বিজ্ঞাপন ও ক্রিকেটারদের বিজ্ঞাপনকাণ্ড

বলা হয় এখন বিজ্ঞাপনের যুগ। দেখানো আর বেচাবিক্রির এই দুনিয়ায় বিজ্ঞাপন এখন এতই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, কোনো একটি পণ্যের উৎপাদন খরচ যদি হয় একশ টাকা, তাহলে সেটির প্রচারের জন্য খরচ করা হয় আরও পঞ্চাশ টাকা এবং তারপর সেটি বিক্রি করা হয় দুইশ বা তারও বেশি টাকায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পণ্যের বিজ্ঞাপন খরচ তার উৎপাদন খরচকেও ছাড়িয়ে যায়। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় দলের কয়েকজন ক্রিকেটারের বিজ্ঞাপনকাণ্ড নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় হয়েছে। সামনে এসেছে বিজ্ঞাপনের নীতি-নৈতিকতার প্রসঙ্গটি।

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ভাবা হতো বিজ্ঞাপন হলো মূল্যের বিনিময়ে ছাপা অক্ষরে নীরবে সেলসম্যানশিপ। কিন্তু এ ধারণায় এখন যথেষ্ট পরিবর্তন এসেছে। কারণ এখন শুধু ছাপার অক্ষর নয় বরং রেডিও, টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে হয়। তা ছাড়া বিজ্ঞাপন এখন শুধু পণ্যের বেচা-বিক্রি নয়, বরং বিভিন্ন চিন্তা-ভাবনা ও আদর্শ এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের সপক্ষে জনমত প্রচার ও নিয়ন্ত্রণ করার মতো কাজেও ব্যবহৃত হয়।

বলা হয়, বিজ্ঞাপন এমন জিনিস যে, জাহান্নামের বিজ্ঞাপন দেখার পরও আপনার মনে হবে আহা এখনই যদি জাহান্নামে যাওয়া যেত! তবে বিজ্ঞাপনের ইতিহাসের সঙ্গেই যুক্ত এর নীতি-নৈতিকতার প্রসঙ্গটি। বিজ্ঞাপন আধুনিক হয়ে ওঠার আদিপর্বেই সমস্যাটি সমাজসচেতন মানুষদের দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯১১ সালে বিজ্ঞাপনে বাড়িয়ে বলা, ভুল বোঝানো, বিশেষ করে কিছু পেটেন্ট ওষুধ নিয়ে বিজ্ঞাপনে মিথ্যাচারকে ঘিরে জনমত দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় পণ্যের কনজিউমার বা ভোক্তাদের মিথ্যা বিজ্ঞাপনের জাল থেকে বাঁচানোর জন্য ১৯৩৮ সালে গৃহীত হয়  Wheeler-Lea Act। তারপর পৃথিবীজুড়ে আরও অনেক আইন ও নীতিমালা পাস হয়েছে। জনসংযোগ ও বিজ্ঞাপনের ন্যায়নীতি নিয়ে International Public Relations Association (IPRA) ১৯৬১ সালে ভেনিসের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে একটি ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ পাস করে। এসব প্রাথমিক প্রচেষ্টা থেকে এটুকুই বোঝা যায় যে, পেশা ও ব্যবসাগতভাবে বিজ্ঞাপনকে চূড়ান্ত সাফল্যের পাশাপাশি যে নৈতিক ও মানবিক হয়ে উঠতে হবে সে নিয়ে ভাবনাচিন্তা আধুনিকতার সূত্র ধরেই এসেছে। (ড. স্মরজিৎ দত্ত, আধুনিক বিজ্ঞাপন, অগ্রণী বুক ক্লাব, কলকাতা/১৯৯৬, পৃ. ২২)।

বিজ্ঞাপনের সাম্প্রতিক প্রবণতা হলো মানুষকে বোকা বানানো, যার সাম্প্রতিক উদাহরণ নগদের বিজ্ঞাপন। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় তামিম ইকবাল ও মেহেদী হাসান মিরাজের মধ্যকার একটি ফোনালাপ প্রকাশ হয়। যেখানে শোনা যায়, কোনো এক কারণে সতীর্থ মুশফিকুর রহিমের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করছেন তামিম। নালিশ করছেন মেহেদী মিরাজের কাছে। সেই ফোনালাপ প্রচার হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। অবশেষে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লাইভে এসে এর ব্যাখ্যা দেন তামিম ইকবাল। জানান, মূলত মোবাইল আর্থিক লেনদেন প্রতিষ্ঠান নগদের একটি বিজ্ঞাপনের প্রচারণায় ফোনালাপ ফাঁসের অভিনয় করেন তারা। লাইভে তামিম-মিরাজ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এবং নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুক। লাইভে তামিম জানান, ঈদ উপলক্ষে নগদের একটি ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে। যেখানে ২৪ জন গ্রাহককে জমি উপহার দেওয়া হবে। সেই ক্যাম্পেইনে জয়ের জন্য দুজন বা তিনজন করে দল গঠন করে লেনদেন করতে হবে। যে দলে মুশফিককে রেখেছিলেন তামিম। তবে মুশফিক বের হয়ে গেছেন। এসব ঘিরেই মূলত এই ফোনালাপ।

তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মেহেদী হাসান মিরাজের নিশ্চয়ই টাকার এত অভাব পড়েনি যে যে কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনে অংশ নিতে হবে বা যে কোনো স্ক্রিপ্টে অভিনয় করতে হবে। কোটি কোটি মানুষ তাদের ভালোবাসে। তাদের প্রতিটি কথা, আচরণ অনুকরণীয়। অথচ তারা বিজ্ঞাপনের নামে এমন সব কাজ করেন যা কোটি কোটি মানুষের আবেগ অনুভূতির সঙ্গেই মশকরা। 

তামিম ও অন্যরা ফেসবুক লাইভে এসে যখন ফোনালাপ ফাঁসের রহস্য ভেদ করছিলেন তখন তারা ছিলেন বেশ হাস্যোজ্জ্বল, স্বাভাবিক। যেন একটি বিরাট কাজ করে ফেলেছেন। আসলে তারা এই ঘটনার মধ্য দিয়ে যে পুরো জাতির কাছে হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হলেন, ছোট হলেন, সেই বোধটুকু তাদের মধ্যে কাজ করছে বলে মনে হয় না। 

মনে রাখা দরকার, বিজ্ঞাপন তথা কোনো পণ্য বা পরিষেবা বিক্রির কৌশলের নামে যা খুশি তাই বলা, লেখা বা দেখানোর সুযোগ নেই। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, বিশেষ করে যাদের ব্যাপারে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের বিশেষ আবেগ অনুভূতি কাজ করে, তারা চাইলেই যে কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনে অংশ নিতে পারেন না। যেমন জাতীয় দলের খেলোয়াড়, শিল্পী, কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক এমনকি রাজনীতিবিদরাও যে কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপনে অংশ নিতে পারেন না, এটিই সর্বজনীন মত। অথচ এই মত, বিশ্বাস ও ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে শুধু টাকার জন্য জাতীয় দলের কয়েকজন ক্রিকেটার বিজ্ঞাপনের নামে যা করলেন তা সত্যিই লজ্জার।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //