর্দৃষ্টির ওপর।
সে সবকিছুকেই স্বাগত জানায় এবং বিদায় দেয়।
তার হৃদয় আকাশের মতো প্রসারিত।

ভাষান্তর: সারিয়া মাহিমা ও শাওন আকন্দ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //