সাঁওতাল কবি সারদাপ্রসাদ কিস্কু জন্মেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাঁকুড়া জেলার একটি ছোট্ট গ্রামে। পেশায় শিক্ষক এই কবি তাঁর কবিতার মাধ্যমে সাঁওতাল জাতিকে শুনিয়েছেন- জাগরণের গান, মায়ের ভাষায় তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের পুরাতনী ঐতিহ্যকে প্রকাশ করেছেন।
সারদাপ্রসাদ কেবলমাত্র কবিতাতেই থেমে থাকেননি, সাঁওতাল সমাজের নানাবিধ কুপ্রথা এবং অন্ধ বিশ্বাসকে উন্মীলিত করার জন্যও সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। বিহার সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে তিনি নানাভাবে সম্মানিত হয়েছেন, পেয়েছেন বিক্রমশিলা বিদ্যাপীঠ থেকে সম্মানপূর্ণ ‘কবিরত্ন’ উপাধি। সারদাপ্রসাদের সাঁওতালি ভাষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থের নাম- ‘লাহাঃ হর্ রে’ বাংলায় ভাষান্তর করলে যা হয়- ‘এগিয়ে চলার গান’। সাঁওতালদের সমাজের আদর্শ, আধুনিক সাঁওতাল ভাষার এই কবির একগুচ্ছ কবিতা সাম্প্রতিক দেশকালের পাঠকের জন্য ‘লাহাঃ হর্ রে’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ভাষান্তর করেছেন মাসুদুর রহমান।
বড় হওয়া
মৈত্রীর মালা গেঁথে পরি, এসো বন্ধু-
এসো, লোকালয়ে দ্রুত, জনতা সভায়,
হিংসার গাছ এসো, কাটি মূল থেকে।
এসো, হাসি গানে দুলি আনন্দে-ভাই,
সেলাম ভারতবর্ষ।
দেশের পতাকা ওড়াও সকলে ভাই হে-
ঘরে ও বাইরে থাকি সংহত হয়ে।
এসো, শিক্ষা অর্জন করি।
আগুনে পুড়ে না, জলেও ডোবে না-
শিক্ষা এমনই এক সম্পদ।
যেখানেই যাও, পাবে সম্মান-বন্ধু।
মর্মে জ্বালাও প্রজ্ঞার দীপশিখা।
পথ খুলে যাবে, আমেরু-আকাশ,
হবে নমস্য বিদ্যার দীপ্তিতে।
পাহাড়ের ঝর্ণা
পাহাড়ি ঝর্ণা, তুমি ঝরঝর ঝরছ।
কখন থামবে? কখনই-বা নেবে বিশ্রাম?
অবিরাম ঝরা, ঝিরিঝিরি করে?
বইছ প্রকৃতির নিয়মে।
ও ঝরা, ঝর্ণা, ঝরছ নিয়ত উচ্ছ্বল।
নদীরূপে তুমি বহতা।
জীব জন্তুর জীবন ধন্য করে,
নাচতে নাচতে চলেছ উপত্যকায়।
ও ঝরা, ঝর্ণা, তুমি প্রতিদিন ঝরছ।
পাহাড়ের কোলে ঝিকুর ঝিকুর সংগীত।
কত ঔষধির শেকড় বাকড়ে ঋদ্ধ;
চলেছ অবাধ সমুদ্র সন্ধানে।
তুমি প্রতিদিন ঝরছ ও ঝরা, ঝর্ণা
নৃত্য তোমার সঙ্গী।
পাহাড়ি কন্যা নবীন যুগের দিশারি,
তোমার মতো অন্তর পাব কবে-
ওগো চন্দন বর্ণা?
উদ্যোগ
মুখখানা শুকনো কেন?
এসো ভাই উদ্যোগী হও।
সম্পদ মুঠোয় নিয়ে-
যত্নে রাখ তাকে।
যেও না পেছনের দিকে,
দেখে, ওই সুদীর্ঘপথ।
বিশ্বাসই- পৌঁছে দেবে,
ঠিক মতো লক্ষ্যে তোমার।
কাঁটা আছে জেনেও হাত
সরিয়ে নিও না ভুলে।
ফুল তোলা সাঙ্গ হলেই
সাজাবে কানের দুলে।
থামছ কেন কুটতে গুড়ি?
সুকঠিন মাটি চষা?
পাবে না কোথাও তুমি,
দুঃখ বিনা-সুখের দিশা।
জাগরণের গান
ওহে ভাই,
কেন তুমি ঘুমিয়ে আছ?
যুগ যুগ ধরে নির্বোধ-ই থাকবে?
কেন সহ্য করো এত দারিদ্র্য, অত্যাচার?
এখনো থাকবে বালকের মতো?
ওঠো, ওঠো, জাগো- ভাইসকল
নাহলে শুষে নেবে তোমার বুকের রক্ত
কচি পাতায় ভরা সজনে গাছ-হবে শুধু নিষ্পত্র ডাল-
দেখেছো তো, ঢোঁড়া সাপ হয়েছে বিষগোঁখরা।
ঘরের লক্ষ্মী বউ তোমার-
ঝিঁ হয়ে অন্যের ঘর ঝাড়ু দেয়।
জীবনভর এই দুর্গতি দেখেও,
সবটা জেনেও- না জানার ভান কর?
দেখছ না, তোমার সন্তান-সন্ততি ক্ষুধায় কাতর
জীর্ণ তাদের দশা।
তবু,
ঘুম থেকে উঠতে চাও না কেন?
কেন তুমি এখনো নিদ্রালীন?
কোথায় গেল তোমার কেদরা আর বাঁশি?
বাঁশিতে কী লেগেছে উঁইপোকা?
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh