ফিরে দেখা বায়ান্ন

আমরা বেশিরভাগ সময়ই ইতিহাস চর্চা করি ভাবাবেগতাড়িত হয়ে। বাঙালির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসও আমরা চর্চা করার প্রয়াস পাই ভাবাবেগ তাড়িত হয়ে। যে কারণে আমাদের ইতিহাস চর্চা বস্তুনিষ্ঠ হয়ে ওঠে না। এটি একটি জাতির কাঙ্ক্ষিত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথে এক বড় ঘাটতি। সেই প্রেক্ষাপটেই এই লেখার অবতারণা। 

বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা দাবি করেন, ৫২-র রক্তক্ষয়ী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির স্বাধীনতার লড়াইয়ের ‘প্রথম বিস্ফোরণ’। বাস্তব ইতিহাসের আলোকে এটি ভাবাবেগের কথা। বাস্তব কথা হলো, বাঙালিরা উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিল এ কারণে যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা থেকে বাংলাকে বাদ দিলে, বাঙালিদের ভালোভাবে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার অবলম্বন আয়-রোজগারে সংকট সৃষ্টি হবে। আবার রাজনৈতিকভাবে ৫২-র রাষ্ট্রভাষা যদি স্বাধীনতার আন্দোলন হতো, তাহলে ৬৫-তে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহকে জেতানোর জন্য আমরা বাঙালিরা ডান-বাম সবাই মিলে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছিলাম কেন? আর ৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতায়ই বা যেতে চেয়েছিলাম কেন? এ রকম আরও প্রশ্ন তোলা যায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা এসব প্রশ্নের যেসব ব্যাখ্যা দেন তা ভাবাবেগতাড়িত। যে কারণে তারা সচরাচর ৫২-র আন্দোলনকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন না বলে, বলেন ভাষা আন্দোলন। যা হোক, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছিলাম তখনকার পাকিস্তানকে আমাদের রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিয়েই।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বাঙালির দাবি ছিল, রাষ্ট্রভাষা উর্দুর সুযোগ নিয়ে পশ্চিমারা একচেটিয়াভাবে রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা পুরোটাই ভোগ করবে তা হবে না। বাঙালিদেরকেও সমান সুযোগ দিতে হবে। এটি শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে নয়, ইঙ্গ-ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ স্বাধীনতার লড়াই-সংগ্রামে পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে বাঙালিদের অবদান বেশি ছিল, এ কারণেও। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে। ছিল ব্রিটিশ শাসনের ২০০ বছরের হা-ভাতে বাঙালির ‘ভাত-কাপড়ে’র, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, জ্ঞান ও বিজ্ঞানে বিকশিত হওয়ার লড়াই। 

রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনে বিজয় অর্জিত হয়েছিল। অতঃপর উর্দুর সঙ্গে বাংলাও যখন রাষ্ট্রভাষা হলো, তখন ‘আ মরি বাংলা ভাষা’র কী দশা হলো? বাংলাকে কাগজে-কলমে রাষ্ট্রভাষা রেখে কর্মক্ষেত্রে আমরা ইংরেজিকে ‘রাষ্ট্রভাষা’ বানিয়ে ফেললাম। অভিজাত শ্রেণির চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বৈষয়িক স্বার্থে ইংরেজিকে অঘোষিত ‘রাষ্ট্রভাষা’ করে, ব্রিটিশদের ভাষা উপনিবেশকে আমরা হালাল করে নিলাম। ‘স্বাধীনতা’র চেতনা হিসেবে বাংলা ভাষা মহিমময় হয়ে থাকল শুধু‘দুঃখিনী বর্ণমালা’ আর ‘আ মরি বাংলা ভাষা’র কোরাসের মধ্যে। এটি কোনো অতিরঞ্জিত কথা নয়। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও অবস্থার কোনো আমূল পরিবর্তন ঘটেনি। পরিবর্তন না ঘটার কারণ, আমরা শুধু ভাষার অর্থ বুঝেছি, রাষ্ট্রভাষার অর্থ বুঝিনি। এমনকি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরও বুঝিনি। 

‘হুজুগে বাঙ্গাল’ কথাটি সর্বৈব সত্য। পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরে বাঙালির মহাবিপর্যয়ের কারণ ছিল, বাংলার কৃষকদের উৎপাদিত স্বর্ণতন্তু পাট পশ্চিমা লুটেরাদের কাছে বে-হাত হয়ে যাওয়া। সেটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বে-হাত হওয়ার চেয়েও বড় বিপর্যয়। ওই সময়গুলোতে হতদরিদ্র বাঙালি কৃষকদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদিত পাট রপ্তানি করে অর্জিত হাজার হাজার (বর্তমান মূল্যে লাখ লাখ) কোটি টাকা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে উঠেছিল শত শত শিল্পকারখানা ও অবকাঠামো। পাঞ্জাবের মরু অঞ্চল পরিণত হয়েছিল শস্য-শ্যামল। অথচ জনসংখ্যার অনুপাতে পাট রপ্তানির টাকায় বাঙালির হিস্যা ছিল পশ্চিমাদের চেয়ে বেশি। একবার চিন্তা করুন, পাট রপ্তানির টাকার ন্যায্য হিস্যা যদি বাঙালিরা পেত, তাহলে ২৪ বছরে পূর্ববাঙলার চেহারা এমনই পাল্টে যেত যে, ৭১-এ সম্ভবত পশ্চিমারাই বাঙালিদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের আওয়াজ তুলত। এটিও কোনো অতিরঞ্জিত কথা নয়। পূর্ববাঙলার কৃষকরাও তখন পাটের ন্যায্যমূল্য পেলে, একদিকে পাটের উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেত, অন্যদিকে পাট রপ্তানি করে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণও দ্বিগুণ বেড়ে যেত। পাট রপ্তানির বৈদেশিক মুদ্রার ন্যায্য হিস্যা পেলে পূর্ববাঙলা আক্ষরিক অর্থেই সোনার বাংলায় রূপান্তর হতো।

অথচ সেই পাট নিয়ে আন্দোলন করে বুকের রক্ত দেওয়া তো দূরের কথা, বলতে গেলে ২৪ বছরেও পাট নিয়ে একদিনের জন্যও দেশব্যাপী বড় কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে ওঠেনি। কৃষকের নয়নমণি, আসাম-ডিবরোগড়ের বড় বড় কৃষক বিদ্রোহের পোড় খাওয়া নেতা মওলানা ভাসানী এবং বিপ্লবী কৃষক বন্ধু আব্দুল হকের মতো বড় নেতা থাকতেও, পাট নিয়ে আমরা বিশাল বড় কোনো কৃষকবিদ্রোহ ঘটাতে পারিনি। আমরা তখন আন্দোলন করেছি-‘ইয়া আজাদী-ঝুটা হ্যায়’, ‘সাতচল্লিশ-মহাপাপ’ ইত্যাদি স্লোগান মুখে নিয়ে। কৃষকদের কাছে আমরা যে রাজনীতি নিয়ে গিয়েছি, সেটি ছিল সাতচল্লিশের ‘পাপমোচনের’ রাজনীতি। পরে যে বিপ্লবী রাজনীতি নিয়ে কৃষকদের কাছে গিয়েছি, সেটি ছিল শ্রেণিসংগ্রামের রাজনীতি। কৃষকদের দিয়ে ধনী ও মাঝারি কৃষক হত্যার রাজনীতি। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাতচল্লিশের দেশভাগ অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও, পূর্ববাঙলায় ব্যতিক্রমিকভাবে ঘটে গিয়েছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। দেশভাগের পর পূর্ববাঙলার সামন্ত-জমিদাররা ভারতে চলে যাওয়ার ফলে, পূর্ববাঙলায় জমিদারের দাস-প্রজা কৃষকরা জমির মালিক হয়ে স্বাধীন কৃষক হয়ে গিয়েছিল। শ্রেণিসংগ্রাম ছাড়াই ভূখণ্ডে তখন এক নজিরবিহীন নীরব ভূমিবিপ্লব ঘটে গিয়েছিল। আবারও বলছি, কতই না বে-কুব ছিলাম আমরা, সাতচল্লিশের পরপরই সেই কৃষকদের কাছে আমরা গিয়েছি কিন্তু পূর্ববাঙলার ৮০ ভাগ কৃষকের জন্য সেটি যে ‘পুণ্যপ্রাপ্তি’ ঘটেছিল, এই বিশেষ অবস্থার বিশেষ রাজনীতিটা আমরা বুঝিনি। কৃষকরা তখন কী করল? তারা স্বাধীন কৃষক হিসেবে নতুন প্রাণশক্তি ফিরে পেয়ে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে কৃষিকাজে মনোনিবেশ করল। 

তারপর কী হলো? ২০০ বছরের জমিদারের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে কৃষকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পাট উৎপাদন করে, জীবনে এই প্রথম ভাগ্য-পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। কিন্তু অচিরেই তাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। পাটের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে পাট হয়ে উঠল কৃষকের গলার কাঁটা। আর পানির দরের সেই পাট রপ্তানির টাকা নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান যখন সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠল, বাংলার প্রায় ৭ কোটি কৃষক 

তখন হয়তোবা কোনোমতে দুমুঠো ভাত খেতে পারল, কিন্তু পরনে ছিন্নবস্ত্র। অর্থনৈতিকভাবে চরম দুরবস্থা তাদের।

ওই সময়গুলোতে পাপমোচনের রাজনীতির পরিবর্তে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি পাটকে কেন্দ্র করে ৭ কোটি বিক্ষুব্ধ কৃষকদের সংগঠিত করে যে বিশাল বড় কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলা যেত, সেটি হতো উপমহাদেশ কাঁপানো সবচেয়ে বড় কৃষকবিদ্রোহ। এমনকি সেই আন্দোলনে কৃষকরা যদি কয়েক বছরের জন্য পাট উৎপাদন বন্ধ করে দিত, তাহলে কৃষকরা না খেয়ে মরত না। এর ফলে পাট রপ্তানির বদৌলতে পশ্চিমাদের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার বাহাদুরি মুখ থুবড়ে পড়ত। আর তখন আন্দোলন লড়াইয়ের মাধ্যমে যেমন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি পূরণ হয়েছিল, তেমনি পাটের ন্যয্য হিস্যাও আদায় করা সম্ভব হতো। পাট রপ্তানির মাধ্যমে পাওয়া সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার ন্যায্য হিস্যা পেলে, ২৪ বছরে কৃষি, শিল্প, অর্থনীতি এবং শিক্ষা-দীক্ষায় সমৃদ্ধিশালী পূর্ববাঙলা তখন পশ্চিম পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যেত। ঢাকা তখন দ্বিতীয় রাজধানী না হয়ে, প্রথম রাজধানী হতো। এবং সেটি হতে পারত রিজিওনাল সম্প্রসারণবাদী শক্তির ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের কোনো সুযোগ না দিয়েই।

এখন কথা হলো, বর্তমান সমীক্ষায় ৭০ বছর আগের বায়ান্নকে ফিরে দেখার মধ্য দিয়ে এ ভূখণ্ডের ইতিহাসকে আমরা যেভাবে মূল্যায়নের প্রয়াস পেয়েছি, বাস্তবে ইতিহাস সেভাবে অগ্রসর না হয়ে, অন্যভাবে অগ্রসর হয়েছে। বিকল্প চিত্র নিয়ে এই লেখায় আমরা যে বাস্তবতার কথা বলেছি, ইতিহাস সেই দিকে ধাবিত হলে তার বাস্তব রূপ কী হতো, তারও একটা বিশ্বাসযোগ্য চিত্র আমরা তুলে ধরেছি। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদেরকে এমনভাবে পোষ মানিয়ে রেখেছে যে, সমাজের বিদগ্ধজনের কাছেও অতীতের এই চিত্রকল্প হয়তো পাগলের প্রলাপ বলেই মনে হবে। এও জানি, অতীত আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। বর্তমানই সার। তাহলে কঠিন বাস্তবতাকে আমরা কীভাবে অতিক্রম করতে পারি সেদিকে মনোযোগী হওয়াই এখন প্রধান কাজ।

রইসউদ্দিন আরিফ
লেখক ও গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //