যথেচ্ছ পরিবর্তন থেকে শিক্ষাব্যবস্থার মুক্তি হোক

বাংলাদেশ হচ্ছে সবকিছুর পরীক্ষাকেন্দ্র। এখানে মানবদেহে রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষাকেন্দ্র বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার অগণ্য। দেখে মনে হয় যেন ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে সেবার জন্যই ছেলেমেয়েরা চিকিৎসক হয়ে বের হচ্ছে। এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার আবার খুলে বসে নিজেদের হাসপাতাল ও চেম্বার। কেবল লোভ আর লাভমুখী এই চিকিৎসাব্যবস্থায় সুন্নতে খাতনা করতে গিয়েও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে শিশু। তবু রাষ্ট্র নির্বিকার।

রাস্তাঘাটের পরীক্ষা হচ্ছে সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস ও বছরের পর বছর। নদী ভরাট হচ্ছে, দখল হচ্ছে, বেদখল হচ্ছে, খনন হচ্ছে আবার ভরাট হচ্ছে। সেতু হচ্ছে, ভাঙছে ও গড়ে উঠছে। 

নানা পরীক্ষা হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষ, শব্দের বানান-এমনকি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েও পরীক্ষা। পিএসসি, জেএসসি আসছে আর যাচ্ছে। এসএসসি উঠি উঠি করছে, কিন্তু উঠতে না উঠতেই আবার আসি আসি করলে আশ্চর্যের কিছু থাকবে না। শিক্ষাব্যবস্থা এখন বিতর্ক তৈরির কারখানা।  

প্রতিবছরই সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয় পাঠ্যপুস্তক নিয়ে। কী সমস্যা নেই সেখানে? বানান সমস্যা, বিষয়ের বিভ্রান্তি, ধর্মীয় অনুভূতিতে টোকা, জাতিগত বিতর্ক, বিবর্তনবাদ, শরীফ থেকে শরীফা, কাগজের মান, প্রচ্ছদের ও ভিতরের ছবি, রাজনৈতিকীকরণ-বলে শেষ করা যাবে না। আর এসব এক বছরেই শেষ হয় না, পরের বছর থাকে আরও চমক, এর শেষ নেই। এ কি ভুল না ইচ্ছাকৃত? 

ইচ্ছাকৃত বলা যাবে না! ভুলই-লাভজনক ভুল, যে বা যারা ভুল করছেন তাদের লাভের শেষ নেই। জবাবদিহিতার বালাই নেই। যত ভুল, তত ব্যবসা, তত লাভ। ব্যবসা বই রচনায়, সংশোধনে, ছাপানোয়, বাতিল করে পুনর্মুদ্রণে, সরবরাহে ও আরও কত উপায়ে। গত বছর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুটি বইয়ে ভুলের কারণে নষ্ট হয়েছে ৭৮ লাখ বই ও অপচয় হয়েছে নাকি ২৩ কোটি টাকা। সরকারের টাকা, কার কী বলার আছে? 

আর প্রতিবছর বিতর্কের যে ঝড় ওঠে তার জন্য প্রধানত নিন্দুকেরাই তো দায়ী। একবার ভেবে দেখুন সমাজটা নিন্দুকমুক্ত হলে মানুষ কত সুখে ও শান্তিতে বাস করতে পারত। আমাদের দেশে নিন্দুকেরা ওত পেতে বসে থাকে। পাঠ্যপুস্তক ছাপা হতে না হতেই তারা শুরু করে নিন্দার ঝড়! প্রশ্ন হচ্ছে যারা পাঠ্যপুস্তক বানান তারা কি নিন্দুকদের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুই জানেন না? সম্পূর্ণ মিথ্যার ওপর তো ভালো নিন্দাকর্ম দাঁড়ায় না। কে তাদের হাতে সেই সামান্য সত্যের ক্ষুরধার আস্ত্রটি তুলে দেয়? কে তাদের হাতে তিল তুলে দেয় তাল বানানোর জন্য? সে কি ভুল করে, না কোনো রহস্য আছে এখানেও?     

পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর সময় থেকেই যদি সাধারণ মানুষের সঙ্গে সময় নিয়ে আলোচনা করা যেত তাহলে নিন্দুকের অস্ত্র একেবারেই অকার্যকর হয়ে যেত। অথচ পরম গণতান্ত্রিক একটি দেশে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোনো কথাবার্তা ছাড়াই তারা পাল্টে ও ইচ্ছেমতো সব ঢুকিয়ে দেন।  

ধরা যাক ষষ্ঠ শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইতে ‘বয়ঃসন্ধি’ বিষয় ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ‘শরীফ থেকে শরীফা’ হওয়ার কথা। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ ‘শিক্ষার্থীকল্যাণ ও নির্দেশনা’ শীর্ষক ২২ অধ্যায়ে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে চমৎকারভাবে বলা হয়েছে: ‘নারীপুরুষ, জাতিসত্তা, আর্থ-সামাজিক অবস্থান, শারীরিক-মানসিক সীমাবদ্ধতা নির্বিশেষে সবাই পূর্ণ মানবাধিকার সম্পন্ন মানুষ, এই বোধ শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে উজ্জীবিত করা। শিক্ষার সকল পর্যায়ের পাঠক্রমে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করা।’ মহৎ শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তো এমনই হওয়া উচিত। 

তবে ‘নারীশিক্ষা’ শীর্ষক আগের ১৬ অধ্যায়ে বলা আছে ‘মাধ্যমিক স্তরের শেষের দু বছরের পাঠ্যক্রমে “জেন্ডার স্টাডিজ” এবং প্রজনন-স্বাস্থ্য (reproductive health) অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’ শিক্ষানীতির এই বক্তব্য নিয়ে কেউ তো কোনো কথা বলেনি। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠক্রম নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিক্ষানীতিকেই কি মান্য করা প্রয়োজন ছিল না? শিক্ষানীতি অনুযায়ী আর দুয়েক বছর অপেক্ষা করলে শিক্ষার্থীরা কোনো মহাক্ষতির সম্মুখীন হতো না, বরং নিন্দুকদের মুখে তখন কুলুপ পড়ত। 

কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কল্যাণচিন্তায় জগতের সব কল্যাণকর বস্তুই হাতে গোনা কয়েকখানা পাঠ্যপুস্তকে ঠেসে ঢুকিয়ে দিতে হবে কী কারণে? খাবার দিতে না পেরে শিশুকে খাবারের গল্প শোনালেই কি তার ক্ষুধা মিটবে? শিশু শারীরিক-মানসিক নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হবে, এটা স্বাভাবিক। এসব মোকাবিলার জন্য শিক্ষানীতিতে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা বলা আছে। যেমন- শিক্ষার্থী কল্যাণ এবং উপদেশ-সেবা সকল শিক্ষা স্তরে চালু করা, সর্বস্তরের শিক্ষক উপদেষ্টাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দান, প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চালু করা, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নতমানের স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। এগুলো কই আর কবেই বা হবে? শিক্ষা খাতে ব্যয় জীবনভর জিডিপির ২ শতাংশের আশপাশে রেখে এসব কথার ফুলঝুরি মাত্র। অতএব পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান বইয়ের পাতায় ঠেসে ঠেসে ঢুকিয়ে দিতে হবে! উপায় নেই।

লিখতে গেলে কাটাকাটি হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু যে ছেলে খাতায় একপাতা লিখতে বসে এই কাটছে এই লিখছে -এই করে করে খাতাই শেষ করে ফেলছে, বুঝতে হবে তার পরীক্ষার প্রস্তুতি নেই ও বিষয় সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। আমাদের পাঠ্যপুস্তক ও কারিকুলাম নিয়ে এই যে কাটাকাটি কর্ম চলছে এ থেকে আমরা কী বুঝতে পারি? যাদের ঘাড়ে শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্ব তাদের আরও দায়িত্ববান হওয়া প্রয়োজন। আর বই রচয়িতা, ছাপাওয়ালা ও অন্যদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে সবার আগে শিক্ষার্থীদের স্বার্থের কথাই বিবেচনায় রাখতে হবে।   

আলমগীর খান
সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //