মুর্শিদাবাদের গ্রামে আমার ছেলেবেলার রোজা ও ঈদ উৎসব

ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসবের একটি ঈদুল ফিতর। ‘ঈদ’ আরবি শব্দ, এর অর্থ উৎসব বা আনন্দ। ‘ফিতর’ অর্থ বিদীর্ণ করা, উপবাস ভঙ্গ করা বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া। ইসলামিক ক্যালেন্ডারের নবম মাস হলো রমজান। অত্যন্ত পবিত্র এই মাস মুসলমানদের কাছে। মাসব্যাপী সিয়াম ও সংযম পালনের পর আসে পরবর্তী শাওয়াল মাসের পহেলা তারিখ। ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলমানদের স্বাভাবিক কর্মজীবন শুরু করার দিনটিতেই পালিত হয় ঈদ-উল-ফিতর। ঈদ-উল-ফিতর আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ এক উপহার, যার মাধ্যমে আল্লাহ তার বান্দাকে ক্ষমা করেন এবং বান্দা তার রবের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করেন।

প্রশ্ন জাগতে পারে, ইতিহাসে ঈদের প্রবর্তন কবে থেকে? ‘বেশিরভাগ আলেমের মতে, দ্বিতীয় হিজরিতে তার বিধান প্রবর্তিত হয়। মুসলমানরা মদিনায় প্রথম ঈদুল ফিতরের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় হিজরি মোতাবেক ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ বা ৩১ মার্চে। মহানবী (সা.) ঈদের দিন ছোট বড় সবার আনন্দের প্রতি খেয়াল করতেন। মদিনায় ছোট ছোট শিশু কিশোরদের সঙ্গে বিশ্বনবী (সা.) আনন্দ করতেন। শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত সব আনন্দ করার অনুমতি দিতেন। ঈদের নামাজকে নবীজি (সা.) এতটাই গুরুত্ব দিতেন যে, ইসলামের শুরুর যুগে নারী ও শিশুদেরও ঈদগাহে নিয়ে যাওয়া হতো; এমনকি ঋতুমতী নারীও ঈদগাহে উপস্থিত হয়ে একপাশে অবস্থান করত।’ অমাবস্যা তিথির পর পশ্চিম আকাশে এক ফালি বাঁকা চাঁদ দেখার পরদিন থেকেই শুরু হয় এক মাসব্যাপী রমজান। সারা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে এই মাসে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য প্রভৃতি রিপু থেকে নিজেকে দূরে রাখার সাধনা চলে। রমজান শেষে পরদিন, ঈদুল ফিতর উৎসব পালিত হয় জামাতে  দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে। গরিব-দুঃখী মানুষের মধ্যে, সক্ষম রোজাদাররা ফিতরা বা সাহায্য বিতরণ করে চলে মাসব্যাপী, ঈদুল ফিতর উৎসবের আগে এই মাসের বিশেষ তাৎপর্য এটা। উল্লেখ্য, প্রতিটি সামর্থ্যবান মুসলমানের ফিতরা দেওয়া আবশ্যিক। ফিতরা ছাড়াও গরিব, অসহায় মানুষদেরকে এই সঙ্গে সাধ্যমতো খাবার ও কাপড়-চোপড় ইত্যাদি দান করে থাকেন অনেক মুসলমান। জাকাত এই মাসের একটি বিশেষ অঙ্গ। জাকাত একটি আরবি শব্দ, এর অর্থ ‘যা পরিশুদ্ধ করে’। ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভ হচ্ছে এই জাকাত। প্রত্যেক স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলমান নরনারীর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ, যদি তা ইসলামি শরিয়ত নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে তবে অবশ্যই গরিব-দুস্থদের মধ্যে জাকাত বিতরণ করতে হবে। 

গ্রামবাংলার এখন যে চাকচিক্যময় চেহারা তা আমার ছেলেবেলার গ্রামের চেয়ে শত যোজন দূরে। বিশ শতকের ছয়ের দশক থেকে আমার ছেলেবেলা থেকে কৈশোর কেটেছে এক অজ পাড়াগাঁয়ে। মুর্শিদাবাদের এই গ্রামটি জেলাসদর শহর বহরমপুর থেকে প্রায় ২০-২২ কিমি দূরে। গ্রামের ছেলে-মেয়েদের সবার মধ্যে লেখাপড়া করার তেমনভাবে চল ছিল না সে সময়ে। শিক্ষার গুরুত্ব বোঝার ক্ষমতাও তখন অত ছিল না সেখানকার মানুষের মধ্যে। শিক্ষাকেন্দ্র বলতে ছিল একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর কোনো উচ্চ বিদ্যালয়ও ছিল না গ্রামটিতে। সে সময়ে কম বেশি সব গ্রামের অবস্থাই ছিল একই রকম।

গ্রামের অবস্থা যা-ই হোক না কেন, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ব্যাপারে মানুষেরা ছিল বেশ সজাগ; ইসলাম ধর্মীয় মানুষের সংখ্যাধিক্য ছিল আমার গ্রামে। রমজান মাসে বাড়ির বড়দের সঙ্গে সঙ্গে ছোটরাও রোজা করতাম আমরা সবাই। সারা গ্রামের ছোট ছোট ছেলেদের মধ্যে চল ছিল রোজা রাখার। ছোটরা অনেক সময় রোজাকে  ইফতার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারত না; সে ভুল করেই হোক বা ইচ্ছাকৃতভাবেই হোক কিছু খেয়ে রোজা ভেঙে ফেলত। রমজান  মাসব্যাপী সন্ধ্যা থেকে সারা রাত ধরে গ্রামময় থাকত উৎসবের আমেজ। প্রতিটি বাড়ির মেয়েরা একরকম রাত জেগে কাটাত, পাছে ঘুমালে আর ঘুম না ভাঙে। কারন তাদের সেহরির জন্য ভাত, তরকারি রাঁধতে হতো; জ্বালানি হিসেবে প্রতিটি ঘরে পাটকাঠি দিয়ে মাটির উনুনে চলত রান্না। পাটকাঠির আগুনের আলোয় আলোকিত হয়ে পড়ত পাড়াময়।

গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষিনির্ভর কৃষক; সেহরি শেষে  তাই যে যার কৃষি কাজ নিয়ে চলে যেতে হতো মাঠে, এর কোনো ব্যত্যয় হতে দেখিনি। বাড়ির সব মেয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকত রান্না-বান্না ছাড়া দৈনন্দিন অন্য সমস্ত কাজে। পুরো রমজান মাস গ্রামের মসজিদে নামাজ পড়ার ধুম পড়তে দেখা যেত অন্য সময়ের চেয়ে। মেয়েরাও বাড়িতে প্রতি ওয়াক্তের নামাজ আদায় করার সঙ্গে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করত নিত্যদিন। আসরের নামাজ আদায় করার আগে থেকে চলত ইফতারির প্রস্তুতি। যেন প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর কাজ। ইফতার করা বা মুখে পানি দেওয়া হতো আদাকুচিতে লবণ মাখিয়ে, এর মধ্য দিয়েই শেষ হতো রোজা ভাঙা। কিছুটা ছোলার ডাল ভেজানো আখের গুড় সহযোগে এবারে  খাওয়া। ইফতার শব্দটি গ্রামের মানুষের কাছে শুনিনি, ‘মুখে পানি দেওয়া’ বাক্যটির সঙ্গে  আমরা পরিচিত ছিলাম সবাই। এখনকার মতো খেজুর বা অন্যান্য ফল ছিল না ইফতারের তালিকায়। তবে অনেক সময় ইফতারির পরে রুটির সঙ্গে থাকত জিলাপি। আমাদের বাড়ি অঞ্চলে ইফতারে মুড়ি খাওয়ার প্রচলন ছিল না। গ্রামের ইফতারের সঙ্গে বর্তমান শহরের ইফতারের ফারাক ঘুচে গেছে। গ্রামেও এখন খেজুর ও অন্যান্য ফল, পেঁয়াজু ইফতারিতে আবশ্যক। এগুলো সম্ভব হয়েছে, গ্রামের রাস্তাঘাট, যানবাহনের ব্যবস্থা সবেতে উন্নয়নের জন্য। সঠিক সময়ে ইফতারি করা নিয়ে আমার গ্রামে বেশ ধন্দে থাকতে দেখেছি, প্রায় দিনই। মসজিদে কোনো মাইকের ব্যবস্থা যেমন ওই সময়ে ছিল না তেমনি ব্যাপক মানুষের কাছে বা বাড়িতে ঘড়িও ছিল না। অনেকে আবার বাড়িতে মুরগি যখন খুললায় (মুরগির ঘর) ঢোকে সে সময়টাকে ধরত ইফতারির সময় হিসেবে। সঠিক সময়টায় কোনো কোনো গ্রামে পটকা ফাটিয়ে সময় জানান দেবার ব্যবস্থাও থাকত। মেঘলা দিনে ইফতারি করা নিয়ে সমস্যা ছিল বেশ। রমজান মাস শেষ হয়েও শেষ না হতে দেখেছি কয়েকবার। শাওয়ালের চাঁদ ওঠা বা দেখা নিয়ে যে বারে মতপার্থক্য হয়েছে সে সময়ে ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে আগের দিন ও পরদিন ঈদের নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রতিবছর ঈদের তারিখ পাল্টায়, কারণ চাঁদের গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী পাল্টে যায় ক্যালেন্ডার। আজকের মতো তখন ডিজিটাল যুগ শুরু হয়নি; এমনকি রেডিও-ও আসেনি ছ’য়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমাদের গ্রামে। আকাশে শাওয়ালের চাঁদ দেখার জন্য বাড়ির ছাদে অথবা কেউ কেউ উঁচু গাছেও উঠে যেত; চাঁদ দেখা গেলে দল বেঁধে মারহাবা, মারহাবা চিৎকারে পাড়া প্রদক্ষিণ করত ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল। ঈদের দিন ভোর থেকে আনন্দের ফোয়ারা বয়ে যেত ছোট-বড় সবার মধ্যে। নতুন জামা-কাপড় প্রতি ঈদে জুটত এমন নয়; আজকের মতো রেডিমেড জামা কাপড়ের যুগও ছিল না। রোজা শুরুর সময়ে সামর্থ্যবানদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যেত খলিফা (দর্জি) ঈদের নতুন জামা-কাপড়ের মাপ নেওয়ার জন্য; দেরিতে হলে তারা আর নতুনভাবে অর্ডার নিতে পারতেন না। দর্জিও ছিল সংখ্যায় কম, তারা গ্রামে এসে অর্ডার নিয়ে যেতেন মফস্বল কোনো ছোট হাট-বাজার থেকে। সারা মাস ধরে সেলাই মেশিনের ঘর্ঘর আওয়াজ চলত দর্জি বাড়িতে। বিশেষত পাটের মৌসুমে গ্রামে ঈদ উৎসব অনুষ্ঠিত হলে সবার নতুন জামা- কাপড়, জুতো সবই হতো। কৃষিনির্ভর পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েদেরও প্রতি ঈদে নতুন জামা, জুতো ভাগ্যে জুটতো না! ঈদের সকালে খাবারের তালিকায় অবশ্যই থাকত বাড়িতে তৈরি সেমাই, চালের আটার তৈরি রুটি ও মাংস। ঈদগাহে দল বেঁধে যেতাম, কানে আতর ভেজা তুলো গুঁজে নামাজে, পাড়ার সবাই উপস্থিত না হলে ইমাম সাহেব দেরি করতেন নামাজ শুরু করতে, সময়ের কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না তেমনভাবে, একবার শেষ বারের মতো দেখে নিশ্চিত হয়েই নামাজ শুরু করতেন। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব এই দিনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতেন। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আনন্দ উচ্ছ্বাসে তা আর শোনা যেত না। একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি হতো নামাজ শেষে। ঈদগাহ থেকে ফিরে ছোটদের সারাদিন শুধু এ বাড়ি ও বাড়ি ঘোরাঘুরি, আর প্রতি বাড়িতে কিছু না কিছু খাওয়া-দাওয়া ছিল অপরিহার্য। এভাবেই শেষ হতো ঈদের অনুষ্ঠান।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //