বুয়েটে ছাত্ররাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষে

ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চান কি চান না, এই প্রশ্নে গণভোট হলে সম্ভবত অধিকাংশ লোকই বিপক্ষে ভোট দেবেন। বিশেষ করে যাদের সন্তান কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, তাদের এক শতাংশও পক্ষে ভোট দেবেন বলে মনে হয় না। অথচ ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার জন্ম হয়েছে ছাত্ররাজনীতির মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া যারা পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের বড় অংশেরই রাজনীতিতে হাতেখড়ি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। অন্তত আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত ছাত্রসমাজের ভূমিকা প্রশংসনীয়। কিন্তু তারপর কী এমন হলো যে এখন দেশের অধিকাংশ মানুষের মনেই ছাত্ররাজনীতি, বিশেষ করে ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে একটা বিতৃষ্ণা বা বিরক্তি ভাব? কেন তরুণদের বিরাট অংশের মধ্যে ‘আই হেইট পলিটিক্স’ ঢুকে গেল? কেন বুয়েটের মতো একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের দলীয় রাজনীতি দেখতে চান না এই পরিস্থিতি তৈরি হলো? 

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি নিয়ে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়ার ঘটনার জের ধরে আবরার ফাহাদ নামে এক শিক্ষার্থীকে তার কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। ওই ঘটনার পর বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসকে রাজনীতিমুক্ত করার দাবি তুলেছিলেন এবং তাতে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল শিক্ষক সমিতিও। শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালে বুয়েট কর্তৃপক্ষ ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করেছিল।

আবরার হত্যার সাড়ে চার বছরের মাথায় এখন সেই বুয়েটে পুনরায় ছাত্ররাজনীতি উন্মুক্ত করার দাবিতে সোচ্চার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। এ রকম পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালে জারি করা বুয়েটের ওই প্রজ্ঞাপন স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বুয়েটের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা ইমতিয়াজ রাব্বির একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত পয়লা এপ্রিল হাইকোর্ট এই রায় দেন। এর পর বুয়েটের উপাচার্যও বলেছেন, হাইকোর্টের আদেশ মানতে তারা বাধ্য। তার মানে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি করার ক্ষেত্রে আর কোনো আইনি বা প্রশাসনিক বাধা নেই।

আদালতের আদেশ শিরোধার্য এটি যেমন ঠিক, তেমনি যদি বুয়েটের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থী মনে করেন সেখানে দলীয় রাজনীতি উন্মুক্ত করা হলে পড়ালেখার পরিবেশ ব্যাহত হবে; সেখানে আবারও সংঘাতের রাজনীতি শুরু হবে; আবারও আবরার ফাহাদের মতো কেউ খুন হবেন, তাহলে শিক্ষার্থীদের এই অনুভূতির প্রতি সম্মান জানানো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তো বটেই, সরকারেরও দায়িত্ব। 

শিক্ষার্থীদের দাবির বিরুদ্ধে গিয়ে সেখানে দলীয় রাজনীতি উন্মুক্ত করে দিলে দেশের আর দশটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির যে চেহারা, তার চেয়ে নতুন কিছু হবে, সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। 

তা ছাড়া হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছেন সেটি চূড়ান্ত নয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পর রিভিউয়েরও সুযোগ থাকে। অর্থাৎ সবগুলো আইনি প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে কেবল একটি ছাত্রসংগঠনের দাবির মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি বুয়েটে দলীয় রাজনীতি উন্মুক্ত করে দেয়, সেটি সংকট সমাধানের বদলে নতুন কোনো সংকটের জন্ম দিতে পারে। কেননা কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে এই সময়ের রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনগুলো মূল দলের লাঠিয়াল হিসেবে প্রতিপক্ষ দমন তথা ক্যাম্পাসে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের বাইরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থরক্ষা, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ উন্নত করা এবং দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের বিকাশে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখে কি না, জনমনে সেই প্রশ্ন রয়েছে। এই প্রশ্নের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত শুধু বুয়েটে দলীয় রাজনীতি উন্মুক্ত করে দেওয়া কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //