টংক আন্দোলন ও একজন কুমুদিনী হাজং

১৯২২ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। তার প্রয়াণ হলো ২৩ মার্চ ২০২৪। একদম ছোট জীবন নয়, তবে জীবনকে বয়স দ্বারা বিবেচনা করাও যায় না। ক্ষুদিরাম বসু, বিনয়-বাদল-দীনেশ কার জীবন কত বড়? বেঁচে ছিলেন কত কম বয়স, কিন্তু এর মধ্যেই দেশমাতৃকার যে ঋণ তারা শোধ করেছেন তার সব কটিই বিরল। টংক বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ এবং ব্রিটিশ ও পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে সরব ছিলেন এই বীর নারী। আমৃত্যু এই মহীয়সী নারী আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন সোচ্চার। মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন সংশপ্তক। 

টংক-তেভাগা-নানকার কোনো আন্দোলনই স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে আলাদা কিছু নয়। এক একটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানুষ বুঝতে শিখেছে সংগ্রাম ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব না। সেদিক থেকে টংক আলাদা কোনো সংগ্রাম নয়। ‘টংক’ বাংলার কৃষকদের অধিকার আদায়ের একটি অন্যতম আন্দোলন। তখনো পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। কমরেড মণি সিংহ ভারত থেকে দুর্গাপুর মামাবাড়িতে এসেছেন। মামাবাড়ি এলেও দরিদ্র কৃষকরা জানতেন তিনি কে? তাই তার কাছে বলতেন সব অত্যাচার-অনাচার, দুঃখ-কষ্টের কথা। অতঃপর কমরেড মনি সিংহ হাজংদের সব কৃষককে নিয়ে শুরু করেন টংক প্রথা বা ধান কড়াড়ি খাজনা বাতিল আন্দোলন। আন্দোলনে যোগ দেন সীমান্তের কুল্লাগড়া ইউনিয়নের লঙ্কেশ্বর হাজং, রাশিমণি হাজংসহ আদিবাসীরা। এরই জেরে সে বছরের ৩১ জানুয়ারি লঙ্কেশ্বর হাজংসহ বেশ কজন হাজং বিদ্রোহী নেতাকে ধরে নিতে ব্রিটিশ পুলিশ আসে বহেড়াতলী গ্রামে। তাদের না পেয়ে লঙ্কেশ্বর হাজংয়ের সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী কুমুদিনী হাজংকে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ খবর এক কৃষকদের সভায় রাশিমণি লঙ্কেশ্বরের কাছে পৌঁছে দেয়। ছুটে যান তিনি কুমুদিনী হাজংয়ের বাড়িতে। নারীকে নিয়ে যাওয়া মানে মান নিয়ে যাওয়া উল্লেখ করে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন। হাতে থাকা দা দিয়েই পুলিশের ওপর হামলা চালান। পরে পুলিশের বন্দুকের গুলিতে তিনিসহ দুজন হাজং নেতার মৃত্যু হয়। প্রাণে বেঁচে যান গৃহবধূ কুমুদিনী হাজং। অর্থাৎ তাকে ঘিরেই আন্দোলন ভয়ংকর রূপ নেয়। এবং এখানে একটা কথা প্রযোজ্য যে, একটি হাজং পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুজনই আন্দোলনের কর্মী। কুমুদিনী হাজং এই আন্দোলনের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। 

সুসং-দুর্গাপুর এলাকার কৃষক হাজং সম্প্রদায় জীবন দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। তাদের উপর অত্যাচারও হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময় এসব কথা কেউ মনে রেখেছে বলে জানা নেই। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনামলের ঐতিহাসিক টংক আন্দোলন ও হাজং বিদ্রোহের সাক্ষী ছিলেন কুমুদিনী হাজং। বিবাহিত জীবনের শুরু থেকেই আন্দোলন সংগ্রামে কেটেছে তার জীবন। কমরেড মণি সিংহের মতো কিংবদন্তি তুল্য কমিউনিস্ট নেতার সান্নিধ্য পেয়েছেন তিনি। ফলে সংগ্রাম ছিল তার জীবনে নৈমিত্তিক। আদিবাসী হাজং পরিবারের কুমুদিনী আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছিলেন। তার জীবন থেকে এ শিক্ষা নেওয়া যায় যে আন্দোলন করতে শহরে থাকতে হয় না, বিশ্ববিদ্যালয়েও যেতে হয় না। বদলানোর মানসিকতা থাকলে যে কোনো জায়গায় বসে সংগ্রাম করা যায়। তিনি যেন সেই পথরেখা এঁকে দিয়ে গেলেন। 

যারা তার আশপাশের এলাকায় যেত তার সঙ্গে দেখা করে আসত। তার কাছে গেলে তিনি খুব খুশি হতেন। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের স্মৃতিচারণ করতেন। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ কথাই বুঝিয়ে গেলেন, একটি জীবন সংগ্রাম করেই কাটিয়ে দেওয়া যায়। তার জীবন সংগ্রাম মানুষকে উজ্জীবিত করবে দিনের পর দিন। সংগ্রামী কুমুদিনী হাজং বেঁচে থাকবেন বাঙালির ঐতিহাসিক সংগ্রামের আলেখ্য হয়ে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //