কৈশোরের এক ঈদের স্মৃতিকথন

সব মানুষের জীবনে সর্বাধিক স্মৃতিময় স্মরণীয় কালটি কিশোরকাল। কিশোরকালের স্মৃতি আমৃত্যু স্মরণে থাকে, কখনো মুছে যায় না। সেই স্মৃতি প্রত্যেককে কৈশোরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। স্মৃতি রোমন্থনে একমাত্র কিশোরকালের স্মৃতিচারণ সবাই নির্ভুলভাবে করতে পারে। যৌবনের কিংবা পরবর্তী জীবনের স্মৃতি সহজেই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। প্রতিটি মানুষের আনন্দপূর্ণ স্মরণীয় স্মৃতিমাত্রই কিশোরকাল। কিশোরকালের নির্মল আনন্দের সঙ্গে জীবনের অপর কোনো অংশের আনন্দ মেলানো যায় না। 

আমার কিশোরকালের রোজা ও ঈদ উদযাপনের স্মৃতি রয়েছে, চট্টগ্রামের উত্তর সলিমপুর গ্রামকে ঘিরে। কত যুগ পূর্বের সেই স্মৃতি আজও অমলিন। পিতার কর্মসূত্রে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বহুপূর্বে পুরো পরিবার রোজা ও ঈদ উদযাপনের জন্য এক মাসেরও অধিক সময় ছিলাম চট্টগ্রামে। ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে গ্রিনঅ্যারো ট্রেন যোগে সকাল ১০টায় যাত্রা শুরু করে রাত প্রায় সাড়ে দশটায় চট্টগ্রামের বটতলী স্টেশনে পৌঁছেছিলাম। তখন ছিল শীতকাল। বটতলী স্টেশন থেকে বেবিট্যাক্সিতে ফৌজদার হাটস্থ বাড়িতে পৌঁছেছিলাম রাত ১২টা নাগাদ। শীতের নিঝুম রাতে আমাদের ঘাটায় (বাড়ির বহিরাঙ্গের উঠোন) ট্যাক্সি পৌঁছামাত্র ট্যাক্সির শব্দে বাড়িসুদ্ধ সবাই জেগে এসে আমাদের উষ্ণ ভালোবাসায়-অনাবিল আন্তরিকতায় বরণ করে নেয়। পা ছুঁয়ে সালাম করতে করতে নাভিশ্বাস ঠেকেছিল। সেই আন্তরিক অভিব্যক্তিময় স্মৃতি ভোলার নয়। ক্রমেই সেই অভিব্যক্তিময় নির্মল আন্তরিকতা এখন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আমাদের যারা প্রচণ্ড ভালোবাসতেন তাদের সবাই একে একে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাদের ভালোবাসার অভাব-শূন্যতা এ জীবনে আর পূরণ হওয়ার নয়। জীবনের এই নির্মম বাস্তবতা নানা অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বুঝেছি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কম-বেশি সবার মন-মানসিকতাও বদলে গেছে। সামষ্টিক ভাবনা পরিত্যাগে প্রত্যেকেই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার অভিমুখে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার যুগে সামষ্টিক ভাবনার চেতনা আর কারও মধ্যে নেই।

প্রথম রোজা থেকে রোজার মাসজুড়ে আমাদের সব ভাই-বোনের মধ্যে রোজা রাখার প্রতিযোগিতা ছিল। কে কার চেয়ে অধিক রোজা রাখতে পেরেছে, এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হতো। রোজায় সবারই স্কুল বন্ধ থাকায় মাসজুড়ে আনন্দ-ফুর্তিতে সময়গুলো কেটেছিল। সমুদ্র তীরবর্তী বিস্তীর্ণ বালিতে দিনে ফুটবল ও চাঁদনি রাতে জমিতে সীমানা এঁকে দাঁড়িায়াবান্ধা স্থানীয় পড়ো খেলা। ঘুড়ি ওড়ানো হতে নানা খেলায় দিনমান কাটিয়ে দিতাম। মনে পড়ে, সেহরির সময় বাড়ির ঘাটার দুয়ারে কেরোসিনের হারিকেন হাতে দেড় বাজা, দো বাজা, তিন বাজা বলে চিৎকার করে রোজাদারদের ঘুম থেকে জাগাতে আসতো কতিপয় কিশোর। সেহরির খাবার খেয়ে কেউ সহজে ঘুমুতে যেতে চাইতাম না। আড্ডা, খুনসুটিতে মেতে পড়তাম। অভিভাবকদের নির্দেশে নিরুপায় হয়ে এক এক করে ঘুমুতে যেতাম। যত রাতেই ঘুমানো হোক; সকালে ঘুম থেকে ওঠার চর্চা ছিল সবার। আমাদের নিঃসন্তান দাদা-দাদি, যাদের আমরা সোনার দাদা ও সোনার দাদি বলে আমৃত্যু ডেকেছি। আমাদের গুদাম (মাটির দোতলা) ঘরের লম্বা বারান্দায় খুব সকালে আশপাশের বাড়ির প্রচুর কিশোরী-যুবতী সোনার দাদির কাছে আরবি পড়তে আসত। তাদের আরবি পাঠের শব্দে ঘুম ভেঙে যেত। রান্নাঘরের ঢেঁকিতে চাল গুঁড়া করার ক্যাচ-ক্যাচ, মচ-মচ, থাম-থাম শব্দও একই সময়ে হতো। লম্বা টানা ঘুমের উপায় ছিল না। আমাদের বাড়ির নিকটবর্তী বঙ্গোপসাগর। সাগর তীর সংলগ্ন জেলেপল্লী। সকালে জেলে বাড়ি থেকে ছোট টুকরিতে করে জেলেনিরা মাছ নিয়ে উঠানে ‘ওবা মাছ লইবা নি মাছ!’ বলে হাঁকডাক দিত। লইট্টা মাছ, লইট্টা ইচা, হোন্দারা মাছ, রিসসা মাছ, ফাইস্সা মাছসহ নানা পদের সামুদ্রিক তাজা মাছ বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতে আসত। বাড়িতে বসে মাছ কেনার চলটি এখনো আছে। তবে পরিমাণে কমেছে। রান্নাঘরে খেজুরের রসের হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে উনুনে জ্বাল দিয়ে পাতলা গুড় তৈরি হতো। স্থানীয় ভাষায় রসে তৈরি পাতলা গুড়কে রাব বলা হয়। বেলা এগারোটার দিকে হরিহর ডাক্তার এসে রোগীর খোঁজ করতেন। বাক্স হাতে উঠানে উঁচু পিঁড়িতে বসে রোগী দেখতেন। আমরা ভাই-বোনেরা তাকে জ্যাঠা বলে সম্বোধন করতাম। ভাটিয়ারীতে তার নিবাস। সেখান থেকে সকালে গ্রামের পথ ধরে বাড়ি বাড়ি এসে চিকিৎসা সেবা দিতেন। নিজের তৈরি নানা রোগের নানা পদের বড়ি থাকত তার বাক্সে। বনজী ঔষধ ছিল সেইসব বড়ি। আমার একবার জ্বর হয়েছিল। মুখ হাঁ করিয়ে নিজ হাতে বড়ি গলাধঃকরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। মাত্র কয়েকটি বড়িতে দুই দিনেই আরোগ্য লাভ করেছিলাম। ধবধবে সফেদ ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত কাঁধে শাল জড়িয়ে হরিহর ডাক্তার স্থানীয় সবার নিকট আত্মীয়তুল্য ছিলেন। রোগী দেখা এবং ওষুধ বাবদ তাকে খুচরা প্রদান করলেও কখনো অর্থের দাবি কিংবা দেয়া পয়সা দেখতেন না। না দেখেই পকেটস্থ করতেন। কী নির্মল আন্তরিকতা ছিল তার কথা-আচরণে। বহু বছর পূর্বে তিনি গত হয়েছেন; কিন্তু আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিতে এখনো তিনি আছেন। থাকবেনও হয়তো আমৃত্যু। 

ইফতার আয়োজন আজকের মতো মোটেও ছিল না। আমার এখনো স্মরণে আছে ত্রিশ রোজায় প্রায় ত্রিশ পদের পিঠায় ইফতার করেছিলাম। শীতের রোজায় পিঠা এবং গ্রীষ্মে চিড়া ভিজিয়ে কলা দিয়ে ইফতারের রেওয়াজ ছিল সর্বাধিক। সে যুগ এখন গত হয়েছে। তখন আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ, গ্যাস আসেনি। ব্যাটারিতে রেডিও শোনার বিকল্প কিছু ছিল না। আমাদের গ্রামটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিমে। পূর্বদিকে শিল্পাঞ্চল। শিল্পাঞ্চলের কারণে অবকাঠামোগত উন্নতির ছোঁয়া তখনো গ্রামে পৌঁছেনি। ১৯৬৯ সালে গাছের গুঁড়ির বিদ্যুৎ খামে বিদ্যুৎ সরবরাহ গ্রামে শুরু হয়েছিল। ইফতার খাওয়া নিয়ে হরেক মজার ঘটনা ঘটত। আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসা এক আত্মীয় অনেকগুলো ধুপি পিঠা (ভাপা পিঠা) খাচ্ছে আর আমরা কৌতূহলে তার খাবার পর্যবেক্ষণ করছি। এক পর্যায়ে পেট ফেঁপে তার করুণ দশা সবাইকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। প্রচুর খেয়েছিল বেচারা সেদিন। মাত্রাতিরিক্ত খেয়ে অক্কা পাওয়ার দশা। ঘটনাটা আমাদের হাস্য-কৌতুকের উপলক্ষ হয়েছিল। 

বাজার-সদাইয়ের জন্য সপ্তাহে দুদিন ফৌজদার হাট এবং পাকিস্তান টোব্যাকো কারখানার মূল সড়কের পশ্চিম দিকের ছোট পরিসরের বানুর বাজার। বিকেলের সেই হাট-বাজার নির্ভর ছিল সবাই। বিকেলের পূর্বে হাট-বাজার তখন ভাবা পর্যন্ত যেত না। আমাদের গ্রামে সর্বসাকল্যে তখন দুটি মসজিদ ছিল। দুটিই মাটির গুদাম। একটির নাম দুল্লভের মসজিদ। অপরটি চালাদারদের মসজিদ। আমাদের বাড়ির পেছনের ক্ষেতের আল ধরে আমরা দল বেঁধে টর্চ হাতে নিকটবর্তী চালাদারদের মসজিদে তারাবি নামাজ পড়তে যেতাম। হারিকেনের আলোতে নামাজ হতো। শীতের রাতে গুদাম ঘরের সেই মসজিদে বেশ গরম অনুভব করতাম। বাড়িতে আমাদের দাদারা ছিলেন। কিন্তু পুরো পরিবারের কর্তাব্যক্তিটি ছিলেন আমার জ্যাঠাবাবা মাস্টার আবুল কাশেম। যার ইশারা-ইঙ্গিতে, আদেশ-নির্দেশে কেবল পরিবার নয়, স্থানীয় সমাজও পরিচালিত হতো। কলকাতার পাট চুকিয়ে যিনি চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট এবং রেলওয়ের কর্মকর্তার চাকরি পরিত্যাগ করেছিলেন সৎ-সাত্ত্বিক, নির্লোভ-নির্মোহ জীবন যাপনের অভিপ্রায়ে। হাইস্কুলে শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত ছিলেন। সলিমপুর ও ভাটিয়ারী একটি ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি ছিলেন সেই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট। বর্তমান সীতাকুণ্ডু উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন সাবেরী জ্যাঠাবাবার সেজো ছেলে। শিক্ষকতা-সমাজ সংস্কারক এবং ইতিহাসভিত্তিক নাটকের নাট্য নির্দেশক জ্যাঠাবাবার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি ছিল সীতাকুণ্ডু জুড়ে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধকরণে ইতিহাস জ্ঞানের গুরুত্ব অপরিসীম। এটা তার উপলব্ধিতে অধিকমাত্রায় ছিল। আধুনিক, সংস্কৃতিবান, সমাজ সংস্কারক ও মুক্তবুদ্ধির কাশেম মাস্টার জ্যাঠাবাবার কারণে আমাদের বাড়ির আদি নাম দরফ খান বাড়ির পরিবর্তে কাশেম মাস্টারের বাড়ি নামে খ্যাতি লাভ করেছে। স্থানীয় সমাজে তিনি ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্মানিত ব্যক্তি। স্থানীয় জনসাধারণের সাংস্কৃতিক মানোন্নয়নে-বিকাশে এবং আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামে, মুক্তিযুদ্ধে তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন। জ্যাঠাবাবা ইফতারের পূর্বে আমাদের সব ভাই-বোনকে একত্রিত করে কাছারি ঘরে দরুদ শরিফ জোরে জোরে পাঠ করাতেন। সমবেতভাবে আমরা দরুদ শরিফ পড়তাম। কোরাসে পঠিত সেই দরুদ শরিফ আজও আমার মুখস্থ রয়েছে। 

ঈদের দিন তিনেক পূর্বে বাড়িতে নাপিত এসে ঘাটার দুয়ারে পিঁড়িতে বসিয়ে একে একে সবার চুল কাটছে। আমাকেও অন্যদের মতো পিঁড়িতে বসে চুল কাটতে হবে! শোনামাত্র ছুটে মার কাছে গিয়ে পিঁড়িতে বসে চুল না কাটার বায়নায় কান্না জুড়ে দেই। অনেক চেষ্টার পরও কেউ আমাকে মানাতে না পারায় অগত্যা মনিচাচা সাইকেলের সামনে বসিয়ে ফৌজদার হাট রেলওয়ে স্টেশনের পার্শ্ববর্তী ডিপোর মুখ নামক স্থানের সেলুন থেকে চুল কাটিয়ে এনেছিলেন। রোজার মাঝামাঝিতে মনিচাচা আমাকে সঙ্গে নিয়ে রিয়াজুদ্দিন বাজার থেকে জামা-হাফ প্যান্টও কিনে দিয়েছিলেন। আজ তিনি নেই; কিন্তু আমাদের প্রতি তার অপরিসীম স্নেহ-ভালোবাসার স্মৃতি কোনোদিন ভোলা যাবে না। 

ঈদের চাঁদ দেখতে দল বেঁধে সমুদ্র তীরে ভিড় করতাম। গ্রামের পুরুষ মাত্রই সমুদ্র পাড়ে চাঁদ দেখার অপেক্ষা করত। চাঁদ দেখামাত্র আনন্দে আত্মহারায় হল্লা-চিৎকার করে করে বাড়ি ফিরতাম। রাত আটটার দিকে রিকশায় ব্যাটারি চালিত মাইকে ঈদগাহের নামাজের সময়সূচি ঘোষণায় বাড়ি বাড়ি আসতেন ঈদগাহ সংশ্লিষ্ট একজন। তার সঙ্গে থাকতেন আমার জ্যাঠাবাবার বড় ছেলে কায়সার ভাই। বর্তমানে চট্টগ্রাম বেতার-টিভির সঙ্গীত শিল্পী এবং চট্টগ্রাম বেতার-টেলিভিশন শিল্পী কল্যাণ সংস্থার সভাপতি কায়সারুল আলম। তিনি রিকশা থেকে নেমে প্রতিটি বাড়ির ঘাটার দুয়ারে মাইক হাতে গাইতেন, ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানসহ ঈদকেন্দ্রিক স্থানীয় অনেক গান। আমরা দল বেঁধে রিকশার পিছু পিছু ছুটতাম। গ্রামজুড়ে আগত ঈদের আনন্দের বার্তা পৌঁছে দিয়ে অনেক রাতে একত্রে বাড়িতে ফিরতাম। বাড়ি ফিরে দেখতাম মেয়েরা মেহেদি দিয়ে হাত রাঙাতে ব্যস্ত। গভীর রাত অবধি তারা একে অপরকে মেহেদি লাগিয়ে দিত। 

ঈদের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে কনকনে শীতে পুকুরে সবাই মিলে গোসল করে নতুন জামা গায়ে চাপিয়ে কাছারি ঘরে যেতাম। জ্যাঠাবাবা তুলায় আতর মাখিয়ে আমাদের সবার জামায় লাগিয়ে দিতেন। নতুন জামায় আতরের সুগন্ধি নাকে শুঁকতাম। জ্যাঠাবাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে ঈদগাহ অভিমুখে রওনা হতেন। পথে স্থানীয় প্রচুর মানুষ জ্যাঠাবাবার অপেক্ষায় থাকতেন। জ্যাঠাবাবা সবাইকে নিয়ে বিরাট কাফেলা সমেত ঈদগাহের দিকে জোর কদমে এগিয়ে যেতেন। আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর তীব্র ধ্বনিতে আমাদের কাফেলা ঈদগাহে পৌঁছাত। উন্মুক্ত ঈদগাহে সূর্যের তাপে বেশ উষ্ণতা অনুভূত হতো। ঈদগাহে ইমামতি করতেন স্থানীয় সোলেমান মৌলভী। ছয় ফুটেরও অধিক উচ্চতার সেই সোলেমান মৌলভীর মুখটি আজও আমার স্মৃতিতে রয়েছে। খুতবা শেষে আমার জ্যাঠাবাবা সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিতেন। ঈদের নামাজ শেষে গণহারে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে করে পিঠব্যথা হয়ে যেত। সমবয়সীদের সঙ্গে অবশ্য কোলাকুলি করতাম। ঈদগাহ্ থেকে বাড়িতে পৌঁছতে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হতো কেবল গুরুজনদের সালাম করার কারণে। বাড়িতে এসে খাওয়া-দাওয়ার পর একত্রে সমবয়সীরা মিলে আত্মীয়-প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে সালাম করতাম। সবাই খাবার খেতে তোড়জোড় করতেন। যেখানে এড়ানো সম্ভব হতো না সেখানে যৎসামান্য হলেও খাবার মুখে দিতে হতো। ঈদে নানা রকমারি খাবার-খেলনার পসরা সাজিয়ে ফেরিওয়ালারা গ্রামজুড়ে বিচরণ করত। পুরো গ্রাম ঘুরে ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে বাড়ি ফিরতাম। 

বাড়ি ফিরেও নিস্তার নেই। দল বেঁধে ছুটতে হতো রিকশাযোগে দূরে বসবাসরত আত্মীয়-পরিজনের বাড়িতে। মাদাম বিবির হাট হতে কর্নেল হাট অবধি আত্মীয়দের সালাম করতে ছুটতাম। খাবারের জন্য সবাই জোর করত বটে। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য থাকত সেলামি প্রাপ্তিতে। সবার পকেটে কাঁচা পয়সা ঝনঝন করত। বাড়িতে ফিরতে রাত হয়ে যেত। ঈদের এই সামাজিকতা এখনো চট্টগ্রামে রয়েছে। ঈদে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া অপরিহার্য সামাজিকতা কেবল নয়, বাধ্যতামূলক কর্তব্য এবং দায়িত্বরূপে বিবেচিত। কেউ কোনো কারণে আত্মীয় বাড়িতে ঈদে সালাম করতে না গেলে তার নিস্তার নেই। তীব্র ভর্ৎসনা শুনতে হবেই। আমার এক ফুফুর বাড়িতে এক জ্যাঠাতো ভাই ঈদের দিন না যাওয়ার কারণে পর দিন ফুফু এসে তাকে ইচ্ছেমতো ধোলাই দিয়েছিলেন। ফুফু ভাইপোর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তুই কত্তোয়র মোনাফেক। ঈদ্দে লতিক আঁয়ারে মাতাইতো ন-যস্। মরি গ্যালেও চাইতে যাতি-ন ফানলায়।’ অর্থাৎ তুই কত বড় মোনাফেক। ঈদে পর্যন্ত আমাকে সালাম করতে যাসনি। মরে গেলেও বোধকরি আমাকে দেখতে যাবি না। 

সব ফুফু ঈদের পরদিন দাদা-দাদিদের সালাম করতে আসতেন। এই যে সামষ্টিক ঈদের সামাজিকতা, এটা দেশের শহরগুলোতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একমাত্র চট্টগ্রামে স্বল্প পরিসরে হলেও আজও রয়েছে। এই উৎসব-আনন্দের সমষ্টিগত সামাজিকতার ছবিটা পূর্বের ন্যায় এখন নেই সত্য; তবে গুরুজনদের ঈদকেন্দ্রিক সালাম করতে যাওয়ার রীতিটি সামান্য হের-ফেরে চট্টগ্রামে রয়েছে।

ঈদ শেষে ঢাকায় ফিরে আসার দিনটি ঘনিয়ে এলে ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেত। ঢাকার খাঁচাবন্দি জীবনের সীমা ছাড়িয়ে উন্মুক্ত গ্রামে মাসের অধিককাল মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় কাটানো কিশোর বয়সের অসামান্য প্রাপ্তিরূপেই গণ্য করা যায়। গ্রাম, প্রকৃতি, সমুদ্র, খোলা মাঠ প্রাণবন্ত করে তুলত। ঢাকায় ফিরে আসার পূর্বের রাতে নির্ঘুম গল্প করতাম, গলা জড়িয়ে কান্নাকাটিও করতাম। সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার প্রাক্কালে বাড়িজুড়ে কান্নার রোল পড়ে যেত। অনেকে আমাদের বটতলী স্টেশনে একত্রে এসে বিদায় জানাত। বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে আমরা কান্নায় ভেঙে পড়তাম। আমাদের দশা দেখে ট্রেনের যাত্রীরা সমবেদনা পর্যন্ত জানাত। কুমিল্লা পর্যন্ত আমাদের কান্নার রেশ থাকত। ঢাকায় ফিরে সঙ্গীদের চিঠি লিখতাম। ফিরতি ডাক পেতাম। প্রতি বছরান্তে চট্টগ্রামে যেতাম। এবং ফেরার সময় একইভাবে সবাইকে কাঁদিয়ে নিজেরা কেঁদে কেঁদে ফিরতাম। আমাদের সেই সামষ্টিক জীবনাচার এখন লুপ্তপ্রায়। যতটুকু রয়েছে স্মৃতিতে। 


আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে পারস্পরিক সম্পর্ক, আসা-যাওয়া, দেখা-সাক্ষাৎ, খোঁজ-খবর নেওয়ার সংস্কৃতি ছিল।  আত্মীয়-পরিজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার প্রচলন ছিল সর্বাধিক। প্রত্যেকে প্রত্যেকের সুখে-দুঃখে, ভালো-মন্দে পাশে থাকাও ছিল অতি আবশ্যিক। এখন তো কেবল সামাজিক অনুষ্ঠানে এবং কারও মৃত্যুকে উপলক্ষ করেই পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাতের বিষয়টি আমরা প্রত্যক্ষ করে থাকি। আত্মীয় পরিজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার রেওয়াজ এখন আর তেমন নেই। এমনকি ধর্মীয় উৎসব-পার্বণে পর্যন্ত কেউ আর আগের মতো আত্মীয় বাড়িতে যায় না। সেই অনিবার্য সামাজিকতাও এখন নেই। মুঠোফোনে এসএমএস পাঠিয়ে কিংবা বড়জোর ফোনালাপে শুভেচ্ছা জ্ঞাপনে সামাজিক দায়িত্ব পালনের অদ্ভুত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে নিকট আত্মীয়-পরিজনের সান্নিধ্য-নৈকট্যের তাগিদ কেউ অনুভব করে না। যতটুকু রয়েছে তা দায় মেটানোর সীমাবদ্ধতায়। অনাবিল আন্তরিকতা, ভালোবাসা, সৌহার্দ, সম্প্রীতির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের চারপাশের প্রায় প্রত্যেকেই নিজেদের বিদ্যমান ব্যবস্থার উপযোগী করে তুলেছে। ব্যক্তিগত উন্নতি-প্রতিষ্ঠার পিছু অহর্নিশ ছুটে চলা। অন্য দিকে তাকানোর সময় পর্যন্ত কারও নেই। এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার অপর নামই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। যা আমাদের সমাজ-জীবনে স্থায়ী আসন পেতে বসেছে। সে কারণে সামাজিক প্রাণী মানুষ ক্রমেই অসামাজিক প্রাণীতে পরিণত হয়ে চলেছে। 

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //