ভাষা থেকে ভূমি: অনন্য বাঙালি ও স্বাধীনতা

ভাষা আন্দোলন থেকে ভূমি রক্ষার আন্দোলন, অতঃপর স্বাধীনতা- সত্যিই বাঙালির এক অনন্য অর্জন। ভাষা, বংশধারা, ভৌগোলিক অবস্থান, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, খাদ্যাভ্যাস, বিশ্বাস, প্রভৃতি মনো-সামাজিক ভিন্নতা থেকেই পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে নানা জাতি।  রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট মিল জাতি গঠনে একটি নির্দিষ্ট জনসমষ্টির মধ্যে যে পারস্পরিক সহানুভূতির কথা জোর দিয়ে বলেছেন, তাতে বর্ণিত উপাদানগুলোর সক্রিয় উপস্থিতি অত্যাবশ্যক। আর এ কথাও বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সহানুভূতি সৃষ্টির মূল হাতিয়ার হলো ভাষা, যার মাধ্যমে মানুষের মনের ভাব প্রকাশের বিষয়টি সম্ভবপর হয়ে ওঠে। ভাষার মাধ্যমে ভাব বিনিময়ের সূত্রেই মানুষ প্রথম স্বাজাত্যবোধের অনুভূতি লাভ করে- চিনে নেয় আপন ও পর। 

ভাষাসহ মানব সংস্কৃতির সকল উপাদানের প্রয়োগক্ষেত্র হলো ভূমি। সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকাকে কেন্দ্র করেই সংস্কৃতি উৎপন্ন হয়, বিকশিত হয়। জাতীয়তার উৎসারিত হওয়ার ক্ষেত্রও এটি। এজন্যই দেখা যায় যে, বিশে^র অধিকাংশ দেশের নামের সঙ্গে জাতীয়তা ও ভাষার নামের মিল রয়েছে। যেমন ইংল্যান্ডের ইংলিশ, রাশিয়ার রুশ, ফ্রান্সের ফরাসি প্রভৃতি। আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের বেলায়ও একই সূত্র খাটে। 

সাম্প্রদায়িকতার সূত্রে সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রটি তার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত অদ্ভুত জাতিতাত্ত্বিক আদর্শিক চেতনাকে ষোলোকলায় পরিপূর্ণ করে তুলতে সর্বদাই সচেষ্ট ছিল। তাই পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনসাধারণকে ন্যূনতম নাগরিক মর্যাদা প্রদানেও তারা কুষ্ঠিত হয়ে পড়ে। সৃষ্টিলাভের পর পরই পাকচক্র আক্রমণ করে বাঙালির বুনিয়াদি ও আবহমান ভাষা বাংলার ওপর। অনেক চক্রান্ত, কূটকৌশল, ঘটনা ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে জয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি- প্রথমবারের মতো প্রদর্শন করল তার জাতীয়তাবোধের প্রতি অকুতোভয় অঙ্গীকারের নির্ভেজাল নিশানা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভাষা ও ভূমি এভাবেই একাকার হয়ে গিয়েছিল। সংগঠকরা তো বটেই, যারা নিরস্ত্রভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, দেশের সেই অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রেরই জানা ছিল যে, তারা আপনার জাতীয়তা রক্ষার লক্ষ্যে মুক্ত ভূমির জন্য লড়ছে। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদরুদ্দীন উমর ভাষা আন্দোলনকে যথার্থই ‘বাঙালির স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সংগ্রাম’ হিসেবে অভিহিত করেন। বৃক্ষ যেমন বীজ থেকে অঙ্কুরিত হয়ে মূল, কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফলে সুশোভিত হয়ে ওঠে, বাংলাদেশের ভাষার সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম ও এর মধ্যবর্তী ঘটনাগুলোকে ঠিক এভাবেই উপস্থাপন করা যায়। 

স্বাজাত্য তথা জাতীয়তাবোধের বিষয়টিকে সাধারণ মানুষ কীভাবে ধারণ করেছিল তার প্রত্যক্ষ বিবরণ পাই আব্দুর রহমান নামে রাজশাহীর এক মুক্তিযোদ্ধা ও তার স্ত্রীর নিকট থেকে। এই বীরের বর্ণনা এমন যেন নিজের পৈতৃক সম্পত্তি রক্ষার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন! সেদিনের নববধূ মিসেস রহমান বলেছিলেন, বাঁচা-মরার কথা মনেই আসত না তখন, বরং মনে হতো এটি আমাদের সকলের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। আব্দুর রহমান বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে অনেক দুঃসাহসী অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বলেন, তখন ‘আমার ও আমাদের’ ছাড়া আর কোনো কথা কেউ বলত না শুনতও না- হতদরিদ্র অনেক লোক নিজে না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রেখে দিত। অনেকে 

কৃষক, শ্রমিক, ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাক সেনাদের গোপন তথ্য এনে দিয়েছে মুক্তিবাহিনীকে, যাদের কোনো প্রশিক্ষণই ছিল না।

অবশ্য বাঙালি সাধারণ মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এরা সহজে জ্বলে ওঠে না। কিন্তু একবার জ্বলে উঠলে লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত থামে না। ইতিহাসে এর বহু প্রমাণ আছে। যার অন্যতম ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে এ দেশের চাষিদের আন্দোলন। সাধারণ চাষিরা যখন নীলচাষকে ‘না’ বলল তখন নীলকরদের কমিশন চাষিদের দ্বারস্থ হয়। কিন্তু চাষিরা তাদের সিদ্ধান্তে অটল। দীনু ম-ল নামক এক চাষিকে অনেকভাবে প্রলোভন দিয়েও নীলচাষে সম্মত করাতে পারেনি তারা। কমিশন কারণ জানতে চাইলে দুঃসাহসী দীনু অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিল, ‘নীল চাষ আমার মৃত্যুযন্ত্রণার শামিল, নীল চাষ আমি করব না, কারোর জন্যই না, এ আমার প্রতিজ্ঞা।’ বাঙালির প্রতিজ্ঞা এমনই হয়, যা মুক্তিযুদ্ধ ও অপরাপর আন্দোলনে বাঙালিরা দেখিয়ে দিয়েছে। 

-গবেষক, মানবাধিকারকর্মী

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //