সাদি মহম্মদ ও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার

আমি সংগীত শিল্পী নই, কিন্তু গান শুনতে ভালোবাসি। শুনি রবীন্দ্র, নজরুলগীতি; অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, ডিএল রায়, পুরনো দিনের আধুনিক এবং মরমি গান। আমি দশ বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন ঢাকা থেকে গাজীপুর টাঁকশালে গিয়ে অফিস করতাম, এ সময় পথিমধ্যে গাড়িতে বসে যে গান শুনেছি, অধিকাংশ ছিল সাদি মহম্মদের কণ্ঠে। ডিএল রায়ের ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ এবং রজনীকান্ত সোলের ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’- এ দুটি গান সাদি মহম্মদের কণ্ঠে আমার কাছে অতুলনীয় মনে হতো। ১৩ মার্চ, ২০২৪; সন্ধ্যায় নিজ বাড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় শিল্পী সাদি মহম্মদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃত্যুর দিন তিনি রোজা রাখেন, ইফতারও করেন; এর পরই স্বেচ্ছায় না ফেরার দেশে পাড়ি দেন। তাদের ঘনিষ্ঠতম স্বজন নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নিপার কথা অনুযায়ী, গত বছর তার পঙ্গু মা মারা যাওয়ার পর থেকে সাদি মহম্মদ নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন, মার মৃত্যুতে তার মধ্যে হতাশা ভর করে। কারণ বাবার মৃত্যুর পর এই মা কাপড় সেলাইয়ের আয় দিয়ে ১০টি সন্তানের ভরণপোষণ ও লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন। মাকে হারিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে সংগ্রাম করে ক্লান্ত হয়ে হয়তো তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন। কিন্তু মায়ের মৃত্যু আত্মহননের একমাত্র কারণ বলে মনে হয় না। অনেকের অভিমত, সাদির অনেক আগেই পাগল হয়ে যাওয়ার কথা। সাদি কেন এত দিনেও পাগল হননি- প্রায়ই এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে সাদিকেও। এবার সেই ঘটনায় আসি।  

২৬ মার্চ, ১৯৭১, শুক্রবার; সাদির বাবা সলিম উল্লাহ্ জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যান। নামাজ শেষে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে বিহারিরা সলিম উল্লাহ্র বাড়িতে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়, সাদিদের পরিবারের সদস্যরা পাশের বাসার ছাদে লাফ দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন, তার মার দুই পা ভেঙে যায়, ৯৬ বছর বয়সে তিনি গত বছর মৃত্যুবরণ করেন। আমৃত্যু তিনি হুইল চেয়ারে চলাফেরা করেছেন। সাদি এবং তার বাবা পাশের খালি বাসায় আশ্রয় নেন। তাদের প্রতিবেশী পাকিস্তান এয়ারফোর্সের এক পাঞ্জাবি অফিসার ঘরে ঢুকে সাদির বাবাকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করে, সাদি তার ছোট হাত দিয়ে ফিনকি দিয়ে বের হওয়া রক্ত চেপে ধরেন, বাবা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তুই পালা।’ পালানোর সময় সাদি পথিমধ্যে চাচাকে বল্লম দিয়ে হত্যা করতে দেখেন, দেখেন খালাতো ভাইকে মাটিতে শুইয়ে গরুর মতো জবাই করার দৃশ্য। এ ছাড়াও পালানোর পথে বিহারিদের হত্যাযজ্ঞে অনেক নিরীহ মানুষের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন। এতগুলো মর্মন্তুদ দৃশ্য দেখার পরও সাদি কেন পাগল হননি, সেই প্রশ্ন জাগারই কথা।  সাদি পাগল না হলেও স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছেন বলে মনে হয় না। 

সাদি মহম্মদের জন্ম ১৯৫৭ সালে। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন; কিন্তু বুয়েটে লেখাপড়া শেষ না করেই ১৯৭৫ সালে চলে যান ভারতের শান্তিনিকেতনে। সেখানে তিনি শান্তিদেব ঘোষ ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গান শেখেন। তার ষাটটিরও বেশি গানের অ্যালবাম রয়েছে। 

সাদি মহম্মদ ছিলেন একাধারে শিল্পী, শিক্ষক ও সুরকার। গানের জগতে এমন প্রতিভাবান হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় পদকের জন্য বিবেচিত হননি। যারা রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছেন তারা সকলেই যে সাদির চেয়ে বেশি প্রতিভাবান বা জাতীয় পর্যায়ে তাদের সকলের অবদান সাদির চেয়ে বেশি তা কিন্তু নয়। স্বীকৃতি না পাওয়ার এই হতাশাকে গভীর করে তুলেছে চলতি বছরে সাদির ছোট ভাই নৃত্যশিল্পী শিবলী মহম্মদের একুশে পদক প্রাপ্তি। ছোট ভাইয়ের কর্মের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বড় ভাই সাদিকে আনন্দ দিলেও স্বীকৃতি প্রদানের অনুষ্ঠানে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। নিজের না পাওয়ার হতাশা লুকিয়ে ছোট ভাইকে বলেছেন, ‘তুই পেলেই আমার পাওয়া হবে।’ 

বাংলাদেশে অনেকেই একাধিক রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছেন, অনেকে বাংলা একাডেমি, একুশে পদক পাওয়ার পরও স্বাধীনতা পদক না পেয়ে মরতে চাননি। কিন্তু কেন? দেশে পদক পাওয়ার যোগ্য লোকের এত আকাল পড়ল কেন? মুক্তিযুদ্ধে কোটি কোটি লোকের অবদান রয়েছে, তাদের বিবেচনায় না নিয়ে একই ব্যক্তিকে সব পদকে ভূষিত করার এই মানসিকতা অবশ্যই পরিত্যাজ্য, এতে প্রকাশ পায় জাতির দেউলিয়াত্ব।  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাদির মৃত্যুর কারণ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়ার অভিমানজাত হতাশাকে উল্লেখ করায় অনেক শিল্পীর আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে; তারা বলতে চাচ্ছেন, প্রকৃত শিল্পী কখনো প্রাপ্তি, অর্জন, পদকের লোভে সাধনা করেন না। সাদি যে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য উপযুক্ত ছিলেন তা সকলের লেখায় প্রতিফলিত হচ্ছে। আমরা মনে করি, যারা যথার্থ শিল্পী তাদের স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার রয়েছে, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি কোনো করুণা নয়, কর্মের সম্মান। রাষ্ট্রকে ভুল শোধরানোর জন্য সকলের আরও বেশি সোচ্চার হতে হবে।  রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পেলেও মহান এই সংগীত সাধককে সশ্রদ্ধ চিত্তে বিদায় জানিয়েছে কোটি কোটি ভক্ত। মরণোত্তর পদক দিয়ে তাকে আর যেন দ্বিতীয়বার অপমান না করা হয়। দেশ-বিদেশে হাজার হাজার ভক্তের ভালোবাসায় শিল্পী সাদি মহম্মদ বেঁচে থাকবেন বহুকাল।

লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //